নিঃসঙ্গ সারথীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ
ইউরোপের ধনী দেশে ফ্রান্সের সচ্ছল পরিবারের ২৯ বছর বয়সী যুবক জ্যা ইউজিন পল ক্যুয়ে। ঐ বয়সে তাঁর নিজের পেশা, প্রিয়তমা আর ফরাসি বিখ্যাতসব পানশালায় মত্ত থাকার কথা। কিন্তু কি এক অদ্ভূত মানবতার টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে বসলেন। সামিল হলেন বাঙালি মুক্তি সংগ্রামে। এই ঘটনায় ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যস্ততাকারীর জ্যা ক্যুয়ের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি দাবি করেন, ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ঔষধ ও ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে হবে! জিম্মি ঘটনার এক পর্যায়ে নিরাপত্তা রক্ষীরা জ্যা ক্যুায়ের বুকে গুলি করে। এতে মারাত্মক আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। পরে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হলে ফরাসি সরকার ত্রাণ ওষুধ পাঠায় বাঙালি শরণার্থীদের জন্য।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে এ রকম অনেক জ্যা কুয়ে আছেন, যারা কোনো কারণ ছাড়াই শুধু মানবতার ডাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন মনুষ্যত্বের বারতা। যাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে গঠিত হয়েছে বিশ্ব জনমত। ত্বরাণ্বিত হয়েছে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম। আসুন জেনে নিই বাঙালির যুদ্ধদিনের কয়েকজনের অবিশ্বাস্যসব গল্প।
বেলজিয়ামের নাগরিক মারিও পিয়েরে রয়ম্যানস্ একটি হোটেলে খুব ছোটো চাকুরি করতেন। খুব সামান্য, ছা-পোষা এই যুবকই ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসের একটি আর্ট গ্যালারি থেকে চুরি করেন জেন ভারমারের অতি মূল্যাবান পেইন্টিং দ্য লাভ লেটার। সুরক্ষিত আর্ট গ্যালারিতে থেকে এই চুরির জন্য রয়ম্যানস্ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে একটি ইলেকট্রিক বক্সে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। পরে রাতে গ্যালারি বন্ধ হলে সেখান থেকে বের হয়ে এই মূল্যবান ছবিটি চুরি করেন। এরপর ছবিটি বিশেষ কায়দায় বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখেন। পরে রয়ম্যানস্ নিজেকে বিখ্যাত জনদরদী দস্যু তেজিল ভ্যান লুমবার্গ দাবি করে ব্রাসেলস্ভিত্তিক সংবাদপত্র লে সোয়ের এর এক সাংবাদিকের সাথে একটি পাইন বনে সাক্ষাৎ করেন। ঐ প্রতিবেদককে রয়ম্যানস্ শুধু একটা ক্যামেরা সাথে আনতে বলেছিলেন। কনকনে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে রয়ম্যানস্ সেই প্রতিবেদকে একটি চার্চে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে দেখান কাপড়ে মোড়ানো মহা মূল্যবান দ্য লাভ লেটার। এরপর প্রতিবেদককে জানান, তিনিও শিল্পকর্ম পছন্দ করেন। তবে ঐ ছবি ফেরত দিতে রয়ম্যানস্ তিনটি শর্ত দেন। যার প্রধান শর্ত ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য ২০০ মিলিয়ন বেলজিয়ান ফ্রা দিতে হবে। যার জন্য ৬ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন রয়ম্যানস্। যদিও নানা নাটকীয়তার পর বেলজিয়ান পুলিশ ঔই দিনই তাঁকে গ্রেফতার করে। এরপর বেলজিয়ামসহ পুরো ইউরোপে দাবি উঠে বাঙালির রবিনহুড মারিও পিয়েরে রয়ম্যানসের মুক্তি চাই। কোনো দাবি আদায়ে শিল্প কর্ম চুরি আপাত দৃষ্ঠিতে নৈতিক কাজ না হলেও বাঙালি জাতিকে সাহায্য করার প্রেক্ষিতে হওয়া এই চুরি ও রবিনহুড মারিও পিয়েরে রয়ম্যানস্ আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে করাচিভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য মনিং নিউজ এ এসিসটেন্ট এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাস। একইসাথে তিনি কাজ করে লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র সানডে টাইমস্ এ। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর বাংলাদেশ থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ। যদিও তারপরেও পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি চাপা দেওয়া যায়নি। সাংবাদিক সায়মন জন ড্রিং প্রথম বোমাটি ফাটান। দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় ট্যাংস্ ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান শিরোনামের প্রদিবেদন। এরপর অন্যান্য গণমাধ্যমও টানা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। যাতে সারাবিশ্বে চরম ভাবমূর্তি সংকটে পরে পাকিস্তান। এরপর গণহত্যা সম্পর্কিত এসব সংবাদের কাউন্টার দিতে আটজন প্রভাবশালী সাংবাদিককে ১০ দিনের এক সফরে বাংলাদেশে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ। সেই দলে ছিলেন এ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১০ দিনের ঐ সফরে সেনা কর্তৃত্বের অধীন থাকলেও মাসকারেনহাসের অনুসন্ধানী মন ঠিকই বের করে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত চিত্র। তিনি দেখতে পান প্রকৃতপক্ষে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে সেনারা বর্বর গণহত্যা চালিয়েছে ঢাকাসহ সারাদেশে। যাদের প্রধান টার্গেট হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
১০ দিনের ঐ সফর থেকে ফিরে এসে অন্য সাংবাদিকরা পাকিস্তানি চাহিদা অনুযায়ী সংবাদ পরিবেশন করেন। কিন্তু এ্যান্থনির মনে ছিল অন্য চিন্তা। তিনি ভাবছিলেন কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা যায়। পাকিস্তানে স্বশরীরে অবস্থান করে এই কাজ করা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর মনিং নিউজতো এ ধরনের প্রতিবেদন ছাপবেই না। আর যদি ছাপেও তাতে তাঁর পুরো পরিবারের প্রাণ সংশয় থেকে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে এ্যান্থনি ভাবলেন সানডে টাইমসের কথা। এই পত্রিকাতে আগেও তার অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এতেও জটিলতা। কারণ যদি প্রকৃত চিত্রের বিবরণী তাঁর নামে প্রকাশিত হয় তাহলে সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিবারের কাউকেই ছাড়বে না। এমন পরিস্থিতিতে এ্যান্থনি তাঁর পরিবারকে লন্ডনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে ঝুঁকি নিয়ে স্থল পথে আফগানিস্তান হয়ে লন্ডন পৌঁছান। তারপর তিনি প্রকাশ করেন জেনোসাইড শিরোনামের আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদনটি। ১৩ জুন ১৯৭১ প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি বাঙালি জাতির পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখে।
নিজের ও পরিবারের সবার জীবনকে বিপণ্ন করে অসাধারণ এক কাজ করেলেও তার নূন্যতম স্বীকৃতি পাননি মাসকারেনহাস। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের বিদেশী বন্ধুদের বাংলাদেশ সরকার বিশেষ সম্মাননা দিলেও সেই তালিকায় নাম ছিল না মাসকারেনহাসের। কারণ পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লিগ্যাসি অব ব্লাড নামের একটি বই লিখেছিলেন। যাতে অনেক বিষয় নিজের মতো করে তুলে ধরেছেন মাসকারেনহাস। যে রাজনৈতিক ভাষ্যের সাথে একমত নয় বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল।
দেশ, দল, সংঘ, সমিতির বাইরে এরকম অনেক ব্যক্তি, পেশাজীবী, শিল্পী, মানবাধিকারকর্মী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামান্য কিন্তু কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। গান গেয়েছেন মানবতার, সুর তুলেছেন সংহতির। এই তালিকায় আছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন, সাংবাদিক সায়মন জন ড্রিং, ফটোসাংবাদিক মিশেল লরেন্ট, কবি অ্যালেন গিনসবার্গসহ আরও অনেকেই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবাদী এই দূতদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
(লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে