বাংলার বারুদে ইউরোপে লড়াই
পূবের সূর্য যখন অস্ত যায়, পশ্চিমের আকাশ তখন রেঙে ওঠে ভোরের আলোয়। আজ পশ্চিমা অস্ত্রে মধ্যপ্রাচ্য কাঁপছে, ওয়াঘার দুপ্রান্তে বিদেশি বিমান কিংবা ড্রোনের আঘাতে জ্বলছে সাবেক ভারতের দুটি অংশ। অথচ সেকালের ভারত কিংবা মধ্যযুগের বাংলার অস্ত্রে কেঁপে উঠেছিল ইউরোপের মাটি।
কী সেই অস্ত্র? ডাক নাম শোরা, যার মূল উপাদান পটাশিয়াম নাইট্রেট- গোলাবারুদের মূল উপাদান। এর সবচেয়ে বড় জোগানদার ছিল বাংলার ব্যবসায়ীরা।
বাংলায় তথা গোটা ভারতে শোরা বা সল্টপিটার উৎপাদন মুঘল আমল থেকেই। বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন শুরু করেন তুর্কি কামান আর গোলাবারুদের সাহায্য নিয়ে। বাবরের মৃত্যুর পর বেশিদিন মুঘল আধিপত্য ধরে রাখতে পারেননি হুমায়ুন। ‘সুখে খেতে ভূতে কিলায়’ বলে যে একটা প্রবাদ আছে, ক্ষমতার লোভে অন্ধ সম্রাটরা এই প্রবাদ প্রমাণ করেন বারবার। বাবরপুত্র হুমায়ুনও একই ভুল করেছিলেন, দিল্লির সুলতান হওয়ার পর যখন ভারতের বেশিরভাগই তার পদানত, তার রাজ্যবিস্তারের নেশা চেপে বসে। নজর পড়ে বাংলার সালতানাতের দিকে। বাংলা-বিহারের মসনদে তখন শেরশাহ সুরি। তাকে পরাজিত করে বাংলার দখল নিতে আসেন হুমায়ুনের সৈন্য-শামন্তরা। তার বদলে উল্টো মুঘলরা পরাজিত হয়। উজ্জীবিত শেরশাহ তখন পাল্টা আক্রমণ করেন মুঘলদের। ধীরে ধীরে আগ্রার দিকে এগিয়ে যান। হুমায়ুনকে পরাজিত করে দখল নেন উত্তর ভারতের। মুখলরা সাময়িক সময়ের জন্য দেশছাড়া হয়। সে সময় তুরস্ক থেকে আসা কামানের গোলা তৈরির ফর্মুলা জেনে গিয়েছেন ভারতের শাসকরা। বিশেষ করে সুলতানি বাংলার পাটনায় (বর্তমান বিহারের রাজধানী) তৈরি হচ্ছে বারুদের মূল উপাদান সল্টপিটার, শোরা বা পটাশিয়াম নাইট্রেট। অর্থাৎ বেঙ্গল সল্টপিটারের পুরো নিয়ন্ত্রণ শেরশাহের হাতে। আগ্রা জয়ের পাঁচ বছর পর শেরশাহ উত্তর প্রদেশের বিন্ধ্যা দুর্গ জয় করতে যান, সেই যুদ্ধে কামানের গোলার আঘাতে মারা যান শেরশাহ। কে জানে সেই গোলা হয়তো এসেছিল, তারই শাসনাধীন পাটনা থেকে!
আরও ১০ বছর পর, হুমায়ুন আবার ভারত বিজয় করেন। বিস্তৃত করেন নিজের সাম্রাজ্য। তার মৃত্যুর পর আগ্রার মসনদে বসেন পুত্র আকবর। এ সময় দিল্লির সেনাপতি হিমুর সঙ্গে আকবরের সেনাপতি বৈরাম খানের যুদ্ধ হয়। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ। মুঘলদের অবর্তমানে একসময় গোটা ভারতের শোরা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণভার চলে আসে হিমুর হাতে।
আগের লেখায় আমরা নুনিয়া সম্প্রদায়ের কথা বলেছিলাম, যারা শোরা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। নুনিয়ারা এ কাজে এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠেন, গোটা বিশ্বে সবচেয়ে উন্নতমানের শোরাটাই তারা উৎপাদন করত। সপ্তদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পাটনার সবচেয়ে অর্থকরী পণ্য হয়ে ওঠে শোরা।
শেরশাহের সময় বাংলায় বাণিজ্য পর্তুগিজ বণিকদের বেশ চলাচল ছিল। তারা পাটনা থেকে শোরা কিনে গোয়া বন্দরের সাহায্যে ইউরোপে রপ্তানি করত। তবে পাটনার চেয়ে তাদের মূল ভরসা ছিল মহারাষ্ট্রের রাজাপুর। এর একটা বড় কারণ দেশীয় শাসকদের গোলার চাহিদা। বাংলার শাসকরা নিজেরা উন্নতমানের গোলা সংগ্রহ করার পর যে তলানিটুকু অবশিষ্ট থাকত সেটুকুই বিদেশি বণিকরা পেত। একসময় মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবজী শোরা উৎপাদন ও রপ্তানিভার সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
১৬২৫ সালে ব্রিটেনের মসনদে বসেন রাজা প্রথম চার্লস। এর পরপরই ব্রিটিশ অঞ্চলে ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়। ফলে গোটা ইংল্যান্ড জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। বিশেষ করে স্কটল্যান্ডের সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর সংঘর্ষটা বড় যুদ্ধে রূপ নেয়। তখন ব্রিটিশরাজ বুঝতে পারেন অস্ত্রভাণ্ডার আরও শক্তিশালী করতে হবে, বাড়াতে হবে বারুদের মজুত। সেই চেষ্টা শুরু করেন তিনি।
তখন একটা বিশেষ উপায়ে ব্রিটেন নিজের দেশেই শোরা উৎপাদন করত; কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা ছিল এদেশে নীল চাষের মতো, সাধারণ মানুষের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া। সাধারণ মানুষকে বাধ্য করে যে পরিমাণ শোরা সংগ্রহ করা হতো তাতে ব্রিটেনের মোট চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ মিটত। বাকি তিন ভাগ আমদানি করতে হতো; কিন্তু ব্রিটেনের জন্য ভারত থেকে শোরা আমদানি করা অত সহজ ছিল না। এখনকার বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিছুতেই তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাই ব্রিটিশ সরকার ডাচদের কাছ থেকেই শোরা কেনার চেষ্টা করে। দারস্থ হয় জার্মানি বা অন্যদেশের দিকেও; কিন্তু কিছুতেই ভালো শোরা মিলছিল না। তাই ব্রিটিশ সরকার চাপ বাড়ায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর।
তখন বাংলার শোরা ব্যবসার রাশ ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর। পর্তুগিজদের হাত ধরে বাংলার শোরা বিশ্বদরবারে পৌঁছায় বটে; কিন্তু ব্রান্ডভ্যালুটা তৈরি করে ডাচ বা ওলন্দাজরা। বাংলার মুঘল শাসকদের সঙ্গে পর্তুগিজদের সম্পর্কে চিড় ধরে। অবস্থা এতটাই বেগতিক হয়ে ওঠে, তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করে বাংলার শাসকরা। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সে কাজে সাহায্য করে। হুগলি থেকে পর্তুগিজরা বিতাড়িত হয়। এরপরই ডাচ কোম্পানিটির অধিকারে চলে আসে বাংলার শোরা ব্যবসার লাগাম।
দেশীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সল্টপিটার কিনে তারা আবার কয়েক ধাপে বিশুদ্ধ করে ইউরোপে পাঠাত। সেই শোরাই গুণেমানে বিশ্বসেরা ছিল। ফলে ডাচ ব্যবসায়ীরা ফুলেফেঁপে ওঠে। সেটা এতটাই যে, তারা একটা কোম্পানি খুলে বসে, যার নাম ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের শোরা কারখানাটা ছিল খোদ বাংলায়, কালকাতার চুঁচুড়া বন্দরের কাছাকাছি। তবে চাইলেই ইচ্ছেমতো শোরা সংগ্রহ করতে পারত না ডাচ কোম্পানিটি। মুঘলদের চাহিদা মেটানোর পর বাকিটুকু কেনার জন্য অনুমতিপত্রের দরকার হতো। চড়াদামে ডাচরা সেই অনুমতিপত্র কিনে ব্যবসা করে। ১৬১৮ সালে ডাচরা অল্পবিস্তর শোরা উৎপাদন করত, ১৬৩২ সাল নাগাদ তারা চুঁচুড়ায় মস্ত একটা কারখানা খুলে বসে। পরের চার দশকে ফুলেফেঁপে ওঠে তাদের ব্যবসা। অন্যদিকে ব্রিটিশরা সুরাট, করমণ্ডল ও আগ্রায় নানা ধরনের অলাভজনক ব্যবসা করত। ১৬৭০ সালের মধ্যে তারা সেসব ব্যবসা গুটিয়ে বাংলায় আস্তানা গাড়ে। শুরু করে ব্যবসাও, বিশেষ করে শোরা। লাভও আসতে শুরু করে হু হু করে।
তাদের রমরমা ব্যবসা, বাংলা-বিহারের নবাবরাই বা তার ভাগ ছাড়বেন কেন? বাড়তি ট্যাক্স বসানো হলো শোরার ওপর। ডাচ কোম্পানিটির টাকার অভাব ছিল না। তাদের উচ্চ ট্যাক্স দিতেও তাই বেগ পেতে হতে হয়নি তাদের; কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থলে অত টাকা নেই। তারা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা বাংলা থেকে পাততাড়ি গোটায়। ফলে সুবাহ বাংলায় শোরা ব্যবসায়ে ধ্স নামে। ফলে আবার তারা ব্রিটিশদের খোশামোদ করে ডেকে আনে।
এরপর সুবাহ বাংলায় একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়। মুঘলরা দুর্বল হতে শুরু করে। সুবাহ বাংলা তখন স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলি খান স্বাধীন সুবহা বাংলার প্রথম নবাব হন। তারপর শোরার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও আসে তার হাতে। তখন মুঘল সম্রাটের অনুমতিপত্র অকার্যকর হয়ে যায়। ঠিক সে সময় শোরার গন্ধ পেয়ে বাংলায় ছুটে আসে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফলে বাংলায় বাণিজ্যে ভারসাম্য যেমন আসে, তেমনি এখানে ইউরোপিয়ানদের বাণিজ্যও বেশ রমরমা হয়ে ওঠে। তিনটি কোম্পানি নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য একটা ভারসাম্য চুক্তি করে। তিনটি কোম্পানিই স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে শোরার জন্য চুক্তি করে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তারা কিনবে; কিন্তু ডাচদের টাকা, ক্ষমতা, দুটোই বেশি তাই তারা কিছুদিনের মধ্যেই চুক্তি ভঙ্গ করে। অন্য দুই কোম্পানির চেয়ে তারাই বেশি পরিমাণ শোরা কেনে, লাভও বেশি করে। ফরাসি আর ব্রিটিশরাই বা মানবে কেন? তারা গিয়ে নালিশ করে নবাবের কাছে। শুরু হয় নিজেদের মধ্যে লড়াই। এরই মধ্যে ১৯২৭ সালে মুর্শিদকুলি খান মারা যান, তার জামাতা সুজাউদ্দীন খান সিংহাসনে বসেন, ১৭৩২ সালে তারও মৃত্যু হয়। মসনদে বসেন তার পুত্র সরফরাজ খান। সুজাউদ্দীন খানের আমলে তার অধীনে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন আলীবর্দী খান। ১৯৪০ সালে তিনি বিদ্রোহ করেন এবং মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে সরফরাজ খানকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলার মসনদে বসেন। হয়ে ওঠেন বাংলার সর্বকালের অন্যতম দক্ষ শাসক।
আলীবর্দী খান ক্ষমতায় বসার পরপরই দেখলেন ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত। এই বিশৃঙ্খলার রাশ টেনে ধরলেন তিনি। তিনি ইউরোপিয়ানদের সরাসরি শোরা কেনার সুবিধা রদ করেন। এর বদলে বেশ কিছু এদেশীয় ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেবে শোরার নিয়ন্ত্রণ। তারা নুনিয়াদের মহাজনদের কাছে শোরা কিনে ব্রিটিশদের কাছে বিক্রি করতেন। আমিরচাঁদ বা উঁমিচাঁদ ছিলেন এ ধরনের একজন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী, তিনি পরবর্তীকালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাসনকালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
আমিরচাঁদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তরতর করে উপরে উঠতে শুরু করে। শোরার ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তারা।
১৭৫৬ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যু হয়। মসনদে বসেন তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা; কিন্তু আলীবর্দী খানের মতো দাপট তার ছিল না। সিরাজের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লর্ড ক্লাইভ মীরজাফর গংদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। সিরাজ-উদ-দৌলা নিহত হন। কার্যত বাংলার শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। বাংলার শোরার একচেটিয়া দখল নেয় কোম্পানিটি। ব্রিটিশ রাজের অস্ত্রভাণ্ডারে গোলাবারুদের মজুত বাড়তেই থাকে।
ওদিকে ১৭৫৬ সালেই ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশরাজ। লোকবল অর্থবল দুটোই ছিল ফরাসিদের বেশি। টানা ৭ বছর লড়াই চলে; কিন্তু শুধু লোকবলই তো সব নয়, অস্ত্রই মূলত যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ব্রিটিশদের হাতে ছিল প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গোলাবারুদ। অন্যদিকে বাংলার ক্ষমতা দখলের পর ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয় ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফলে তাদের শোরার অভাব দেখা দেয়, তার প্রভাব পড়ে যুদ্ধের মাঠেও। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়েও হারতে হয় ফরাসিদের। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ব্রিটিশরা, সেটা বাংলার শোরার গুণেই।
আবদুল গাফফার রনি: বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে