Views Bangladesh Logo

ঢাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিষিদ্ধ লেজার লাইট

রাজধানী ঢাকার রাত। লাল-নীল বাতি জ্বলে ওঠে মোড়ে মোড়ে। গাড়ির হর্নে থেমে থাকে না কোলাহল। মানুষের ব্যস্ততা ছড়িয়ে থাকে অন্ধকারেও। হঠাৎই এক ঝলক আলো ছুটে আসে চোখের দিকে- যেন বিদ্যুতের দাহ, যেন সূর্যের তীব্র ঝলক অথচ দুটির কোনোটিই নয়। এটি লেজার লাইট। আদালতের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এই বিপজ্জনক আলোর রশ্মি এখন রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশের হাতেই ঝলমল করছে। ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে দেয় দৃষ্টি, থামিয়ে দেয় গতি আর ঝুঁকির মুখে ফেলে অসংখ্য মানুষের জীবন।

সরেজমিন চিত্র
রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, আদাবর, মতিঝিল, পল্টন, কাকরাইলসহ- বহু গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক মোড়ে দেখা যায় লেজার লাইটের ব্যবহার। পুলিশের হাতে কিংবা তাদের সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাত্র প্রতিনিধিদের হাতে ঝলমল করছে এ লাইট। ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষার নামে এই আলো তারা ছুড়ে দিচ্ছে বাস, প্রাইভেটকার, মোটরবাইক চালকদের চোখে। এমনকি এ আলো পথচারীর দিকে ছুড়ে তাদেরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে দেখা গেছে। এছাড়া, বিমানবন্দরের আশপাশে লেজার লাইট ব্যবহারের কারণে বিমান চলাচলের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানা গেছে।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য
রাজধানীবাসী বলছেন, সড়কে এ ধরনের লাইটের ব্যবহারে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। চালক থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী- সবাই বলছেন, এই আলোর তীব্র ঝলক চোখে পড়লে সামনের কিছু দেখা যায় না, তৈরি হয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বাসচালক, রাইডশেয়ার কর্মী কিংবা অফিসফেরত কর্মী- প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাই ভয়ংকর। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে আতঙ্ক, ক্ষোভ আর অসহায়তার সুর।

রাইডশেয়ার কর্মী মো. মহসিন ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন, ‘এই লাইট চোখের জন্য ভয়ংকর। সামনে কিছুই দেখা যায় না কয়েক মুহূর্ত। গাড়ি চালানোর সময় যদি এই আলো চোখে লাগে, দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন।’ বাসচালক রহমউল্লাহর অভিজ্ঞতা আরও তীব্র। তার ভাষায়, ‘এই লাইট চোখে পড়লে মাথায় ঝিম ধরে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তো অনেকক্ষণ স্টিয়ারিংয়ে থাকি, হঠাৎ এভাবে আলো পড়লে তো চোখ বন্ধ হইয়া আসে। পুলিশরা তাও হুশ কইরা দেয়; কিন্তু ছাত্র পোলাপাইন সোজা চোখের মধ্যে মারে।’ একই সুরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইনজামামুল হক বলেন, ‘যেখানে আদালত নিষেধ করেছে সেখানে পুলিশের এই ব্যবহার মানা যায় না। আর ছাত্র প্রতিনিধিদের হাতে তো একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ দেখা যায়, তারাই লাইটের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে।’

চিকিৎসকদের সতর্কবার্তা
চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, লেজার লাইট মানুষের চোখের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। হঠাৎ করে এর ঝলকানি চোখে পড়লে সাময়িক অন্ধত্ব, মাথাব্যথা বা ঝাপসা দেখার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে কর্ণিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রশ্নে এই লাইটের ব্যবহার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে।

চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. কাদের বলেন, ‘এই লেজার লাইট এতটাই ক্ষতিকর যে এটি চোখের কর্ণিয়া স্থায়ীভাবে নষ্ট করতে পারে। এর প্রভাবে মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা এমনকি দৃষ্টিশক্তি হ্রাসও হতে পারে।’

আইন ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া
হাইকোর্ট ২০২৫ সালের ৪ মার্চ লেজার লাইট ব্যবহারের বিষয়ে একটি রুল জারি করেছেন। ওই রুলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরাপদ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানো হয়। রিট আবেদনে লেজার লাইট ব্যবহারকে একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর শাস্তি নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ করা হয়।

আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাস্তবে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে এখনো ট্রাফিক পুলিশ ও তাদের সহযোগীরা অবলীলায় এই লাইট ব্যবহার করছেন। বিষয়টি স্বীকার করে পুলিশও বলছে, এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে তারা উদ্যোগ নিচ্ছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) সুফিয়ান আহমেদ বলেন, ‘এ লাইট আদালতের নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে। আমরাও চাই না এর ব্যবহার হোক। তবে কোনো কোনো জায়গায় এখনো এর ব্যবহার হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি।’


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ