নতুন বিশ্বব্যবস্থায় চীন-ভারত সম্পর্ক
সবাই জানে, একটি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার তৈরি হয়েছে। এই নতুন ব্যবস্থায় কোন দেশের অবস্থান কী, কোন দেশ কোন দেশের সঙ্গে নতুনভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে, কোন দেশ কোন দেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমর্থন দিচ্ছে তা নতুন করে রি-শেফ হচ্ছে। যেমন ধরা যাক ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে দীর্ঘকালীন বন্ধন, তাতে বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একটি ফাটল ধরেছে। সম্পর্কটা এখন যতটা আন্তরিক, তারচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক এবং উইন-উইন। তাদের কমন ইন্টারেস্ট হলো সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং পশ্চিমা প্রভাবকে ধরে রাখা। এর বাইরে এতকাল যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের প্রতি অন্ধ সমর্থন দিয়েছে এবং ইউরোপকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তা থেকে ট্রাম্প প্রশাসন সরে এসেছে। সেটা ইউরোপকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে এবং ইউরোপ এখন নিজেদের সামরিক শক্তি দ্রুত বৃদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ পূর্বের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকতে চাচ্ছে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি অচিরেই ইউরোপ একটি সামরিকশক্তি হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে শীতল যুদ্ধের সময় চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক ছিল ভীষণ নড়বড়ে; কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯২ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিৎসিনের চীন সফর এবং ১৯৯৬ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি পেঙের রাশিয়া সফরের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হতে থাকে। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে চীন এবং রাশিয়ার কমন প্রতিদ্বন্দ্বী হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ। এমনকি ২০০৮ সালে রাশিয়া যখন জর্জিয়া আক্রমণ করে তখনো চীন রাশিয়ার বিরোধিতা করেছে; কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক এরপর থেকে উত্তরোত্তর উষ্ণতর হয়ে উঠেছে। কারণ, রাশিয়া ও চীন উভয়েই একটি কমন গ্রাউন্ড দেখতে পায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র ডোমিনেশন উপলব্ধি করে। দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া প্রভাবকে নিজেদের জন্য হুমকি বলে মনে করতে থাকে। এখন দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই উষ্ণ যে তারা আনলিমিটেড সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীন পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ওদিকে তাইওয়ান প্রশ্নে চীনও প্রচ্ছন্নভাবে রাশিয়ার সমর্থন পেয়ে আসছে। তাইওয়ান যুদ্ধ যে কোনো সময় ভয়ানক রূপ নেয়ার কথা বিশ্বব্যাপী বলা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চীন রাশিয়াকে পাশে পাবে। বর্তমান রাশিয়া একটি পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশ হলেও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, ষড়যন্ত্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং এটা ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
অন্যদিকে চীন খোলাবাজার নীতির প্রতি ঝুঁকে পড়লেও সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে আপসহীন। এ কারণে চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা প্রভাব হুমকির মুখে পড়েছে। এখন বিশ্বব্যাপী ছোট এবং বড় যত সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে তার সব খানেই যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ বনাম চীন-রাশিয়ার প্রক্সি ওয়ার লক্ষ করা যাচ্ছে। ইউক্রেনে তো অনেকটাই সরাসরি সংঘাত চলছে দুই বলয়ের।
অন্যদিকে সামরিক দিক দিয়ে এবং অর্থনীতিতে চীন পূর্বে যথেষ্ট দুর্বল ছিল; কিন্তু গত ২০-৩০ বছরে চীন এক মহাপরাক্রমশালী দেশে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো এখন বড় ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। চীন আর ৪০ বছর আগের চীন নেই। ক্যালিফোর্নিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। ২০২৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন নিউসাম চীন সফর করেন। তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতা স্বাক্ষর করেছেন। সম্প্রসারিত বাণিজ্য করবেন।
কিছুদিন আগে তিনি চীনের অগ্রসর প্রযুক্তি নিয়ে মন্তব্য করেছেন, চীন যেখানে রকেটের গতিতে আগাচ্ছে, সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র আগাচ্ছে বাইসাইকেলের গতিতে। অন্যদিকে চীন এমনভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়েছে যে দেশটিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগই নেই। ২০২৪ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেজারির ৭৫৯ বিলিয়ন ডলার ক্রয় করেছে। অর্থাৎ ফেডারেল রিজার্ভ চীনের কাছে এই পরিমাণ ঋণগ্রস্ত। রাজনৈতিকভাবেও চীনের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে চীন লবিস্ট নিয়োগ করে, অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। অসংখ্য চীনা কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, ওই কোম্পানিগুলোর প্রোডাকশন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা অচল হয়ে পড়বে। প্রযুক্তি, সামরিক প্রযুক্তিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলার পথে। আফ্রিকার এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশ চীনের বলয়ের মধ্যে ডুকে গেছে। নেভাল শক্তিতে চীন এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে। সাইবার এবং স্পেস প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এ সবই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব আছে। তাই লক্ষ করলেই দেখা যাবে, একমাত্র তাইওয়ান প্রশ্নে উচ্চস্বরে কথা বললেও অন্যান্য ক্ষেত্রে চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নীরব।
ট্রাম্পের মতো খোলামেলা কথা বলা মানুষ প্রেসিডেন্ট শি জিং পিঙের ব্যাপারে কোনো কটু মন্তব্য করেন না। বরং শির কথা উঠলেই বলেন, ফ্যান্টাসটিক ম্যান। চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যের ব্যাপারে ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ ধার্যের ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু পর মুহূর্তেই বুঝতে পেরেছে এই সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। ২৮ জুলাই স্টকহোমে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের আলোচনা শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যে চীনের সঙ্গে ট্যারিফ যুদ্ধে আপস করতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পক্ষান্তরে ভারতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী? প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নরেন্দ্র মোদিও তাকে এবং তার পলিসিকে সমর্থন দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষদের একটি ধারণা ছিল যে, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ভারতের প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র মোদি এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বাইরেও একটি ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে; কিন্তু সেই বলয় থেকে নরেন্দ্র মোদি সিটকে পড়েছেন বলেই এখন সবার ধারণা। এক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির হিসাব-নিকাশে গোলমাল হয়েছে যা ব্যাকফায়ার করেছে।
২০২৩ সালের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। এ সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের জো বাইডেন। তৎকালীন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনকে নরেন্দ্র মোদি ২০ হাজার ডলার মূল্যের হিরার আংটি উপহার দেন। মোদির সঙ্গে বাইডেন-হ্যারিসের আন্তরিকতা ট্রাম্প খুব একটা ভালোভাবে নেননি; কিন্তু চুপ করে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ৫২ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটার যা দুই দলের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের ঠিক পূর্বে নরেন্দ্র মোদি কোয়াডসহ অন্য কয়েকটি মিটিংয়ে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তখন ট্রাম্প মিশিগানে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমার বন্ধু মোদি আগামী সপ্তাহে আসছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।’ তিনি বারবার স্বভাবসুলভ বাক্যে মোদিকে ফ্যান্টাসটিক বলে উল্লেখ করেন; কিন্তু নরেন্দ্র মোদির জন্য মিনিস্ট্রি অব ফরেইন অ্যাফেয়ার্স ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার কোনো সিডিউল রাখেননি। সম্ভবত মোদি এবং তার কূটনীতিকদের কাছে মনে হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রশাসনের সঙ্গে গভীর সখ্য বজায় রাখার স্বার্থে তিনি আর ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেননি; কিন্তু বিধি বাম। অপ্রত্যাশিতভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ট্রাম্প। শুধু তাই নয় সিনেট ও কংগ্রেসে শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। এরপর মোদিকে মাই ফ্রেন্ড বললেও বাস্তবে ভারতের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন রীতিমতো বৈরী আচরণ করতে থাকে। এখন পর্যন্ত এমন একটি সিদ্ধান্ত নেননি যাতে মনে হয় ভারতের প্রতি ট্রাম্পের সামান্য দুর্বলতা আছে। ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের অবৈধ অবিভাসীদের যার যার দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে যে অল্প কয়েকটি দেশের মানুষকে রীতিমতো অপমান করে, হাতকড়া পরিয়ে দেশে পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন, তার মধ্যে অন্যতম ভারত। গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে চার দিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা নিয়ে প্রথমেই ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স মন্তব্য করেন, দিস ইজ নট আওয়ার বিজনেস। পরের চার দিনে ট্রাম্প যুদ্ধ থামানোর কথা বললেও একটি মন্তব্য করেননি যাতে বোঝা যায় এই যুদ্ধে ভারতের প্রতি তার সামান্য সমর্থন আছে। বরং যুদ্ধের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান অসিম মুনিরকে নিয়ে এক ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের কোনো সেনা প্রধানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্টের এমন ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক খুবই বিরল ঘটনা।
ট্রাম্প ট্যারিফের ক্ষেত্রে ভারতকে সামান্য ছাড় দেননি। যেখানে বেশ কিছু দেশের ওপর ১০ পার্সেন্ট ট্যারিফ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে ২৬ পারসেন্ট ধার্য করা হয়েছে। এ নিয়ে রাজেশ আগরওয়ালের নেতৃত্বে ভারতের বাণিজ্য প্রতিনিধি দল ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পাঁচ দফা আলোচনা হয়েছে; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। উপরোন্ত আমেরিকাবিরোধী সংগঠন বলে বিবেচিত ব্রিকস সদস্যদের ওপর তিনি অতিরিক্ত আরও ১০ পারসেন্ট শুল্ক ধার্যের হুমকি দিয়েছেন।
দুই পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য তৈরি করা একটি কৌশল। এ ব্যাপারে ভারত ছিল একটি উদাহরণ; কিন্তু বর্তমান সময়ে তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ভারত ব্রিকসের সদস্য হলেও একই সঙ্গে গ্লোবাল সাউথের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন চীনবিরোধী সংগঠন কোয়াডে যোগদান করে। এই কোয়াডে যোগদান ভারতকে বিভিন্নমুখী সমস্যায় ফেলা ছাড়া কোনো উপকারে আসেনি। এটা এখন পরিস্কার যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে কাউন্টার ব্যালান্সের জন্য ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। অন্যদিকে ভারতের কোনো প্রয়োজনে এখন আর যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যমান কোনো সহযোগী শক্তি নয়। শুধু গালভরা কথায় ভারতকে তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ‘গ্রেট পার্টনার’ বলে থাকে।
এসব বিষয়েই ভারতের নজরে এসেছে। এখন ভারতের জন্য একটি নতুন সুযোগ এসেছে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার। জুলাই মাসে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের আলোচনায় চীন সফরে গিয়েছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। অত্যন্ত আন্তরিক ও ফলপ্রসূ ছিল এই সফর। জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনায় চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যান ঝেঙ বলেছেন, ভারত ও চীনের মধ্যে বাস্তবসম্মত সহযোগিতা এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। যে পরস্পরিক উদ্বেগগুলো আছে তা নিয়ে দুপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মধ্য দিয়ে আমাদের দুপক্ষেরই বেনিফিট আসবে। তিনি টুইট করে জানান, ভারত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে চীনকে প্রেসিডেন্সিতে সমর্থন দিয়ে আনন্দিত।
আকসাই চীন দখল এবং অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের কার্যকলাপে ভারত অসন্তুষ্ট দীর্ঘকাল ধরেই। চীন অসন্তুষ্ট দালাইলামা প্রশ্নে, সেই সঙ্গে পশ্চিমাদের প্রতি ভারতের বর্তমান সরকারের নমনীয়তা প্রশ্নে। তবে ভারতের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতানৈক্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও চীন ভারতকে হুমকি বলে মনে করে না। চীনের এখন সম্পূর্ণ দৃষ্টি রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ এবং তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরে। যে কোনো দিন, যে কোনো মুহূর্তে এক নতুন মাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে দক্ষিণ চীন সাগরে ধারণা করছেন অনেকে। সেখানে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফিলিপাইন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে এই প্রস্তুতিতে একটি বড় শক্তি হিসেবে ভারতকে জড়িয়ে ফেলতে।
আমার ক্ষুদ্র মাথার বিবেচনায় এই ফাঁদে কোনোক্রমেই ভারতের পা দেয়া উচিত হবে না। সম্প্রতি ভারত ফিলিপাইনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্ন করেছে। এটি ছিল সিডিউলড। ব্যাপারটি যেন ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। একসময় স্লোগান ছিল ভারত-চীন দুই ভাই। সম্পর্কটি সেইখানে নিয়ে যেতে পারলে ভারতের এবং চীনের উভয়ের জন্যই ভীষণ ইতিবাচক হবে। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র যতই শক্তি সঞ্চার করুক, বর্তমান চীনের ভয়ানক সামরিক পারদর্শিতা অপরাজেয় হয়ে উঠেছে। এসব যুক্তরাষ্ট্র জানে। তাই কেবল চীনের আশপাশের দেশগুলোকেই শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে।
আশার কথা, চীন এবং ভারতের মধ্যে ইতোমধ্যে বরফ গলতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ব্রিকস সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি এবং নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে জয়শঙ্করের অংশগ্রহণ অনেকটা বরফ গলিয়েছে। ভারত জুলাই মাস থেকে ৫ বছর পর আবার চীনা নাগরিকদের ভিসা দিতে শুরু করেছে। চীনও কয়েক মাস আগে ভারতের পর্যটকদের ভিসা দিতে শুরু করেছে। জয়শঙ্কর বলেছেন, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে বিস্তর বৈরী মনোভাব রয়েছে তা প্রশমনে দুই দেশ কাজ করবে।
চীনের সঙ্গে ভারতের দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হলে তা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা খুব ভালোভাবে নেবে না। বিশেষ করে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে চেষ্টা করবে। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগও নেবে; কিন্তু ভারতকে মনে রাখতে হবে ইউক্রেন বিষয়ে বক্তব্যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি স্যাকসের কথা: নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে দূরের কোনো দেশের সঙ্গে জোট বাঁধতে চেষ্টা করলে তার ফল কখনোই ভালোহবে না।
মহসীন হাবিব: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে