বাংলাদেশের রাজনীতি ও জনগণের সংগ্রাম: একটি নির্ভীক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের নির্বাচন একসময় ছিল গণতন্ত্রের উৎসব, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক বহিঃপ্রকাশ; কিন্তু সেই উৎসব আজ অতীতের স্মৃতিমাত্র। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন হয়তো ছিল একটি প্রি-ফিক্সড খেলা, তবে জনগণ সেই উৎসবের আবহ অনুভব করেছিল। এরপর আর কখনো ভোট উৎসব হিসেবে মনে হয়নি। ২০১৪ সালে যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫৪ আসন পেয়েছিল একদলীয় সরকার, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের মাধ্যমে গড়া সংসদ, এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে যেখানে নাম লেখানোই ছিল একদলীয়, এসব প্রক্রিয়া একথা প্রমাণ করেছে যে, এ দেশে এখন নির্বাচন নামক কিছু নেই।
তরুণরা ভোটের উৎসব ভুলে গেছে, গণতন্ত্রের আলো নিভে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৫ শতাংশের কম ভোট পড়া, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের ব্যাপক বঞ্চনা, মানুষের মনোবেদনার এক ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপন করে। জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান তরুণদের হারানো ভোটের উৎসব ফিরিয়ে আনার আশার বাতাস বয়ে দিলেও, কিছু মাসের মধ্যেই সেই আশার আলো ম্লান হতে শুরু করল। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিবাদের বিদায়হীন রেশ কাটতে না কাটতেই, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর ঐক্য ভেঙে পড়তে শুরু করল।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির মধ্যে দূরত্ব বেড়ে বৈরিতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আচরণও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ল। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর মতানৈক্য দিন দিন গভীরতর হচ্ছিল, যা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য আতঙ্কের বার্তা বহন করেছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে ডিসেম্বরের নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচির পথে এগোতে বাধ্য হচ্ছিল।
তবে অপ্রত্যাশিতভাবে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঐক্যের সূচনা হয়। ১৩ জুন ২০২৫ সালে লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক টেবিলে বসেন। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে করার ব্যাপারে প্রাথমিক একমত প্রকাশ পায়। এই খবর দেশের মানুষের মনে এক আশার বাতাস ছড়ায়।
দীর্ঘদিনের নির্যাতন, অবিচারের মধ্যেও তারা দেখেছিল আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন সম্ভব। এই লন্ডন বৈঠক রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের প্রথম বাস্তব ও সফল উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে নথিভুক্ত হবে। তবে যৌথ বিবৃতিতে সংস্কার ও গণহত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি অর্জনের শর্তও রাখা হয়েছে, যা কিছু অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত বহন করে। রাজনীতিতে প্রতিটি দলের স্বার্থ ও কৌশল থাকবে, তবে যদি দেশের কল্যাণ প্রধান মূলনীতি হয়, তাহলে আশা করা যায় যে, এক সময় সবার মধ্যে সমঝোতা গড়ে উঠবে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে সবার পক্ষে ‘উইন-উইন’ অবস্থা সৃষ্টি সম্ভব।
তবে বাংলাদেশে প্রকৃত জনমত জানার কোনও গ্রহণযোগ্য উপায় নেই। স্বাধীনতার পর একাধিক গণভোট এবং জনমত জরিপ আয়োজন হলেও সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। গণতন্ত্রের বিকাশে এবং সুশাসনের প্রতিষ্ঠায় এ দেশের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দাবির সাথে সাধারণ মানুষের চাওয়া মিলছে কি, সন্দেহজনক। টেলিভিশন টকশো ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই দাবি করেন জনগণ তাদের পক্ষে, কিন্তু বাস্তবে তা সম্পূর্ণ বাস্তবতা প্রতিফলিত করে না।
রাজনৈতিক দলের প্রধান চাওয়া হলো ক্ষমতা অর্জন এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা। আওয়ামী লীগের প্রধান চাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত পতন এবং ক্ষমতায় ফিরে আসা। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন আয়োজন ও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী গত দেড় দশক ধরে নিপীড়নের শিকার হলেও এখন তারা পুনর্গঠন ও শক্তি অর্জনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে তারা গণমুখী দল হওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও ভোটের রাজনীতিতে তারা এখনো সীমাবদ্ধ।
রাজনীতির মাঠে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নতুন তরুণ নেতারা উঠে এসেছেন, তবে তারা এখনো বাস্তব রাজনীতির কঠোরতা বুঝতে পারছে না, ‘রিয়ালপলিটিক’ শিখতে হচ্ছে। এই সব রাজনৈতিক পরিবর্তন ও প্রক্রিয়ার মাঝেও সাধারণ মানুষের স্বার্থে সঠিক নেতৃত্ব ও সুশাসনের অভাব চোখে পড়ে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসন জনগণের বেতন ও কর থেকে চলে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘টোকাই’ বা সাধারণ জনগণই দেশের রক্ষাকর্তা। তারা নিজেদের মনের জোরে, একজোট হয়ে দেশের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যখন ব্যর্থ, তখন জনগণই উঠে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রশ্নগুলো থেকে পালানো যায় না- রাষ্ট্রের রক্ষাকর্তাদের ভূমিকা কী? তারা জনগণের সেবা করতে পারছে না কেন? রাজনীতিবিদরা কেন এই সংকটের মোকাবিলা করতে চায় না? ‘টোকাই’ বা সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন কখন হবে? এই দেশে কি রাজনীতিবিদদের জীবন যাপনের জন্যই গড়ে তোলা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রয়োজন অবিচল সাহস, গম্ভীর বিশ্লেষণ ও কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়া। শুধু কথার দ্বারা নয়, কার্যকর সংস্কার ছাড়া দেশের মানুষের অধিকার ফিরবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে দেশের ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত না হয়, তবে এই বঞ্চনার অবসান হবে না।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্নীতি, স্বৈরাচার, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও স্বার্থপর রাজনীতি। দেশকে পরিচালিত করে এমন একটি সিস্টেম যেখানে জনগণের অধিকার বিবেচিত হয় না, সেখানে সত্যিকারের গণতন্ত্রের বিকাশ অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার যা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ।
আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশাগুলো হলো:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি গ্রহণ। ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি পরিবর্তন না হলে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ অন্তত দুই মেয়াদে সীমিত করা।
২. নির্বাচনের আগে কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য, যেখানে প্রধান বিচারপতিকে অবলম্বন করা হবে না, কারণ পুরোনো পদ্ধতি বিতর্কিত ছিল।
৩. ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলা এবং ভিনদেশি দালালদের অনুপ্রবেশ রোধে জাতীয় চার্টার প্রণয়ন।
৪. নাগরিকদের সম-অধিকার এবং আইনের সুরক্ষার নিশ্চয়তায় প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিচারপতির নিয়োগ।
যদিও এই প্রত্যাশাগুলো পূরণ সম্ভবত কঠিন; কিন্তু এগুলোই বাংলাদেশের স্থায়ী শান্তি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
সর্বোপরি, দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ‘টোকাই’ জনগণই দেশের প্রকৃত শক্তি। তাদের সংগ্রামকে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপেক্ষা করতে পারবে না। রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে এখনই তাদের দায়িত্ব উপলব্ধি করে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। নতুবা দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে।
রহমান মৃধা: গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে