মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড
ইটখোলার অগভীর গর্তে ক্ষতবিক্ষত সেলিনা পারভীন
ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠের রায়েরবাজার এলাকাটি ছিল বেশ নির্জন। নদী তীরবর্তী নিচু জলাভূমি। শুষ্ক মৌসুমে এই এলাকাতে একাধিক ইটভাটা চালু থাকত। যা ঢাকাবাসীর কাছে পরিচিত ছিল ইটখোলা নামে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম একটি পরিত্যক্ত ইটভাটার অগভীর পুকুরের মতো গোলাকার গর্তে আবিষ্কৃত হয়েছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মরদেহ। বুলেটে ক্ষতবিক্ষত বুক-পিঠ, পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেঁতলানো, গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া, বেয়োনেটের গভীর গর্ত, আধা গলিত এই মরদেহগুলো ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার আলোকিতজনদের।
রায়েরবাজারের ওই জলাভূমিতে এই মরদেহগুলোর খোঁজ পাওয়া যায় বিজয়ের উৎসবের ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকার বাতাসে তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় আনন্দের রেণু। যাদের স্বজনেরা কয়েকদিন ধরেই নিখোঁজ, সেই পরিবারগুলোর সদস্যরা ছুটে যান প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করতে। নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত, আধা গলিত মরদেহগুলো শনাক্ত করতে খুব বেগ পেতে হয়। তবে একটি মরদেহ সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছিল। সেটি ছিল সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের।
সাহিত্য পত্রিকা ‘শিলালিপি’র সম্পাদক ছিলেন শহীদ সেলিনা পারভীন। তবে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায় তিনি অনেক আগেই যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন নাগরিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির অধিকার প্রশ্নে তাঁর ছিল আপসহীন অবস্থান। ‘শিলালিপি’র আগে সেলিনা পারভীন যুক্ত ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ললনা’র সঙ্গে। নারী বিষয়ক এই সাপ্তাহিকটির সম্পাদক ছিলেন মুহাম্মদ আখতার। সেলিনা পারভীন এই পত্রিকার প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। একইসঙ্গে পত্রিকাটির বাণিজ্যিক তথা বিজ্ঞাপন বিভাগের দেখভালের দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর। ১৯৭১ সালে ‘ললনা’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় সেলিনা পারভীন ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁর নিজের পত্রিকা ‘শিলালিপি’ নিয়ে।
এদিকে একইসঙ্গে অবরুদ্ধ ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা শুরু করেন তিনি। ঢাকার গেরিলা ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অর্থ, আশ্রয়, খাদ্য, শীতবস্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিতেন। অন্যদিকে বাঙালি জাতির মুক্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন, অনেকটা প্রকাশ্য। যে কারণেই বিপদে পড়তে হয় তাঁকে। মূল্য চুকাতে হয় প্রাণ দিয়ে।
সেলিনা পারভীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ঘাতক রাও ফারমান আলীর নজরে পড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে কোনো ধরনের প্রকাশনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর অনুমোদন প্রয়োজন হতো। ‘শিলালিপি’র জন্য এই অনুমোদন আনতে গিয়ে তিনি পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েন। ‘শিলালিপি’ পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অন্যান্য কাজে গ্রামীণ বাংলার অলংকার ব্যবহার করা হতো, যা পছন্দ ছিল না অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফারমান আলীর। রাও ফারমান আলী বাঙালিয়ানা বাদ দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় পত্রিকাটি প্রকাশের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে সেলিনা পারভীন তা মানেননি। তিনি নিজের মতো করেই পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
‘শিলালিপি’র শেষ সংখ্যায় প্রস্তাবিত প্রচ্ছদ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে পরিকল্পিত ‘শিলালিপি’র সেই সংখ্যাটি আর প্রকাশ করা হয়নি সেলিনা পারভীনের। তার আগেই ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁকে।
পরাজয়ের প্রাক্কালে হিংস্র হানাদাররা দেশি দোসর আল-বদর বাহিনীর সহায়তায় নিউ সার্কুলার রোডের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় সেলিনা পারভীনকে। ওই সময় একটি মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকা শহর থেকে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিচ্ছিল আল-বদর বাহিনী। সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিখ্যাত নারী অধিকার কর্মী মালেকা বেগম তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন—
“১৩ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কয়েকজন এসে বলল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে, যেতে হবে। সুমন (সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে) তখন ৮ বছর বয়সী ছিল। সব স্মরণ আছে তার। সে বলে, তেল মাখিয়ে মা তাকে মামার সঙ্গে ছাদে পাঠিয়ে মেঝোয় বসে রান্না করছিলেন। বললেন পরে যাবেন কারফিউ শেষ হোক। ওরা সুযোগ দিল না। সুমন চেয়েছিল সঙ্গে যেতে। অনুমতি মেলেনি।”
সেলিনা পারভীনের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের আরেকটি চিত্র পাওয়া যায় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বরের সেই বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষ্য প্রকাশিত হয়েছে সেলিনা পারভীনের সন্তান সুমন জাহিদের ভাষ্যে। তিনি নিজের চোখে তাঁর মাকে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন। সুমন জাহিদ লিখেছেন— “আমি মাকে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকি, অনেকটা ঝাপসাভাবে। মা রান্নার সময় কোমরে একটা গামছা ঝুলিয়ে রাখতেন ময়লা হাত মোছার জন্য। ওরা মার কোমর থেকে সেই গামছাটা নিয়ে নিল। তারপর চোখ বেঁধে দিল। হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে দিল।”
(পৃষ্ঠা: ৪৪৭, শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ)
এখানেই তিনি উল্লেখ করেছেন—“১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মাকে বাসা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁকে অনেক নির্যাতন করা হয়। যা আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৩৫ বছর পর জানতে পেরেছি। এই ঘটনা আমি মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। তাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার মায়ের মৃত্যুর কারণে তিনি বেঁচে যান। পেছন থেকে হাত খুলে, চোখ খুলে দৌড়ে পালান তিনি।”
ঘাতকদের সঙ্গে যাওয়ার সময় চার বছরের ছেলে সুমনকে বলে গিয়েছিলেন কাজ শেষ করে দ্রুতই ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁর আর ফেরা হয়নি। বিজয়ের উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে থাকে তাঁর নিথর দেহ। প্রাণহীন দেহটির শেষ আশ্রয় হয় রায়েরবাজারের ইটখোলার বধ্যভূমিতে। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা জুতা আর মোজা থাকায় খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হয় এই শহীদকে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে