Views Bangladesh Logo

মব সন্ত্রাসের লীলাভূমি মুরাদনগর

মাসহ দুই সন্তানের মরদেহ দাফন নিয়ে অনিশ্চয়তা, হয়নি মামলা

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

কুমিল্লার মুরাদনগরে বিবস্ত্র করে নারী নির্যাতন এবং তার ভিডিও ধারণ করার ঘটনায় সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই একই উপজেলায় মা, ছেলে ও মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা আতঙ্কিত করেছে দেশবাসীকে। অথচ ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখন পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি।

শুক্রবার বাঙ্গরাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, নিহতদের পরিবারের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের খোঁজা হচ্ছে। পরিবারের লোকজন থানায় মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।

বৃহস্পতিবার সকালে মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরাবাজার থানার কড়ইবাড়ী গ্রামে এলাকাবাসী একটি মোবাইল ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ তুলে জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৮), তার ছেলে মো. রাসেল (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তারকে (৩২) পিটিয়ে হত্যা করে। এই হামলায় আহত হন রুবির ছোট মেয়ে রুমা আক্তার (২৫)। তাকে শঙ্কটাপন্ন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) ভর্তি করা হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার বিকেলে কুমেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুপুর ২টার দিকে নিহত ৩ জনের মরদেহের ময়নাতদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। এসব মরদেহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে মরদেহ কার কাছে হস্তান্তর করা হবে তা জানাতে পারেনি পুলিশ। নিহতদের দাফন কোথায় হবে, কীভাবে হবে বা কারা করবে তা এখনো কেউ বলতে পারছে না।

স্থানীয় প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যমতে, নিহতদের দাফন নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। কড়ইবাড়ী গ্রামসহ আশপাশের বেশিরভাগ এলাকায়ই এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনশূন্য হয়ে পড়েছে গ্রামগুলো, বন্ধ আছে বেশিরভাগ দোকানপাট।

স্থানীয়রা বলেন, গতকালের ঘটনার পর থেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে কড়ইবাড়ীসহ আশপাশের এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে গেছে।

ভিউজ বাংলাদেশ-এর স্থানীয় প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, রুবির বাড়ির সামনের উঠোনে তখনো রক্তের দাগ, ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া কাপড় পড়ে ছিল। বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে।

রুবির বাড়ির ভাড়াটিয়া রহিমা বেগম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গ্রামের কয়েকশ লোক রুবি বেগমের বাড়ি ঘিরে ফেলে। রহিমা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বাড়ির ছাদে লুকিয়ে পড়েন। পরে তাকে যখন ছাদ থেকে নামানো হয়, তিনি দেখেন সিঁড়ির গোড়ায় রুবির ছেলে রাসেলের মৃতদেহ, বাড়ির উঠানে রুবি বেগমের মৃতদেহ আর বাড়ির সামনের রাস্তায় রুবির এক মেয়ে জোসনার মৃতদেহ পড়ে আছে। ঘটনার পর রুবির ছোট মেয়ে রুমাকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়।

মুরাদনগরের ঘটনায় স্থানীয়রা দাবি করেন, এই পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল। একপর্যায়ে এলাকাবাসীর অসন্তোষ চরমে ওঠে। বুধবার মাগরিবের নামাজের পর স্থানীয় একটি মসজিদে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ‘মাদকমুক্ত গ্রাম’ গড়ার শপথ নেন এলাকাবাসী।

কড়ইবাড়ী গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মো. মোস্তফা বলেন, ‘৪০ বছর ধরে এই পরিবার মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাস করে আসছিল। আমাদের ছেলেমেয়েদের ধ্বংস করেছে। এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে শপথ নিই- আর নয়।’

এরপর বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে রুবির জামাতা মনির হোসেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিনের মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার পর স্থানীয় ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া এবং আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল রুবির বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। পরে শতাধিক গ্রামবাসী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে রুবি, রাসেল ও জোনাকিকে পিটিয়ে হত্যা করে।

আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল বলেন, ‘ঘটনাস্থলে গেলে রুবি ও তার পরিবার আমাদের মারধর করে। সম্মান বাঁচাতে আমরা সেখান থেকে সরে যাই। পরে গ্রামবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। তবে হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

বেশ কয়েকজন স্থানীয় যুবক নাম না প্রকাশ করার শর্তে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছাড়া এ ধরনের ঘটনা সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্রয় না থাকলে একই পরিবারের তিনজনকে সামান্য মোবাইল চুরির অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করা সম্ভব হতো না।

এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছফির উদ্দিন বলেন, ‘লোকজন অনেকদিন ধরে প্রস্তুত ছিল। আগে থেকে বলাবলি হচ্ছিল, দেখি কবে শেষ করা যায়!’

নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার আগের রাতেই ফোনে তার স্বামীকে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়।

প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ওরা খারাপ ছিল, মানি; কিন্তু এভাবে মারা হলো! একবারও কি ভাবা হয়নি ওরা মানুষ ছিল?’

তরুণ মাদকবিরোধী কর্মী রাজু বলেন, ‘গ্রামে একসময় ইয়াবা-ফেনসিডিল ছেলেমেয়ের পকেটে পাওয়া যেত। আমরা অনেক সহ্য করেছি; কিন্তু তাই বলে মাদকের জন্য পিটিয়ে মানুষ হত্যা, এটা মেনে নেয়া যায় না।’

কলেজছাত্রী মীম বলেন, ‘একটা ফোন চুরির ঘটনা, একটু মারধর হতো। তিনজনকে মেরে ফেলা কি বেশি হয়ে গেল না?’

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষ এখন কয়েকভাগে বিভক্ত। বেশিরভাগ মানুষ এই হামলার ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না। তাদের দাবি, জনরোষের দোহাই দিয়ে এই ঘটনাকে হালকা করার চেষ্টা হলেও মুরাদনগরে এসব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন।

মাসহ দুই সন্তান হত্যার ঘটনার একদিন আগে ২ জুলাই সরেজমিন মুরাদনগর ঘুরে দেখা যায়, পুরো উপজেলাজুড়েই একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই উপজেলায় প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ সম্মতিতে বিচারের নামে চলছে মব সন্ত্রাস। বিচারহীনতার এই ভয়াবহ চিত্র আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

মুরাদনগরের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা যায় মানুষের মধ্যে কোনো স্বস্তি নেই। ভিউজ বাংলাদেশের কথা হয় সবুর মিয়ার সঙ্গে, তার চোখে-মুখে ভয়, হতাশা এবং অজানা এক শঙ্কা। তিনি বলেন, ‘এখন আর গ্রামে বাস করতে ইচ্ছে করে না। এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নাই। চুরি-ডাকাতির ভয়ে রাতে ঘুমাতেও পারি না। আমার ঘরে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, সারাক্ষণ মনের মধ্যে ভয় কাজ করে, মেয়ে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত অস্থির লাগে।’

বসির আহম্মেদ নামে সিএনজি ড্রাইভার খুব আক্ষেপ করেই ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আপনারা তো একটা ঘটনার জন্য ঢাকা থেকে এসে নিউজ করে চলে যাবেন। যেসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় তা নিয়ে আপনারা লেখেন; কিন্তু যেসব ঘটনা ভাইরাল হয় না তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা হয় না।’

তিনি বলেন, ‘আমার সিএনজিতেই সাধারণ যাত্রীদের মধ্যেই তুচ্ছ কথায় প্রতিদিনই মারামারি-হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি না হলে দিন দিন এমন ঘটনা আরও বেড়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন সিএনজি চালাতেই ভয় করে, কে যে কখন কাকে ধরে, মারে বলা যায় না।’ এমন অরাজক পরিস্থিতি তিনি তার ৫৫ বছর বয়সে দেখেননি বলে জানান।

মুরাদনগরে গত সপ্তাহেও এক নারীকে মব সন্ত্রাস করে তার বিবস্ত্র ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে গণমাধ্যমে দুটি বড় ঘটনা প্রকাশ পেলেও স্থানীয়দের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার।

স্থানীয়রা বলেন, মুরাদনগর ঘুরে দেখলে এমন অনেক ঘটনার চিত্র চোখে পড়বে। এসব ঘটনার বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডে গড়ায় না কিংবা গণমাধ্যমে ভাইরাল হয় না। তবে স্থানীয়দের মধ্যে একধরনের অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

অনেকেই বলছেন, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে জমে থাকা রাজনৈতিক ক্ষোভ ও হতাশার যে পুঞ্জীভূত বিস্ফোরণ, সেটিই এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

এলাকাবাসী ও স্থানীয় বিশিষ্টজনরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়, বিচারহীনতা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতায় এই ক্ষোভ এখন জনরোষের রূপ নিচ্ছে।

এদিকে কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খানের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির বিষয়টি দেখছি। কেউ অপরাধী হলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া উচিত। এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিটি অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সাম্প্রতিক সারা দেশে মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৭২ জন মানুষ গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন। শুধু ২০২৫ সালের জুন মাসেই এ সংখ্যা ৫৭ জন। এরই ধারাবাহিকতায় মব সন্ত্রাসের নির্মম শিকার হয়েছে কুমিল্লার মুরাদনগরের এই পরিবারটি বলে জানান স্থানীয়রা।

পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ