Views Bangladesh Logo

ব্যুরোক্র্যাসি-ব্যারাম

Pabitra  Sarkar

পবিত্র সরকার

নেকদিন থেকেই বৃদ্ধের পাগলামিবশত এই লেখাটি লেখার ইচ্ছে হয়েছে, এটাকে অনেকে উটকো উপদেশমূলক লেখাও ভাবতে পারেন, আমার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। অধিকার আর কিছু নয়, লেখক এই দক্ষিণ এশিয়া নামক সাংস্কৃতিক অঞ্চলের অধিবাসী; দুই. মাস্টারিই তার জীবিকা ছিল, তাই মাস্টারিটা মজ্জাগত হয়ে গেছে; আর তিন, বয়সটাও হয়েছে। বাংলাদেশে বয়স্ক লোককে ‘মুরুব্বি’ বলে, আর মুরুব্বিদের নাকি একটা আলাদা সম্মান আছে। তাদের কথাও কম বয়সিদের শোনার কথা, বাস্তবে কতটা হয় জানি না। পৃথিবীর অনেক দেশে বয়স্কদের একটু বিশেষ নজরে দেখা হয়, গণতান্ত্রিক পাশ্চাত্যেও তারা দয়া-দাক্ষিণ্য পান। এই গেল লেখকের দিক থেকে অজুহাত।

পাঠকের দিক থেকে প্রশ্ন উঠবে, এই লেখা ঠিক কাদের জন্য, কে স্যার আপনার উদ্দিষ্ট পাঠক? আমার মতে, যিনি পড়বেন তিনিই পাঠক। এ লেখাটি যেহেতু সামাজিক ব্যবহারের বিষয়ে, তাই বাংলাভাষী সামাজিক মানুষই আমার লক্ষ্য। এ লেখাটির মূল বিষয় সমাজে আধিপত্য আর তার অনভিপ্রেত প্রকাশ। লেখক পাঠককে সে বিষয়ে সচেতন করতে চান। এ পাঠক মূলত লেখাপড়া করা মধ্যবিত্ত বলে ধরে নিচ্ছি। তার মধ্যে, হয়তো নিজের অগোচরে, অন্যের সঙ্গে ব্যবহারে ও কথাবার্তায় কিছু আধিপত্যের অবাঞ্ছিত প্রকাশ ঘটে, তার কথা প্রথমে বলব। তার পরে বলব, এর বিপরীতে কিছু সহযোগিতার কথা, যেগুলো লেখক অন্যত্র দেখেছে; কিন্তু আমাদের সমাজে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে।

অর্থাৎ লোকব্যবহারে ও ভাষাচারে আধিপত্যের হ্রাস ঘটিয়ে সহযোগিতা ও সহৃদয়তার বৃদ্ধিই এ লেখার উদ্দেশ্য। এতে পয়সা খরচের প্রশ্ন নেই, হয়তো একটু সময় খরচের প্রয়োজন হতে পারে, আর নিজের সম্বন্ধে অলীক বা অসংগত অহংকারও একটু ‘খরচ’ বা ত্যাগ করতে হতে পারে। এটা যে কোনো লেখাপড়া করা মধ্যবিত্ত- ছাত্র, সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক দলের কর্মী ইত্যাদি পড়বেন এই আমার প্রত্যাশা। বিশেষত পরিবারের বাইরে যাদের বৃহত্তর জনপরিসরে- হাটে-বাজারে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, নিজের অঞ্চলের বাইরে কাজ করতে বা কথাবার্তা বলতে হয়- আমাদের সবাইকে বলতে হয়- তারা পড়লে লেখক খুশি হবে। পড়ে কী করবেন তা তাদের সিদ্ধান্ত। ‘যত সব ফালতু বকবক’ বলে ভুলেও যেতে পারেন।

এমন নয় যে, এই কথাগুলো পরিবারে অন্যদের সঙ্গে আচরণে প্রাসঙ্গিক নয়। আমি জানি পরিবারেও ক্ষমতা ও আধিপত্যের একটা বিন্যাস থাকে, বাবা-মা বা অভিভাবক ছেলেমেয়েদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা ধরেন, অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর তুলনায় আধিপত্যের বেশি দাবিদার। তার প্রাকৃতিক, জৈবিক ও সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস ও কারণের মধ্যে আমি যাচ্ছি না। আমি শুধু বলব যে, ওই আধিপত্যের মাত্রা কমিয়ে যদি সহযোগিতা ও সহৃদয়তার মাত্রা একটু বাড়ানো যায় তার কথা।


এই সেবাদানের সঙ্গে শরীরী ভাষা যেমন জড়িত, তেমনি মুখের ভাষাও তার সহযোগী হয়। দুটিরই নেতিবাচক চেহারা প্রায়ই দেখা যায়, তাই আমরা একসঙ্গে দুটিরই আলোচনা করব। কথা বলার আগেই কিছু সৌজন্যের কথাটা হয়তো বলা দরকার। ব্যাংকে বা কোথাও আপনি একটা চলন-দরজা ঠেলে ঢুকবেন, কাচের ওপাশে দেখলেন আর-একজন আসছেন। আপনি কী করবেন? তার মুখের ওপর দরজা ঠেলে ঢুকে যাবেন, না কি দরজাটা টেনে ধরে তাকে আগে আসা বা যাওয়ার সুযোগ করে দেবেন? আমাদের মনে হয় দ্বিতীয়টাই উচিত। এটি বিদেশে শেখাতে হয় না; কিন্তু আমাদের দেশে মনে হয় লোককে মনে করিয়ে দেয়ার দরকার আছে। হিন্দিতে ‘আপ পহলে’ বলে একটা সৌজন্যের উচ্চারণ আছে, সেটা বাংলায় নেই। তা হোক, কাজটা দিয়ে কথা।

এমন হতেই পারে যে, আপনি যার জন্য দরজা খুলে ধরলেন তিনি ‘থ্যাংক ইউ’ বা ধন্যবাদ কিছুই বললেন না। কারণ তিনিও এই সমাজে আপনার মতো সৌজন্যে প্রস্তুত নন। আপনি তাতে হতাশ হবেন না, আপনার সুকর্মের পুরস্কার থেকে আপনি বঞ্চিত হলেন মনে করবেন না। সৌজন্য করেছেন এই বোধটাই আপনার পুরস্কার হোক। এখানে ভাষাবিজ্ঞানে ভাষাগত এক ধরনের শিষ্টাচারের একটা গুরুত্ব দিয়েছেন, আগেকার চেকোস্লোভাকিয়ার কিছু ভাষাবিজ্ঞানী। তারা এই প্রয়োগগুলোর নাম দিয়েছেন phatic communion, বাংলায় আমি বলি ‘সৌজন্য সম্ভাষণ’। এগুলো বড় কোনো খবর দেয় না, কোনো বিশেষ আবেগ প্রকাশ করে না, আলাদা কোনো সৌন্দর্যও নেই এই প্রয়োগগুলোর। না করলেও খুব একটা কিছু এসে যেত তা বোধ হয় নয়; কিন্তু এগুলো সামাজিক সংহতি নামক একটা অস্পষ্ট জিনিস বজায় রাখতে সাহায্য করে।

এগুলো ব্যবহার করে আমরা ভাবি যে, আমরা একই সভ্য সমাজের লোক, পরস্পরের প্রতি এই সৌজন্যটুকু দেখালে আমাদের সামাজিক অস্তিত্ব একটু সুন্দর না হোক, সুসহ হয়। এগুলো কী? না সকালে দেখা হলে যথাসম্ভব হাসিমুখে ‘গুড মর্নিং! হাউ আর ইউ দিস মর্নিং’ জাতীয় কিছু নিজের ভাষায় বলা। উত্তরে সম্ভাষিত লোকটিও ওই ফর্মুলা বাক্যগুলো যথাসম্ভব হাসিমুখে এভাবে ফিরিয়ে দেবেন, ‘গুড মর্নিং! আই এম ফাইন, থ্যাংক ইউ! অ্যান্ড হাউ অ্যাবাউট ইউ?’ তখন প্রথম বক্তা বলবেন, ‘থ্যাংক ইউ, আই এম ফাইন টু!’ এই সব সংলাপ নেহাতই আচারিক, এর উত্তরে, খুব বাধ্য না হলে কেউ বলে না যা, ‘আর বলবেন না, আমার স্ত্রীর হাতটা রান্নার কড়াইয়ের তেল পড়ে পুড়ে গেছে, ফলে খুব বিপদের মধ্যে আছি!’ বাংলাদেশে গিয়ে দেখেছি, চেনা হোক, অচেনা হোক, প্রায়ই কেউ রাস্তায় বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে ঘাবড়ে দিতেন, আমরা অপ্রস্তুত থাকতাম বলে, ‘ওয়াআলাইকুম আসসালাম’ বলার আগেই সম্ভাষণকর্তা অনেকে দূরে চলে যেতেন।

এখানে আমার এই একটি সমালোচনা হতেই পারে যে, আমি পশ্চিমি কেতায় মুগ্ধ, এবং তারই কিছু আমাদের দেশের জীবনাচরণে আমদানি করবার চেষ্টা করছি। পাশ্চাত্যের সামাজিক আদানপ্রদানে ‘থ্যাংক ইউ’, ‘ডাংকেন্’, ‘মেয়ারসি বোকু’, ‘স্পাসিভা’ ইত্যাদি বুলি এত মুড়িমুড়কির মতো শোনা যায় যে আমাদের সমাজে তা বাতিকগ্রস্তদের বাড়াবাড়ি বলে মনে হতে পারে। পরিবারেও থ্যাংক ইউর ফুলঝুরি ছোটে। পাশ্চাত্যে শুধু নয়, জাপানেও ‘আরিগাতো গোদাইমাৎসু’ শুনে শুনে ক্লান্ত হবেন। এই বৃদ্ধের কাছে মনে হয়, এই বাড়াবাড়িটাও ভালো। ইংরেজি ‘থ্যাংক ইউ’ শব্দ দুটিই বলতেই হবে তার কোনো মানে নেই। বাংলায় অনেকদিন থেকেই ‘ধন্যবাদ’ কথাটা চলছে, বেশ ভালো শোনায় কথাটা। কে তৈরি করেছিলেন জানি না; কিন্তু বেশ ভালো তৈরি করেছিলেন। হিন্দিতে ‘আপকা বধাই হো’-ও বেশ চলে। ধন্যবাদ বলতে সংকোচ হয় তো, ‘উপকার হলো’, বাংলাদেশের মতো ‘ভালো থাকুন’ ইত্যাদি কত কথাই বলা যায়। অবশ্যই হাসিমুখে। বিরস মুখের সঙ্গে কথাটা ভালো যায় না।

পশ্চিমা কেতার আপত্তিটা খুব শক্তিশালী কি না ভেবে দেখতে বলি। পশ্চিমের কত কিছু আমরা নিয়েছি, ভাষা, পোশাক, খাদ্য ইত্যাদির তালিকা আমি করতে যাব না। শুধু বলি, এটুকু নিলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। একটা অসুবিধে সম্ভবত আমাদের সমাজেই ছিল। আমাদের হিন্দু সমাজ এত জাতপাতে ভাগ করা ছিল যে, আমাদের সমাজে গণতান্ত্রিক বা সমদর্শী আচরণবিধি এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। সমাজের অসম বিকাশ বা উন্নয়নও এর জন্য দায়ী। এখনো নানা এলাকায় তা বেরিয়ে পড়ে, দলিতদের বেলায় তো বটেই, অন্য ধর্মের লোক হলে, আদিবাসী হলে তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। তার ওপর শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষা এসে ‘শিক্ষিত’ ও তথাকথিত ‘অশিক্ষিত’-এর নতুন জাত তৈরি করেছে, গ্রামীণ আর নাগরিকের মধ্যেও পুরো তফাত ঘোচেনি। ফলে আমাদের মানসিকতা আর আচরণবিধির মধ্যে আধিপত্য আর কুলীন-মনোভাবের নানা পরম্পরার একটা অধোগঠন বা underlying structure থেকেই গেছে, যার থেকে আমরা পুরোপুরি এখনো মুক্ত হতে পারিনি। পথে ঘাটে হাটে-বাজারে গেলে তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের এই ‘সুপিরিয়রিটি’র দম্ভ প্রায়ই চোখে পাড়ে, বিশেষত তলার মানুষদের সঙ্গে আলাপে।

সে সম্বন্ধে আমি আগে লিখেওছি। যেমন আমাদের বাজারের সবজি-বিক্রেতা লিয়াকত তার পসরায় টমেটোর প্রশংসা করায় এক বাবু ক্রেতা তাকে জানান যে, তিনি ১০ বছর নরওয়েতে ছিলেন, কাজেই ভালো টমেটো কাকে বলে তা যেন লিয়াকত তাকে দেখাতে না আসে। এ এক ধরনের আধিপত্য বলেই এ অধমের মনে হয়। এটা এক ধরনের ‘জান তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ’ বলার ব্যাধি, যার কথা আমি এখানেই বুদ্ধিজীবীদের কথা বলতে গিয়ে লিখেছি। আমাদের ভাষাতেও ‘আপনি-তুমি-তুই’-এর স্তরভেদ এই সামাজিক বিচ্ছেদের সঙ্গে সংগত করেছে। এই লেখায় আমাদের আবেদন শুধু সেখান থেকে বেরিয়ে আসার। অনেকে বিষয়টি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন, অনেকে পারেননি। সামন্ততন্ত্র পৃথিবীর আদি ব্যুরোক্র্যাসি তৈরি করে, আমাদের জাতপাতের মধ্যে সেই ব্যুরোক্র্যাসির চিহ্নগুলো তীব্রভাবে টিকে আছে। আর অর্থনীতি, লেখাপড়া, ধর্মের নানা বিচ্ছেদকে আমরা ওই জাতপাতের ব্যুরোক্র্যাসির মধ্যা চমৎকার ‘ফিট’ করে নিয়েছি।


কেউ কোনো কাজের জন্য আপনার অফিসে আপনার কাছে এলো, তখন আপনার শরীরের ভাষা কী হবে? আপনি কি মন দিয়ে কান খোঁচাতে থাকবেন আঙুল দিয়ে? পা বা হাঁটু নাচাতে থাকবেন? ভুঁড়ি চুলকাবেন, মন দিয়ে হাই তুলবেন এবং তার পরে হাই চেপে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কী চাই?’ আপনি কতক্ষণ পরে তার দিকে তাকাচ্ছেন তার একটা মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিত বা মূল্য আছে। আপনি সেবা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত, মাইনে পান হয়তো গ্রাহকদেরই (অবশ্যই আপনার নিজেরও) ট্যাক্সের টাকায়। অন্যরা আপনার গ্রাহক। গ্রাহকরা কি আপনার কাছে ‘অপর’ হবে? এই গ্রাহককে আপনি কতটা পাত্তা দিচ্ছেন, তা আপনার তাকানোর সময় ও চরিত্রের ওপর নির্ভর করে। শরীরী ভাষ্য আর ভাষার ওপরেও। উদাসীন বা বিরক্ত বা বিপন্ন ‘কী চাই’ না বলে আপনি ‘বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি? বা বিদেশিদের মতো ‘Can I help you?’ বলবেন কি?

নানা অফিসে, বিশেষত সরকারি অফিসে, প্রায়ই দেখা যায় যে (এখন অবস্থাটার কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে বলে আমি মনে করি না), সেবাকর্মী গ্রাহক এলে বেশ বিরক্ত হন, ‘বেশ ছিলাম, এই আবার এক উৎপাত এসে জুটলো! এখন চেয়ার ছেড়ে উঠতে হবে, এর ফাইল খুঁজতে হবে, নানান ভ্যান তাড়া করতে হবে। অত ঝক্কি পোষায়?’ এর সঙ্গে ভাষিক আচরণও পরিচিত, ‘আপনার ফাইলটা খুঁজতে হবে। দু-দিন পরে আসুন।’ জানি না, এ সব ছবি আমাদের সামাজিক ইতিহাসে বাতিল হয়ে গেছে কি না।

আজই (২৮.০৭.২০২৫) জনপ্রিয়তম বাংলা পত্রিকার দ্বিতীয় সম্পাদকীয়তে পড়লাম যে, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর স্বামীনাথন জে দুঃখপ্রকাশ করেছেন এই বলে যে, ভারতীয় ব্যাংক-পরিসেবার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হল ব্যাংককর্মীদের ‘সহানুভূতির অভাব’। এটা শুধু ব্যাংক-কর্মীদের নয়, অনেক সরকারি কর্মচারী সম্বন্ধে এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাতে যে কোনো ধরনের সরকারি অফিস (মহাকরণ, আদালত, ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স, ডাকঘর, ব্যাংক, পঞ্চায়েত, জমি বা সম্পত্তির কেনাবেচা, মিউনিসিপ্যালিটি বা করপোরেশন, পর্যটন ও নানা অনুসন্ধান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর ইত্যাদি) এই সহানুভূতিহীনতার দ্বারা চিহ্নিত। বৃদ্ধ বা নিরক্ষর বা গ্রামীণ মানুষও সেখানকার এই সহানুভূতিহীনতা থেকে রেহাই পায় না- এটাই ব্যাপক অভিজ্ঞতা আর ধারণা। ব্যাংকের কথাটা বিশেষভাবে মনে আসে এই কারণে যে, আমাদের পৃথিবীর বড়লোক দু-একটা দেশে ব্যাংকের অভিজ্ঞতা আছে। সেখানে একাধিক জানালা থাকে, একই কাজের জন্য।

আমি এদেশে আমাদের পাড়ার ব্যাংকে দেখি জানালা অনেক আছে, ওদেশের ব্যাংকের মতোই; কিন্তু একটি বা দুটি জানালায় টাকার আদান-প্রদান হচ্ছে, সেখানে বড় লাইন, আর অন্য বেশ কিছু জানালায় লোকজন বসে আছে, বা লোক নেই। বিদেশে একটা জানালায় লাইন বড় হয়ে গেলে কম ভিড়ের জানালা থেকে ডাকাডাকি করত, ‘আমার জানালায় চলে আসুন !’ আর হাসিমুখের একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের এখানে সার্ভিস সেক্টরে তার বড় অভাব দেখি। হাসতে বিশেষ পয়সা খরচ নেই, সৌজন্যেও খুব পয়সা খরচ হয় বলে জানি না। ‘সার্ভিস উইথ আ স্মাইল’ এখানে যেন একটা নিষিদ্ধ কথা, সবাই ভয়ানক বিব্রত আর গম্ভীর। ‘সুপিরিয়র’ যদি নাও হয়। একটু গল্পের অবকাশ করে নিয়ে বলি, বিদেশেও সবাই যে সব সময় হাসিমুখে জনসংযোগের কাজ করেন এমন দাবি আমি করি না; কিন্তু অন্যরা প্রস্তুত থাকেন একটু হাসি আনার। একবার বিদেশে একটি বাসের কন্ডাক্টর কোনো টার্মিনাসে কমবেশি বৃদ্ধ যাত্রীরা নামতে দেরি করছিলেন বলে তাড়া দিচ্ছিলেন, ‘হারি আপ, হারি আপ!’ বলে।

তখন এক জবুথবু বৃদ্ধাই তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ক্যান ইউ সি দ্যাট উইথ আ স্মাইল!’ তখন কন্ডাক্টরটি অপ্রস্তুত হয়ে তার ঠোঁট খউলে দন্তপঙ্ক্তি উন্মোচিত করে বলল, ‘লুক, লেডি, আই এম স্মাইলিং!’ ‘সুপিরিয়র’ লোকজন প্রচুর দেখি চাকরির ইন্টারভিউতে। বিশেষ করে তথাকথিত সার্ভিস কমিশনগুলোতে, অধ্যাপক ইত্যাদিদের মধ্যে, যেখানে ভারিক্কি লোকেরা কাদের চাকরি দেবেন না তা আগেই ঠিক করে আসেন এবং তাদের অবান্তর প্রশ্ন করে কাঁদিয়ে ছাড়েন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকের ইন্টারভিউতে হয়তো যে মধ্যযুগের বিশেষজ্ঞ তাকে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হল, আবার যে আধুনিক কবিতা নিয়ে ডক্টরেট করেছে তাকে জ্ঞানদাসের পদাবলি নিয়ে। কেউ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অপক্ষপাত দেখান, কেউ বিশেষ শিক্ষককে নিয়ে বিদ্রুপ করেন। এখানে আমি নেপথ্যের আদান-প্রদানের তিক্ত বিষয়ে যেতে চাই না- টাকা, শাড়ি, অলংকারের গল্প পশ্চিম বাংলায় (ভারতের অন্যত্রও) এতই মহামারির আকার নিয়েছে যে তা নিয়ে কেউ মহাকাব্য লিখতেই পারে।


শেষে আবার বলি, ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে, সবাই একই দোষ বা অক্ষমতা বা অসহায়তায় ভুগছেন তা বলা মূর্খামি হবে। কেউ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেন গ্রাহক বন্ধু হওয়ার। এই হল একটা কথা। দুই, সব জায়গায় সরকারের কর্মী সংকোচন নীতি চালু হয়েছে আমি জানি, ব্যাংকগুলোতে কর্মীসংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমিয়ে আনা হয়েছে, হয়তো সরকারি সব ক্ষেত্রেই। কাজের বিপুল কাজের ভারে সরকারি কর্মীরা ভারাক্রান্ত। তাদের প্রতি আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। তারা অনেকেই প্রগতিশীল চিন্তা করেন, মানুষের কথা ভাবেন। তাই ব্যতিক্রমও আছে, আমিও হঠাৎ-হঠাৎ সহায়তা পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি। তবু ব্যুরোক্র্যাসির দুর্নাম কেন এখনো টিকে আছে তা নিয়ে ভাবতে হবে। আর হ্যাঁ, এ লেখা, যতই অনধিকারচর্চা হোক, রাজনৈতিক ব্যুরোক্র্যাসিকেও লক্ষ করে। নেতানেত্রী শুধু নয়, পার্টির সাধারণ কর্মীদের মধ্যও ব্যুরোক্র্যাসির ব্যারাম চলে আসতে পারে, অন্যদের দেখাদেখি। অন্যান্য ব্যাধিও। আমি জানি, পৃথিবীর অবস্থা ভালো নয়। তবে যারা সেবাকর্মী, তাদের হাসিমুখের জন্য প্রার্থনা রইল। রবীন্দ্রনাথই আমাদের ‘প্রাণপণ হাসিমুখ’ বলে একটা কথা বাংলাভাষায় দিয়ে গেছেন।

পবিত্র সরকার: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক, নাট্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ