আড়াইশ কোটি টাকা ঋণের বোঝা ২২ দিনমজুরের ঘাড়ে!
কখনো ব্যাংকেই যাননি, ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে নেই তাদের কোনো ধারণা। পড়াশোনা না থাকায় ঠিকমতো স্বাক্ষর করতেও কষ্ট হয় অনেকের। দিন এনে দিন খেতে হয়, কখনো নুন আনতে পানতা ফুরায়। অথচ তাদের নামেই ইউসিবি ব্যাংকে আছে আড়াইশ কোটি টাকার ঋণ। কে নিল এই ঋণ তাদের নামে? কীভাবেই বা নেয়া হলো? সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। তার আগেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শেষ হচ্ছে পরিবারগুলো। এমনকি স্ট্রোক করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে চা দোকানে, কারও কাছ থেকে গোপন আস্তানায় সই নেয়া হয়েছে। কিসে সই নেয়া হচ্ছে তা দেখারও সুযোগ দেয়া হয়নি। বিনিময়ে অল্প কিছু টাকা দিয়ে খুশি করা হয়েছে। সই নেয়ার সময় বলা হয়, কোনো সমস্যাই হবে না। একটি প্রকল্প থেকে তোমাদের জন্য সাহায্য এসেছে। ব্যস এরপর তাদের নামেই নেয়া হয় আড়াইশ কোটি টাকা ঋণ। কারও নামে সাত কোটি, কারও নামে ১০ কোটি। এখন সুদে আসলে সেসব হয়েছে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। ব্যাংকের নোটিশ পেয়ে অনেকেই দিশেহারা, হতবিহ্বল। অথচ এত টাকা জীবনে চোখেও দেখেননি তারা।
একটি সূত্র জানিয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এ চক্রের মূল হোতা। গরিব মানুষদের দিয়ে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন জাবেদ। নিজে আড়ালে থেকে একটি চক্র দিয়েই তিনি কাজ করান। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তারাসহ প্রায় সবাই জাবেদের ঘনিষ্ঠ। সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের রামুর ঈদগড় এলাকার হতদরিদ্র মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করেন আবুল কালাম নামে এক ব্যক্তি। তবে পরে জানা গেল তিনি সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের লোক। তার নির্দেশেই তিনি এসব সই আদায় করেন। বাকি কাজ হয়েছে ইউসিবি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায়।
কক্সবাজারের গর্জনিয়ার মিজানুর রহমান ২০২৩ সালে কয়েক কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের নোটিশ পেয়ে স্ট্রোক করে মারা যান। এরপর থেকে পাহাড়ে একটি কুঁড়ে ঘরে তিন সন্তানকে নিয়ে চরম কষ্টে পড়েছেন তার স্ত্রী। তার স্ত্রী জানান, স্বামীর আইডি কার্ড নিয়ে ৩ মাস পর ফেরত দেয়া হয়। ব্যাংকের নোটিশ পেয়ে তিনি স্ট্রোক করে মারা যান।
একইভাবে কক্সবাজারের ঈদগড়ের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন জীর্ণশীর্ণ একটি ঘরে। দিন এনে দিন খাওয়াই যার জন্য মুশকিল, সেই তিনিই শিকার হয়েছেন বড় এক প্রতারণার। আমাদের হাতে আসা একটি কাগজে লেখা রয়েছে, নুরুল ইসলাম ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি ঋণ নিয়েছেন; কিন্তু এই ঋণ সম্পর্কে কোনোভাবেই অবগত নন তিনি।
কিছুদিন আগে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চট্টগ্রামের চকবাজার শাখা থেকে তার কাছে আসে একাধিক নোটিশ। এ সময় তিনি জানতে পারেন, কয়েক দফায় ওই ব্যাংক থেকে এই ঋণ নেয়া হয়েছে। তাকে দেখানো হয়েছে চট্টগ্রামের ইসলাম ট্রেডার্স এবং পটিয়ার কিছু জমির মালিক হিসেবে। ভুক্তভোগী নুরুল ইসলাম বলেন, করোনার সময় অনুদান দিবে বলে আমার কাছ থেকে এনআইডি নিয়েছিল। বলেছিল, চাল-ডাল ছাড়াও অন্যান্য জিনিস দেবে। আমি কখনো ব্যাংকেই যাইনি, তাহলে এত টাকা ঋণ নিলাম কীভাবে?
ইসলামের মতো শাহজাহান, মোহাম্মদ তৈয়ব, জহিরুল ইসলামসহ রামুর ঈদগড় এবং নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর অন্তত ২২ জনের নামে শাখাটি থেকে ঋণ মঞ্জুর দেখানো হয় প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। অথচ এসব ব্যক্তি জানেনই না ঋণের বিষয়ে। তাদের সবাই দিনমজুর বা শ্রমিক, যারা ঠিকমতো স্বাক্ষরও করতে পারেন না।
ঈদগড়ের স্থানীয়রা জানান, ২০২০ সালে করোনাকারে সহযোগিতার কথা বলে স্থানীয় মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি তাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নেন। ১ মাস পর চট্টগ্রামের পটিয়ায় গিয়ে সাহায্যের জন্য সই দেন তারা। পরে ব্যাংক ঋণের নোটিশ আসা শুরু হলে জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পারেন। একই অবস্থা নাইক্ষংছড়ির বাইশারীর ভুক্তভোগীদেরও। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে নুরুর বশর নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়া হয়। তারাও বলেছেন, পটিয়ায় নিয়ে তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয়া কাগজগুলো ইংরেজিতে লেখা। পরে ২০, ৪০ হাজার করে সাহায্য দিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে জানতে পারেন স্বৈরাচার সরকারের মন্ত্রীদের কারসাজি ছিল এটা। এখন কারও কারও নামে মামলাও করেছে ব্যাংক। সবাই এখন ঋণের জালে ফেঁসে গেছেন।
মিজানুর রহমান ও নুরুল বশরের মাধ্যমে জালিয়াতি করানো হলেও তারাও ফেঁসে গেছেন ঋণের ফাঁদে। আবুল কালাম রামুর ঈদগড়ের বাসিন্দা ও নুরুল বশরের ভগ্নিপতি। আবুল কালাম দীর্ঘদিন পটিয়ায় থাকার কারণে তার সঙ্গে পরিচয় হয় প্রতারক চক্রের সদস্য মোস্তফিজুর রহমান, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের সঙ্গে। তারা মিলে এই দুজনকেও ফাঁসিয়ে দেন ঋণের জালে। প্রতারণার শিকার মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আবুল কালাম আমাকে বলেন কয়েকটি এনআইডি কালেকশন করো, আমরা বাইরে থেকে এনে সস্তায় আর্থিক অনুদান দেব। আর নুরুল বশর জানান, সাদা এবং নীল রঙের দুটি কাগজে তাদের কাছ থেকে সই নেয়া হয়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, বিভিন্নজন পলাতক, দুশ্চিন্তায় আছেন। অনেকে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পরিবার আছে চরম কষ্টে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। অসহায় মানুষগুলো মৃত্যুর মুখে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতারক নুরুল আনোয়ার, আবুল কালাম, শাহজাহান, মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি পটিয়ায় হলেও তাদের অফিস ছিল নগরের নন্দনকানের জে কে টাওয়ারে। তবে সম্প্রতি তারা সেখান থেকে অফিস সরিয়ে নিয়েছেন তিন পোলের মাথা এলাকার বিঅ্যান্ডবি টাওয়ারে। সেখানে কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করেননি। তবে দুজন নিরাপত্তারক্ষীকে দেখা যায় সেখানে। তারা জানান, ব্যাংকের বিভিন্ন লেনদেন করত, তারা এখান থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্ট নিয়ে আসা-যাওয়া করতেন সবসময়।
তবে এখন কোথায় আছেন জানেন না। নোটিশ আসা ইউসিবি চকবাজার শাখায় গেলে সেখানের ম্যানেজার জানান তিনি কিছুদিন আগে নতুন যোগদান করেছেন। এ জন্য তিনি অপারেশন ম্যানেজারকে ডেকে পাঠান। তিনি জানান, খেলাপি ঋণের জন্য তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে। কীভাবে গরিব মানুষগুলো এত বিশাল অঙ্কের ঋণ পেল সেটির কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ব্যাংক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তারা হেড অফিসের নির্দেশনায় কাজ করেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে