সিএসআর বিতরণে নিয়ম মানছে না ব্যাংকগুলো
করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতে পারছে না দেশের ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সিএসআরের ব্যয়ের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শিক্ষা খাতে, ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে, ২০ শতাংশ পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এবং বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য খাতে ব্যয় করার কথা; কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। ২০২৫ সালের জানুয়ারি- জুন সময়ে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক মিলে সিএসআরের ৫৫ শতাংশ অর্থ বা প্রায় ৮৩ কোটি টাকা খরচ করেছে ‘অন্যান্য’ খাতে।
অন্যদিকে শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে ২২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ৩৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা ২৮ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ বা ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ, তিনটি মূল খাতে নির্ধারিত অংশের তুলনায় অনেক কম ব্যয় করেছে ব্যাংকগুলো।
শুধু তাই নয়; চলতি বছরের (২০২৫) জানুয়ারি থেকে জুন- এই ছয় মাসে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয়ও কমেছে। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিএসআর ব্যয়ের খাতভিত্তিক বণ্টনের ব্যাপক অস্বচ্ছতা ও নির্দেশনা অমান্য পুরো ব্যাংক খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের ১৩টি ব্যাংক সিএসআরে এক টাকাও খরচ করেনি। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও। ব্যাংকগুলো হলো- জনতা, অগ্রণী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, পদ্মা, কমিউনিটি, এসবিসিএসি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
২০২৫ সালের জন্য সিএসআর খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৩৮ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের নিট মুনাফার ৩ দশমিক ১৪ শতাংশের সমপরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের নিট মুনাফার সর্বোচ্চ ১ শতাংশ পর্যন্ত সিএসআর খাতে ব্যয় করতে পারে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষা, ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্য এবং ২০ শতাংশ পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে বরাদ্দ বাধ্যতামূলক। বাকি ২০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে আয়ের উৎস সৃষ্টি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ও অন্যান্য খাতে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে সিএসআরে এত কম অর্থ ব্যয় হয়নি। ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় হয়েছিল ২৫৪ কোটি টাকা, যেখানে চলতি সময়ের ব্যয় দাঁড়িয়েছে তার চেয়েও ১০৪ কোটি টাকা কমে। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সিএসআরে খরচ ছিল ২৯৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৪ কোটিতে। তবে পরের বছর (২০২৩) খরচ কমে আসে- প্রথম ছয় মাসে ৩০৯ কোটি এবং শেষ ছয় মাসে ৩০৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় নেমে এসেছে মাত্র ১৫০ কোটি টাকায়।
ব্যাংকারদের মতে, সিএসআরের ব্যয়ে পতনের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। তাদের দাবি, রাজনৈতিক সরকারের সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ থাকত সিএসআরে ব্যয় বাড়ানোর জন্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অনুদানের নামে রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী মহলের চাহিদা মেটাতেই ব্যয়ের বড় অংশ চলে যেত। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আগস্টে সরকারের পরিবর্তনের পর সেই চাপ কমে গেছে। ফলে এখন ব্যাংকগুলো নিজেদের বিবেচনায় ব্যয় করছে, যার কারণে খরচও আগের তুলনায় অনেকটা নেমে এসেছে।
এনআরবিসি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সিএসআর খাতে অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা একটা সময় ব্যাংকের বাইরে থেকে আসত। ফলে খাতভিত্তিক বিতরণ চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। সেই চাপ পুরোপুরি হয়তো যায়নি তবে কমেছে। এই ধারাবাহিকতা থাকলে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের জন্যই এ খাতের ব্যয় করা হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সিএসআরের ব্যয় শুধু কমেছে তা-ই নয়, বরং তা খরচের নিয়মও মানছে না ব্যাংকগুলো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মতো খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না যাওয়ায় সামাজিক উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলতে পারছে না এই তহবিল। তারা মনে করেন, সিএসআরের অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অডিট ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, সিএসআরের ব্যয় যদি সঠিক খাতে না যায়, তবে তা সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনে না। বরং এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা পূরণের খাতায় পরিণত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নিট মুনাফা কমা ছাড়াও আগে যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ও শিক্ষা তহবিলে বাধ্যতামূলকভাবে অনুদান দিতে হতো, তা বর্তমানে কমে যাওয়াও ব্যয় কমার একটি বড় কারণ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে