বাল্যবিবাহ রোধে চাই অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
বিবাহ সমাজব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং পবিত্র বন্ধনও বটে। কিন্তু বাল্যবিবাহ যেকোনো সমাজব্যবস্থার জন্য অভিশাপ। সে ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য ও মাতৃস্বাস্থ্যে আমাদের দেশের বেশ কিছু উন্নতি দৃশ্যমান। তবে বাল্যবিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যাচ্ছে না। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষে। এটি মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাল্যবিবাহ বন্ধে দেশে ইতিবাচক আইন ও নীতিমালাও আছে। কিন্তু যথাযথ আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে এখনো বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।
সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) স্যাটেলাইট কার্যালয়ের বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৪ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালে বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা।
মূলত বাল্যবিবাহের কারণে দ্রুত সন্তানের মা হয়ে অপুষ্টিতে ভোগেন নারীরা। তাদের সন্তানও অপুষ্টিতে ভোগে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই আকারে ছোট বা খর্বকায় সন্তানের জন্ম হয়। সেই সঙ্গে বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েরা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। একই কারণে শিক্ষা থেকেও ঝরে পড়ে মেয়েরা। জাতিসংঘ শিশু সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সবাই শিশু। সে অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু। কথায় আছে, আজকের শিশু আগামীকাল দেশের কর্ণধার। তাই এই ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের নিরাপত্তার বিধান খুবই জরুরি।
অন্যদিকে বাল্যবিবাহের ফলে শুধু ওই শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরী একা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র, তথা সমাজসহ সবাই। যে শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরী তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণত হতে পারত, বাল্যবিবাহের ফলে তা ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই শুধু শিশুদের জন্য নয়, রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা খুব জরুরি।
অথচ এসব শিশু ও কিশোর-কিশোরীর উন্নয়নে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণপূর্বক বাস্তবায়ন করা হলে এরাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারত। বলা চলে, শিশুদের অধিকার যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে না। এ অবস্থায় দেশও তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের আইন ও বিধিমালা থাকায় আশা করা গিয়েছিল পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু কোভিডে অনেক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়ে গেল। অবস্থার উন্নয়নের জন্য কী পরিমাণ বাল্যবিবাহ হয়েছে, সেটার প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে উদ্যোগ বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরও শক্তিশালী হতে হবে।
তাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের যথাযথ অধিকার, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবনের মান উন্নয়নে অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন, উপবৃত্তি প্রবর্তন, বিনা মূল্যে বই বিতরণ, নারী শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকার জাতীয় বাল্যবিবাহ আইন, শিশুনীতি ও নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছে। গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে বাল্যবিবাহ, নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেলেও এখনো প্রত্যাশিত হারে কমেনি। তাই শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা এবং নির্যাতন ও নিপীড়নমুক্ত সমাজব্যবস্থ্যা। সেই সঙ্গে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের প্রতি আপনজনসহ সবাইকে মানবিক আচরণ করতে হবে এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চায় আরও গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে বাল্যবিবাহ রোধ করা অসম্ভব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে