Views Bangladesh Logo

রাজনীতিতে একা হয়ে পড়েছে বিএনপি!

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে থেকেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন অনেকটাই একা। নেতৃত্বের অস্থিরতা, ধারাবাহিক আন্দোলনের ব্যর্থতা, জোট রাজনীতির ভাঙন আর আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রান্তিক অবস্থান- সব মিলিয়ে দলটি কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় এ একাকীত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিভাজন
১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামী দল পাঁচ দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। তাদের মূল দাবি ছিল প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন। ইসলামপন্থি দলগুলো মনে করছে, এই ব্যবস্থায় সব দলের জন্য সংসদে জায়গা পাওয়া সহজ হবে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রে ভারসাম্য আসবে।
কিন্তু বিএনপি শুরু থেকেই এই দাবির বিরোধিতা করে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা ধরে রাখতে চাইছে, আর ইসলামী দলগুলো সংসদে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। এ কারণে বিরোধী রাজনীতির ভেতরেই তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের বিভাজন।

অন্যদিকে, যেসব দল আজ পিআর পদ্ধতির দাবিতে রাজপথে নেমেছে তারা গত দুই দশক ধরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল। শুধু সেই জোটে থাকার জন্যই তাদের নেতাকর্মীদের নানা নির্যাতন সইতে হয়েছে। অথচ আজ তারা বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে।

রাজনীতির নতুন অধ্যায়
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতন দেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনে।
এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন। এজন্য একাধিক কমিশন গঠন করা হয়- যেমন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, দুর্নীতি তদন্ত, প্রশাসন সংস্কার, গুম-খুন তদন্ত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা।

আওয়ামী লীগের পতনের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হলেও বিএনপির জন্য পরিস্থিতি উল্টো হয়ে দাঁড়ায়। কারণ পরিবর্তনের প্রধান শক্তি হিসেবে তারা জনমানসে জায়গা করে নিতে পারেনি।

জোট রাজনীতির ভাঙন
একসময় বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল ২০ দলীয় জোট; কিন্তু এখন সেই জোট কার্যত অকার্যকর। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন আলাদা পথ ধরেছে, ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও টেকেনি।
আওয়ামী লীগের পতনের পর জামায়াত আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে। ইউনিয়নভিত্তিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে তারা নতুন করে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির ঐতিহ্যগত গ্রামীণ ভোটব্যাংকের বড় অংশ এখন জামায়াতের দিকে সরে যাচ্ছে। ফলে বিএনপি কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই নয়, জামায়াতের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় পড়ছে।

নতুন শক্তির উত্থান

শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক পরিসরে উঠে এসেছে নতুন কিছু দল ও জোট- যেমন গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, এনসিপি এবং বিভিন্ন বাম দল। সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর রাজনীতি ও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে তারা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মও তাদের দিকে ঝুঁকছে। এতে বিএনপির জায়গা আরও সংকুচিত হচ্ছে।

আন্দোলনের ধারাবাহিক ব্যর্থতা
আওয়ামী লীগের পতনের আগেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল বড় উদ্যোগ; কিন্তু রাজপথে তারা প্রত্যাশিত শক্তি দেখাতে পারেনি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নেতৃত্বের অস্পষ্টতা, দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো, ধারাবাহিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে না পারা এবং পুলিশের কঠোর দমননীতিই মূল কারণ। এতে জনগণের মধ্যে ধারণা গড়ে ওঠে- ‘বিএনপি ঘোষণা দেয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারে না।’ তরুণরাও হতাশ হয়। শেখ হাসিনার পতনের পরও সেই ব্যর্থতার ছাপ রয়ে গেছে দলটিতে।

লন্ডনের নির্দেশ বনাম রাজপথের বাস্তবতা
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, কার্যত রাজনীতির বাইরে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; কিন্তু রাজপথের নেতাদের অভিযোগ, তার নির্দেশ অনেক সময় দেরিতে আসে এবং বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না।

ফলে আন্দোলন গতি পায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের উন্মুক্ত পরিবেশেও বিএনপি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক কিছুটা কমলেও সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটেনি।

আন্তর্জাতিক সমীকরণে ‘প্রান্তিক’ বিএনপি

৫ আগস্টের পর আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক সংস্কারকে স্বাগত জানিয়েছে। ভারত নীরব ভূমিকা নিলেও চীন-রাশিয়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।

কিন্তু বিএনপি কার্যকর কোনো লবিং করতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দৃশ্যমান কূটনৈতিক পদক্ষেপও নেই। মনে করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণে বিএনপি প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। ফলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণেও তারা প্রভাব ফেলতে পারছে না।

অর্থনীতি ও জনগণের প্রত্যাশা

বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সংকটে। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বেকারত্ব আর প্রবাসী আয়ের ভাটা- সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিলেও সংকট কাটেনি।
জনগণ পরিবর্তন চাইছে; কিন্তু বিএনপি এই অসন্তোষকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারছে না।

নির্বাচনি মাঠে অনিশ্চয়তা
২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। তবে বিএনপি এখনো সুস্পষ্ট কৌশল জানায়নি। তারা দ্বিধায় আছে- একা লড়বে, নাকি জোট করবে? জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে? পিআর পদ্ধতি নিয়ে আপস করবে কি না?

২০১৪ সালের মতো বর্জন করলে তারা দুর্বল হবে, আর ২০১৮ সালের মতো অংশ নিলে কারচুপির অভিযোগ আসতে পারে- সেসব অনিশ্চয়তা রয়েছে দলটিতে।

ভাবমূর্তির সংকট: মিটফোর্ড থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

একসময় বিএনপি ছিল প্রান্তিক জনগণের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি; কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পরও সেই জায়গা ধরে রাখতে পারেনি দলটি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী সংকট, শহুরে মধ্যবিত্ত ও তরুণ ভোটারদের আস্থা হারানো, আবার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ- সব মিলিয়ে বিএনপি এখন ভাবমূর্তির বড় সংকটে।

মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড এ সংকটকে আরও তীব্র করেছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবি দেখিয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়েও বিএনপির প্রতি আস্থা কমছে। সারা দেশে দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা লুটপাট ও চাঁদাবাজির অভিযোগ এ ফলাফলে সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো কৌশলগত অস্পষ্টতা। তারা আন্দোলন করতে পারে না, নির্বাচনে অংশ নিলে হেরে যায়। জনগণ স্পষ্ট রোডম্যাপ না দেখে বিকল্প খুঁজছে। এক বিশ্লেষক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে বিএনপি জামায়াত ও নতুন শক্তির কাছে প্রান্তিক হয়ে পড়বে।’

বিএনপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপি রাজনীতিতে একা হয়ে পড়েছে- এমন দাবি নাকচ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি মনে করেন, তাদের একা প্রমাণ করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে কিছু মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। যদিও তিনি সরাসরি নাম নেননি, তবে জামায়াত-শিবির ও এনসিপিকে দায়ী করেছেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ