অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সরকার বলা যায় কি?
২o২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান। এটাকে অনেকে বিপ্লব বলার চেষ্টা করেন; কিন্তু এটাকে বিপ্লব বলার কোনো সুযোগ নেই, এটা একটা স্রেফ গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থানের শুরুটা হয়েছিল চাকরিক্ষেত্রে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন করতে গিয়ে সরকার জুলাই ম্যাসাকার সংঘটিত করে। ফলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি প্রথমে ‘নয় দফা’ এবং পরবর্তীতে ‘এক দফা’র আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আমি ১৮-১৯ বছর ধরে এখানে শিক্ষকতা করছি। প্রায় ২৪-২৫ বছরের বেশি সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সংকটে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত আছি। গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়গুলোতে চলমান দমন-নিপীড়ন, গুম ও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করি এবং বক্তব্য প্রদান করি। ১৫ জুলাই রাতে ভিসির বাসভবনে যখন হামলা হয় তখন আমি সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলাম। পরদিন সকালে ভিসির অফিসে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে উপস্থিত হয়ে ওই হামলার দায়দায়িত্ব নিয়ে ভিসিকে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করেছিলাম। সেই বক্তব্যটি প্রথম সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
এরপর ১৭ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ওইদিন সন্ধ্যায় মেডিকেলের সামনে থেকে আমার একটি বক্তব্য লাইভ হয়। সেই বক্তব্যটি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আর ২৯ জুলাই শহীদ মিনারের সামনে অনুষ্ঠিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম, তার ভিডিওটা ব্যাপকভাবে সব জায়গায় ছড়িয়ে যায়। আমার সেই বক্তব্যে যেহেতু দেশের সব মানুষের প্রতি রাস্তায় নামার আহ্বান ছিল, সারা দেশেই ওই বক্তব্যের একটি আবেদন তৈরি হয়েছিল। ফলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের সাধারণ মানুষ, গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক, দোকানদারসহ সব শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ ক্যাম্পাসে এসে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে।
৩৬ জুলাই পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ ক্যাম্পাসে এসে আমাদের সমর্থন দিয়েছে। অনেকে বলেছেন, ‘স্যার, আপনার বক্তব্য শুনে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি’। জুলাইয়ের একটা সময় জাহাঙ্গীরনগরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী চলে গিয়েছিল। দেড়শ-দুইশ ছাত্রছাত্রী রয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পাসের বাইরে। কারণ হলগুলো কয়েকদিন সিলগালা ছিল। অবশ্য আমাদের শিক্ষার্থীরাই প্রথম সিলগালা ভেঙে হলে অবস্থান নেয়। সেই দিনগুলোতে তারা রাতে কোথায় গিয়ে ঘুমিয়েছে, ঠিক-ঠিকানা নেই। প্রতিদিন দিনের বেলায় এসে তারা মিছিল-সমাবেশ করছে এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছে। এটা জাহাঙ্গীরনগরের গর্বের জায়গা।
বৈষম্যবিরোধী সংগঠন সব ছাত্রর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি বাম সংগঠনগুলোর ছাত্ররাও ছিল। বৈষম্যবিরোধী সংগঠনে সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও শক্তিশালী অংশগ্রহণ ছিল। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর দেখলাম, সেখানে সাধারণ ছাত্রদের কোনো কৃতিত্ব নেই। বামদের কোনো কৃতিত্ব নেই। যারা এখন নতুন দল গঠন করেছে, তারা পুরো কৃতিত্বটা দখল করল। শুধু কৃতিত্বই দখল করল না, অনেকের ওপরে তারা নানানভাবে ভাষাগত আক্রমণ চালাল- যা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। নারী শিক্ষার্থীদের অবদানকে বাদ দিয়ে এই গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস লেখা সম্ভব না। অথচ, গত এক বছরে প্রতিক্রিয়াশীল অনেকেই সেই নারীদের প্রতি নানাভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। জনপরিসরে নারীকে হেনস্তাকারীদের পুষ্পমাল্য দিতে দেখা গেছে, যা গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গণঅভ্যুত্থানের সময় কেন্দ্রীয় ছয় সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে আটক করে, তাদের দিয়ে যখন আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছিল তখন সারা বাংলাদেশের ছাত্ররা নিজেদের ‘সমন্বয়ক’ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল। ১৬ জুলাই রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ১৮ জুলাই আন্দোলনকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা আন্দোলনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সব ধরনের শিক্ষার্থী সবাই রাস্তায় নেমেছে; কিন্তু আমরা দেখলাম, ৫ তারিখে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ফসল ৮ তারিখেই বেহাত হয়ে গেল। থার্ড পার্টির কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হলো। সেই সরকারের প্রধান ড. ইউনূস আমেরিকায় গিয়ে একজনকে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একজনকে মাস্টারমাইন্ড ঘোষণা দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রিসেট বাটন পুশ করার ঘোষণা দেয়ার মধ্য দিয়ে ওই সময় ড. ইউনূস যে ভুল করেছিলেন, সেই ভুলের খেসারত এখনো পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। তিনি বিশেষ একজনকে গণঅভ্যুত্থনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের যে ঐক্য, সেটা বিনষ্ট করে দিয়েছেন।
এক বছর ধরে এতকিছু করার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত যে জুলাই ঘোষণা হলো সেখানে গণঅভ্যুত্থানের তেমন কিছুই নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রিসেট বাটন পুশ করার ঘোষণা দিয়ে ড. ইউনুস যে ভুল করেছিলেন, সেই ভুল খানিকটা শুধরানোর চেষ্টা করেছেন জুলাই ঘোষণায়। তার জুলাই ঘোষণা একটা ফাঁকা আওয়াজ। তবে যে কারণেই হোক সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেছেন। আমার বিবেচনায়, তার জুলাই ঘোষণায় এই একটি বিষয় পাওয়া গেছে। আর কিছু না। গণঅভ্যুত্থানের পর যে সরকার গঠন করা হলো, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিওর লোকজনকে দিয়ে। এ সরকারের কয়জন এই গণঅভ্যুত্থানে ছিল? তাদের অনেকেই বয়োবৃদ্ধ, যারা অনেক আগেই অবসরে চলে গিয়েছিলেন। ফলে তাদের দক্ষতা থাকলেও কর্মক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তাদের অনেকেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের উচ্ছিষ্টভোগী। তাদের দিয়ে তিনি একদিকে সরকার গঠন করলেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার মূল কারিগর তো ছিল আমলারাই। ড. ইউনূস সেই আমলাতন্ত্রের ওপরই ভর করে আছেন। তাদের সরকার গঠনে খুব তাড়াহুড়া ছিল। কোনো কিছু বিচার-বিবেচনা না করে, সংবিধান ও রাষ্ট্রপতিকে মেনে শপথ করে সরকারে বসল। পরবর্তীতে তারাই বলতে শুরু করল, ‘ফ্যাসিস্ট সংবিধান’, ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপতি’। বঙ্গভবনে কে গিয়েছে? আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা গিয়েছে না কি ড. ইউনূস ও তার লোকজন গিয়েছে? সংবিধান কে মেনেছে? ড. ইউনূস ও তার লোকজন মেনেছে। তারা যদি গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ডই হতো, তাহলে ৮ তারিখে তাদের ভাষায় ফ্যাসিস্ট সংবিধান মেনে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপতির কাছে তারা শপথ নিল কেন? সত্যিকারের মাস্টারমাইন্ড যদি ওখানে কেউ থাকত, তার দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল শহীদ মিনারে; বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা ছিল না। যা হবে শহীদ মিনারে হবে- এটা তাদের বলা উচিত ছিল। ফলে আমি বলব, ৮ তারিখেই গণঅভ্যুত্থান বেহাত হয়েছে।
এই সরকার এখনো শহীদদের সংখ্যাটা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি। যতটা জেনেছি, আহত ৩১ হাজার। প্রায় ৪ হাজার চোখ হারিয়েছে। অনেকে হাত-পা হারিয়েছে। কেউ পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন। কেউ আংশিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এর বিনিময়ে যে সরকার গঠিত হলো, সেই সরকার এক বছরে যা করেছে তার মাঝে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা, ঐক্য বা প্রতিজ্ঞার কিছুই নেই। বরং এই সরকার তাদের পিঠ বাঁচানোর জন্য গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে নানান সংকটে ছাত্রদের ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে ছাত্ররা একটি জটিল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়ল। তাদের একটা অংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভালো পরিবেশ পাচ্ছে না। আরেকটা অংশ রাজনীতি ও প্রশাসনিক ময়দানে।
গত ১ বছরে তাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ। বদলি বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও মব ভায়োল্যান্সসহ নানান অভিযোগ। এর মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে। সর্বশেষ এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জে গিয়েছে, যে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করল, তা খুবই দুঃখজনক। হ্যাঁ, রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সেখানে যাওয়ার অধিকার তাদের আছে; কিন্তু ও ঘটনায় যে চারটি হত্যাকাণ্ড হলো তার দায় কে নিবে? আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। আইনের শাসন বলতে কিছুই নেই। মব ভায়োল্যান্স, মব কিলিং চলছে। এই সরকার একটা নিরাপদ বাংলাদেশ নির্মাণে তারা ব্যর্থ হলো। সার্বিক বিবেচনায়, এই সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সরকার বলা যায় কী?
[জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে জোরালো বক্তব্য দিয়ে তিনি গণঅভ্যুত্থানে জনসংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।]
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে