আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী দিবস আজ
বাংলাদেশে ২৮৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপদাপন্ন
পরিবেশ সুস্থ রাখার গ্রিন ফিল্টার হলো অরণ্য বা বৃক্ষ। এই অরণ্য রক্ষা হলে রক্ষা পাবে বন্যপ্রাণীও। বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সংখ্যা প্রায় ৩১টি। দেশে ১ হাজার ৯৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে ২৮৮টি প্রজাতি বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ৩ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী দিবস। বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বন্যপ্রাণী রক্ষায় ডিজিটাল মাধ্যমে উদ্ভাবনকে কাজে লাগাও। মানুষ ও পৃথিবীকে যুক্ত করো।’
২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানানো হয়। ২০১৪ সালে বিশ্বের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রথম এ দিবস পালন করা হয়েছিলো। বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর পর থেকে প্রতি বছর ৩ মার্চ আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী দিবস পালন করা হচ্ছে।
‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’ বা ‘ডব্লিউডব্লিউএফ’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন যে হারে মানুষ প্রকৃতি আর পরিবেশ ধ্বংস করছে তা অতীতের সব রেকর্ডই ভেঙে দিয়েছে। আর এই ধ্বংসের ঘটনা যে অদূর ভবিষ্যতে কমে যাবে, এমনটাও ভাবার সুযোগ নেই। বন্যপ্রাণীর কী অবস্থা-তার খতিয়ান দিতে গিয়ে ডব্লিউডব্লিউএফ-এর রিপোর্ট জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর, মাছ ও সরীসৃপের ২০ হাজার প্রজাতির ৬৮ শতাংশই হারিয়ে গেছে। সেই বিলুপ্তি সবচেয়ে বেশি হয়েছে ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও বাংলাদেশের ১৪ গবেষকের করা এক সমীক্ষায় বলা হয়-সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংরক্ষিত বন ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে। বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা দিতে ঘোষণা করা এসব এলাকায় মানুষের তৎপরতা ও সমাগম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো বন্যপ্রাণীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে মানুষের নির্বিচার অত্যাচারের মধ্যেও বেঁচে আছে-পাঁচ প্রজাতির বাটাগুড় বাস্ক কাছিম, এশীয় উদবিড়াল বা ভোঁদর, বাদামি হুতোমপ্যাঁচা, কালোমুখ প্যারাপাখি ও স্পটেট ব্ল্যাক ক্রো প্রজাতি।
পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে শকুনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে রাজধানী এবং বিভাগীয় শহর কিংবা সুদূর গ্রামে কয়টি শকুন দেখা যায়-উত্তর আসবে, একেবারেই চোখে পড়ে না। ২০১৪ সালের শুমারি বলছে, দেশে মোট ২৬০টি শকুন রয়েছে, যার সব কয়টি বাংলা শকুন। ২০১৬ সালে সারা দেশে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২০০টির মতো। এর মধ্যে পাবনায় ১২টি শকুনের দেখা মেলে। দুই যুগ পরে শকুনের দেখা পাওয়া কঠিন হবে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর তথ্যে, শকুন এখন সংস্থাটির লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী। প্রকৃতি থেকে যদি কোনো প্রাণীর সংখ্যার ৯০ শতাংশ হারিয়ে যায়, তাহলে সেটি রেড লিস্ট বা লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী হয়।
আইইউসিএন-এর সমীক্ষা জানাচ্ছে, মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রমে ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে ১৯ লাখ মাইল ভূমি হারিয়ে গেছে, যা গোটা ব্রিটেনের ৮ গুণ। ১০ লাখ বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। প্রাণী ও উদ্ভিদের এক লাখ প্রজাতির মধ্যে ৩২ হাজার প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পৌঁছে গেছে।
জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ সিবিডি’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ স্থলভাগ এবং ৫ দশমিক ৪ শতাংশ সামুদ্রিক এলাকা সংরক্ষিত এলাকার আওতায় রয়েছে। সিবিডি’র আওতায় করা কুনমিং-মন্ট্রিয়ল চুক্তি অনুযায়ী দেশের ১৭ শতাংশ ভূখণ্ড ও ১৩ শতাংশ সাগর এলাকাকে সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা দিতে হবে। কারণ বেশির ভাগ সংরক্ষিত এলাকার আয়তন খুব ছোট হওয়ায় তা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৩০ ভাগ অঞ্চল সংরক্ষিত এলাকার আওতায় আনতে হবে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বনভূমিগুলোয় বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ-ভালুক, চামচ ঠুঁটো বাটান বা স্পুন বিলড স্যান্ডপাইপার ও গাঙ্গেয় ডলফিন বাস করে। কমপক্ষে এক কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি বনের সম্পদ যেমন গাছ, মাছ, মধুসহ নানা সম্পদ সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। বনের ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় গত ৮০ বছরে দেশের ৪০ শতাংশ এলাকার গাছপালা কেটে মানুষের বসতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১১ শতাংশেরও কম এলাকায় প্রাকৃতিক বন টিকে আছে।
আইইউসিএন-এর হিসাবে, বাংলাদেশে দশমিক ৮৭ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকাকে সঠিকভাবে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ১ হাজার ৯৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে ২৮৮টি বিপদাপন্ন হিসাবে চিহ্নিত। আর ৭৬৫ প্রজাতি বিপদে নেই। নিরাপদে থাকা পাঁচ প্রাণীর মধ্যে দুটি বিপদাপন্ন ও অন্য দুটি মহাবিপদাপন্ন প্রজাতির।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “দেশের বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় অবিলম্বে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে। বন, বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত বিদ্যমান সকল আইনে প্রাকৃতিক বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে সন্নিবেশ করতে হবে এবং এ বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বননীতি পরিবর্তন করে বনভূমিতে বাণিজ্যিকরণের বিরুদ্ধ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে,বনভূমিকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও সংরক্ষণের স্থান হিসেবে সুরক্ষিত করতে হবে।”
তাঁর মতে, প্রতিটি বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিৎ এবং সেক্ষেত্রে বনবিভাগের ভূমিকা সকলের কাছে স্পষ্ট করতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এসডিজি-১৪ ও ১৫ বাস্তবায়নে। নতুন করে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আর কোনো বনভূমি বরাদ্দ না দেওয়া এবং বন বিভাগের লোকবল ও বরাদ্দ বাড়িয়ে যুগোপযোগী এবং আধুনিক করে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে