মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি
পোড়া ভবনটিতে এখন শুধু স্মৃতি হাতড়ে ফেরা হাহাকার
নীরব কান্নায় ভেসে যাওয়া মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনটির সামনে এখন শুধু নিস্তব্ধ পৃথিবী। চারপাশে থমকে যাওয়া সময়, নিঃশব্দে বিলাপ করা দেয়ালগুলো আর পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে থাকা বাতাস। সন্তান হারানো অভিভাবক আর প্রিয় বন্ধুকে হারানো সহপাঠীরা ছুটে এসেছেন সেখানে। কেউ নিচু স্বরে দোয়া পড়ছেন, কেউবা আবার হতাহত শিশু শিক্ষার্থীদের ছিঁড়ে যাওয়া খাতার পাতায় চোখ রেখে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো।
বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে এক দিন আগেই রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ হারিয়েছে তার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে, চিরতরে চলে গেছেন দুই শিক্ষকও। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তারা। পোড়া দেহে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরও অনেকে। নিহতদের জন্য হাহাকার স্বজন হারানোসহ পুরো দেশবাসীর বেদনার্ত হৃদয়ে। আর সুস্থ হয়ে ফিরতে আহতদের জন্য সম্মিলিত প্রার্থনা।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) মাইলস্টোন ক্যাম্পাসজুড়ে সেই শোকার্ত পরিবেশ। বাতাসে এখনো পোড়া ফুয়েল, গ্লাস, প্লাস্টিকের গন্ধ। এটি একটি প্রজন্মের ভস্ম হয়ে যাওয়া নিরাপত্তাবোধের গন্ধও। তাইতো অবর্ণনীয় শোকের মাঝেই হিসাব-নিকাশ না মেলার নানা দাবিতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের উত্তাল আন্দোলনে দিনভর উত্তপ্ত হয়েছে পরিস্থিতি। ঘটেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে টানা ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাও।
অল্প কিছু সময়ের হেরফেরে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে ১২ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ। অশ্রুসিক্ত নয়নে মাইলস্টোনের এই শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে ছিল পোড়া ক্লাসরুমের ধ্বংসস্তূপের সামনে। মায়ের হাত ধরে থাকা এই শিশুটি জানালো, ‘কাল পড়া না পারায় শাস্তিস্বরূপ স্যার আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেন। আমি পাশের ভবনের নিচে পানি খেতে যাই, তখন আরও ৪-৫ জন ছিল’
আব্দুল্লাহর মা জান্নাত এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে কথা বললেন চুপচাপ কণ্ঠে, ‘হয়তো এটা ছিল আল্লাহর রহমত। না হলে আমার ছেলে হয়তো আজ আগুনে পুড়ে যেত। ওর হাত থেকে পানি খাওয়ার পটটাও পড়ে গেছে। এখন এটুকু মনে হলেই বুকটা ফেটে যায়।’ অন্য অভিভাবকদের কারও হাতে তখন ছোট ছোট দোয়ার বই, কেউবা মোবাইল ফোনে দেখাচ্ছিলেন, আগের দিনের ক্লাসরুমের ছবি, যেখানে আজ শুধুই ছাই, পুড়ে যাওয়া বেঞ্চ আর চারপাশে রক্তমাখা নিদর্শন।
আঁছড়ে পড়া যুদ্ধবিমানের আগুনে পোড়া ভবনটির একটি শ্রেণিকক্ষের বীভৎস দৃশ্যও ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। চারপাশে পুড়ে যাওয়া বেঞ্চ-বুকশেলফ, ঝলসে যাওয়া সিলিং ফ্যান, ছড়িয়ে আছে রক্তমাখা পেনসিল, ছিঁড়ে যাওয়া বই-খাতা, পানির বোতল, টিফিন বক্স। এক কোণে পড়ে থাকা একটি ছোট্ট খাতার ভেতরে অর্ধেক লেখা একটি রচনার শিরোনাম ‘আমার প্রিয় বন্ধু’। হয়তো যে বন্ধু আজ নেই, সেই বন্ধুর জন্যই লেখা হয়েছিল সেই শব্দগুলো।
সাবেক শিক্ষার্থী বুলবুল এসেছিলেন সহপাঠী হারানো এক বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে। ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে তার কণ্ঠ কাঁপছিল, মাঝে মাঝেই নীরবে তাকিয়ে থাকছিলেন পোড়া জানালার দিকে। চোখ মুছতে মুছতে বুলবুল বলেন, ‘আমি এই ভবনে চার বছর ক্লাস করেছি। এখানে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে। আজ সেই ভবনের এমন করুণ দশা দেখে মনে হচ্ছে, আমার নিজের একটা অংশ পুড়ে গেছে। আমি ভাবতেই পারছি না- এই ক্লাসরুমেই কেউ দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। এটি কল্পনা করার মতো না’।
স্কুল শাখার গণিত শিক্ষক মোহাম্মদ আবু হেনার চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘এই ছেলে-মেয়েগুলো আমাদের পরিবারেরই অংশ। তাদের একজনও যদি না ফেরে, সেটা আমাদেরও ব্যর্থতা। আজ যাদের ক্লাসে থাকার কথা, তারা কেউ নেই, কেউ আহত, কেউ শোকাহত। আমি আজ সারা দিন শুধু ভবনের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। মনে হচ্ছিল, এক নিঃশ্বাসে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষক, আমরা তো শুধু পড়াই না, আমরা বাচ্চাদের ভালোবাসি, বকাঝকা করি, সাফল্যে হাততালি দেই। আজ যখন তাদের কান্না দেখি, তখন বুঝি, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে।’
মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ৩১ জন নিহত হবার তথ্য দিয়েছে আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তবে ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করতে পেরেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে