মার্কিন শুল্ক যুদ্ধে বাংলাদেশের জয়-পরাজয়
তিন দফা আলোচনা শেষে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে তার পণ্যের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করতে পেরেছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য যেমন ইতিবাচক, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য কূটনৈতিক সাফল্যও বটে। কারণ গত ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প যখন প্রথমবার বিভিন্ন দেশের ওপর বাড়তি শুল্কের পরিমাণ ঘোষণা করলেন, তখন বাংলাদেশের পণ্য থেকে ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক নেয়ার কথা বলেছিলেন। পরে সেই শুল্ক স্থগিত হয়ে যায়। ড. ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, ৩৭ নয়, ২ শতাংশ কমিয়ে বাংলাদেশের ওপর শুল্কের পরিমাণ করা হচ্ছে ৩৫ শতাংশ।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা না হলে গত ১ আগস্ট থেকে আগের ১৫ শতাংশসহ বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক যোগ করে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো; কিন্তু অবশেষে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে তার পণ্যের ওপর নতুন করে বাড়তি ২০ শতাংশ ধার্য করার পর এখন (আগের ১৫ শতাংশসহ) শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৩৫ শতাংশে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন শুল্ক যুদ্ধে অন্যান্য দেশের তুলনায় কতটা সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ানোর কৌশলের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের পাশাপাশি ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক চিন্তাটাই মুখ্য। তাই বাণিজ্যের বাইরের বিষয়গুলোয় বাংলাদেশ কীভাবে সামাল দেবে, কীভাবে তার অবস্থান তুলে ধরবে, সেটাই আসল কথা। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগের প্রথম ও দ্বিতীয় দফা আলোচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে 'গোপন চুক্তি' করার অভিযোগ উঠেছিল। সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা অবশ্য সমঝোতার স্বার্থে আলোচনার অনেক বিষয় গোপন রাখার কথাও বলেছিলেন। আর সে কারণে প্রশ্ন উঠছে, শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে অবশেষে সমঝোতা হলো কীসের ভিত্তিতে, বাংলাদেশ ছাড় দিলো কোথায় কোথায়?
তাই শুল্কহার আলোচনায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কী কী ধরনের শর্ত পূরণ করেছে। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জনগণের কাছে খোলসা করতে হবে। কারণ মার্কিনদের শর্তের মধ্যে শুধু বাড়তি পণ্য আমদানিই ছিল না, ভূরাজনৈতিক কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তাকেন্দ্রিক অনেক শর্ত ছিল। এসব শর্ত মেনে নেয়া হলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত হবে। কাজেই স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করেছে কি না, তা সরকারকে খোলাসা করতে হবে।
ভূরাজনৈতিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কথা একপাশে রেখে আমরা জেনে নিই, মার্কিন বাড়তি শুল্কের হার কোন দেশের ক্ষেত্রে কতটা ধার্য করা হয়েছে। মার্কিন বাজারে পণ্য বিক্রি করতে হলে এখন থেকে বাড়তি শুল্ক দিতে হবে ব্রাজিলকে ১০ শতাংশ, আফগানিস্তানকে ১৫, পাকিস্তানকে ১৯, ইন্দোনেশিয়াকে ১৯, ফিলিপাইনকে ১৯, মালয়েশিয়াকে ১৯, ভিয়েতনামকে ২০, বাংলাদেশকে ২০, শ্রীলঙ্কাকে ২০, ভারতকে ২৫ ও মিয়ানমারকে ৪০ শতাংশ। এ শতাংশের হিসাবে বাংলাদেশ মাঝামাঝি অবস্থানে আছে ধরে নেয়া যায়।
সে ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও ওই দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের শুল্ক হার প্রায় সমতুল্য, অর্থাৎ গড়ে ১৯ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক হার ধার্য করা হয়েছে। তাই প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর কাছাকাছি হারের পাল্টা শুল্ক আরোপ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশকে বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়বে না। অন্যদিকে ভারতের জন্য ২৫ শতাংশ শুল্ক হার হওয়ার ফলে বায়াররা গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে সে দেশে বাণিজ্য করতে বেশি আগ্রহী হবে না। আর পাকিস্তানের জন্য শুল্কহার ১৯ শতাংশ হলেও ১ শতাংশের সুবিধা পাওয়ার জন্য বায়াররা পাকিস্তানে যাবে না। কারণ পাকিস্তানের সেই সরবরাহ ক্যাপাসিটি নেই; কিন্তু শুল্ক কমলেও বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ ১৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর বিষয়টি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে আশঙ্কার কথা বলছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাড়তি শুল্ক কারা কতটুকু বহন করছে, তা দেখবার বিষয়। এটি উদ্যোক্তাদের ওপর এলে মুনাফা কিছুটা কমে যাবে।’ কারণ পারস্পরিক শুল্ক হার তুলনামূলকভাবে কমলেও খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি, ব্যাংক, লজিস্টিক, পোর্ট ও এনবিআরের ব্যবস্থাপনা সহজলভ্য। আমরা জানি, গত কয়েক মাসেও ঢাকা ও চট্টগ্রামে গ্যাসের অভাবে কয়েকশ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফ তো আছেই। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, নতুন এই শুল্কনীতি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই বলেছেন, যারা আমেরিকান পণ্যের ওপর অসম শুল্ক আরোপ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রও তাদের ওপর এই পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। অর্থাৎ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোই তার মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ দুটি সিদ্ধান্তের কারণে রপ্তানি খাতকে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের চেয়ে বাড়তি অসুবিধায় পড়তে হবে। এই সিদ্ধান্ত দুটি হলো: এক. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল গড়ে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। দুই. বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) মাশুল ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। এ দুটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আমদানি খরচ যেমন বাড়বে তেমনি রপ্তানিকারকদের বাড়তি মাশুল দিতে গিয়ে প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে হবে। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা এবং বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের মাশুল বৃদ্ধি সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনা।
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক আলোচনার অংশ হিসেবে দেশটির বিমান কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে যে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ তাতে কয়েক বিলিয়ন ডালার ব্যয় তো আছেই। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বর্তমান আর্থিক অবস্থা, রুট সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার বাস্তবতায় ২৫টি বোয়িং বিমান বহন করার কোনো সক্ষমতা নেই। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিমানকে ‘ট্রেড পলিটিক্স টুল’ হিসেবে ব্যবহার করছে। এমন হুটহাট সিদ্ধান্তে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ বিমান ব্যবস্থাপনা। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় চাপেও পড়তে হবে তাদের।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কয়েক লাখ টন গম কিনতে হবে চড়া দামে, এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে সয়াবিন ও তুলা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তা কেনার শর্ত ছিল বাংলাদেশের। এ ধরনের স্পর্শকাতর শর্তের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ কী অবস্থান নিয়েছে, চুক্তিতে কী রাখা হয়েছে- তা এখনো স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এখন দেখার বিষয় শুল্ক যুদ্ধে বাংলাদেশ মার্কিনদের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদে কতটা জয় ছিনিয়ে আনতে পারে, নাকি পরাজয় অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের ভাগ্যে।
গিরীশ গৈরিক: কবি ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে