বদরুদ্দীন উমর অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন অদ্বিতীয়: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বদরুদ্দীন উমর একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সমাজে যেসব মানবিক দুর্বলতার বিষয় থাকে, তাকেও সেসব আক্রমণ করেছিল; কিন্তু তাকে পথচ্যুত করতে পারেনি। তিনি ভীত হননি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে থেকেও সন্ত্রস্ত হননি। সম্মান, পুরস্কারের মোহ তাকে স্পর্শ করেনি।
গতকাল শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘কমরেড বদরুদ্দীন উমরের জীবনাবসানে শোকসভা’ অনুষ্ঠানে প্রথম বক্তা হিসেবে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেখানেও আমরা দেখেছি বদরুদ্দীন উমর কী নির্বিকভাবে লিখেছেন। তার কোনো মোহ ছিল না। সম্মানের মোহ, খ্যাতির মোহ, পুরস্কারের মোহ- কোনোটাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমরা জানি, সমাজ পুরস্কার দেয়, রাষ্ট্র পুরস্কার দেয়, কিন্তু বদরুদ্দীন উমর কোনো পুরস্কার কখনোই গ্রহণ করেনি। আবার আমরা এটাও দেখি, সংগ্রামের অনিশ্চিত জীবন থেকেও অনেকে বিচ্যুত হন, বদরুদ্দীন উমর সেই সংগ্রাম থেকেও কখনোই বিচ্যুত হননি।’
গত ৭ সেপ্টেম্বর ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কমরেড বদরুদ্দীন উমর। শোক সভায় বক্তারা বলেন, তিনি এমন এক মহীরুহ যাকে অসংখ্য শব্দেও বিশেষায়িত করা কঠিন। লেখক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক, বাম নেতা ইত্যাদি শব্দে তাকে পুরোটা ধরা যায় না। ‘মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবী বদরুদ্দীন উমর শোকসভা জাতীয় কমিটির আয়োজনে এই শোক সভা সঞ্চালনা করেন কমিটির আহ্বায়ক জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম।
শোক সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ, বাসদ উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। এ ছাড়া কমরেড বদরুদ্দীন উমরের কনিষ্ঠ কন্যা সারা আকতার বানুও পিতার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগঘন বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বদরুদ্দীন উমরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। এরপর সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করা হয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীত ‘জাগো জাগো জাগো সর্বহারা’। আলোচনার পাশাপাশি আরো ছিল নিবেদিত কবিতা পাঠ ও বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘চিরন্তন দীপশিখা’ নামে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ-লেখক-সংবাদিক-শিক্ষার্থী ও নানা শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতিতে পুরো মিলনায়তন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বসার জায়গা না পেয়ে অসংখ্য শ্রোতা পেছনে দাঁড়িয়ে আলোচকদের বক্তব্য শোনেন।
বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘কমরেড বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে আমার খুব বেশি মেলামেশার সুযোগ হয়নি। কিন্তু বহু আগে থেকেই আমি তার লেখার ভক্ত পাঠক। বদরুদ্দীন উমরের মতো মানুষ সব সময় জন্মান না। তাদের যে-আদর্শ, তাদের যে-সংগ্রাম, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তা করে গেছেন। কখনো কমপ্রোমাইজ করেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা আজকে রাজনীতি করি তারা তার কাছে অন্তত ছোট বোধ করি। কারণ তিনি কখনো কমপ্রোমাইজ করেননি। আরেকটা কথা এখানে খুব জোরেজোরে এসেছে তা হচ্ছে সমাজে বিনির্মাণে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা। আমার মনে হয় বিপ্লব তখনই সফল হয় যখন সংগঠন থাকে। আজকে যে একটা হতাশা এসেছে এই হতাশার মূল কারণ হচ্ছে সংগঠনের অভাব। আজকে যারা বিপ্লব সফল করতে চান, তাদের বিপ্লব সফল করতে হলে, বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, অবশ্যই সংগঠন করতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে।’
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বদরুদ্দীন উমর সম্পর্কে আমার আগ্রহের সৃষ্টি হয় আমি যখন স্কুলের ছাত্র। আমাদের বাসায় যে-পত্রিকা রাখা হতো সে-পত্রিকায় প্রথম আমি তার সম্পর্কে জানতে পারি, যখন তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। সেটি ১৯৭৩ সালের কথা। সে-সময়ের উত্তাল সময়ের কথা আপনারা সবাই জানেন। আমি তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডল হবে জায়গাটা, সেখানে একটা সভার আয়োজন করা হয় যেখানে আমি প্রথম তাকে দেখি। আমার তার নাম মনে ছিল ওই পত্রিকায় খবর দেখার পর থেকেই।
তিনি বলেন, আমিও রাজনীতি বুঝতে চাইতাম। তাই তার সম্পাদিত ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকা নিয়মিত পড়তাম। ১৯৭৩ সালে এটা প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯৭৪ সালে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় তখন এটাও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে প্রথম লেখক শিবিরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। বদরুদ্দীন উমরও লেখক শিবিরে সংযুক্ত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে প্রথম বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে সময় তিনি ছিলেন আত্মগোপনে। সেই সময় থেকেই তার রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে আমার যুক্ততা। এর পর দীর্ঘ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি, অনেক ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি একসঙ্গে করেছি। তার সঙ্গে নানা সাংগঠনিক তৎপরতা, তাত্ত্বিক আলোচনায় অনেক সময় আমি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ১৯৮১ সালে ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকা আবার নতুন করে প্রকাশিত হয়, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমি এই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’কে তিনি নতুন করে সংগঠিত করেন, তিনি সভাপতি ছিলেন, আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তার আরো নানা রাজনৈতিক কর্মতৎরতায় আমি তার সঙ্গে ছিলাম। সে জন্য বদরুদ্দীন উমর একই সঙ্গে আমার শিক্ষক ও সহযোদ্ধা।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই আমি বদরুদ্দীন উমরের লেখার ভক্ত। আমি যখন বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি পড়ি তখনই আমার কাছে মনে হয়েছিল তিনি অসাধারণ একজন জ্ঞানী মানুষ। পরবর্তীকালে তার আরো অসংখ্য লেখা আমি পড়েছি। বদরুদ্দীন উমর সম্পর্কে তখনই আমার মনে হতো তিনি অত্যন্ত উঁচু মাপের জ্ঞানী একজন মানুষ। বদরুদ্দীন উমর যে-ঘরানার রাজনীতি করতেন আমি সে-ঘরানার মানুষ না। আমাদের ঘরানার রাজনীতিতে কোনো জ্ঞানের চর্চা ছিল না। তাই যতই বড় হয়েছি ততই বুঝেছি জ্ঞান-বর্জিত রাজনীতি সমাজের কল্যাণ করতে পারে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা মেঠোবক্তা হিসেবে প্রসিদ্ধ; কিন্তু আলোচনায় একেবারেই অপরিপক্ব। আমি সবার কথা বলছি না। ব্যতিক্রম তো আছেই। কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায় রাজনীতিতে জ্ঞানের চর্চা একেবারেই ছিল না। বদরুদ্দীন উমর সে ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল বাতিঘর। তিনি সবাইকে এটা বুঝতে শিখিয়েছিলেন যে, লেখাপড়া ছাড়া আর যা-ই করা যাক, রাজনীতিতে ভালো করা যাবে না। আমার মনে হয়েছে আমার এই যে গড়ে ওঠা, বড় হওয়া তার পেছনে বদরুদ্দীন উমরের খুব বড় অবদান আছে।’
পরিবারের পক্ষে বদরুদ্দীন উমরের মেয়ে সারা আক্তার বানু শোকসভায় বক্তব্য রাখেন। পিতার স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘শেষ দিকে তিনি যখন খুব অসুস্থ ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমরা তিন ভাইবোন তাকে আগলে রাখছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।’
শোকাহত স্বরে তিনি পারিবারিক কিছু কথাও বলেন। কীভাবে ছোটবেলা থেকে পিতা তাদের ভালো মানুষ হতে শিখিয়েছেন, কোনো অন্যায় করলে কীভাবে শাসন করতেন এবং কীভাবে ভালো বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। বাবা চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর পরিবারটি কীভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে এবং তাদের মা কীভাবে সংসার আগলে রাখেন ।
অনুষ্ঠানে প্রায় ২২ জন বক্তা বক্তব্য দেন। তাদের মধ্যে আরো ছিলেন সাবেক সচিব সৈয়দ মারগুব মোরশেদ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক সাইফুল হক, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, বাংলাদেশ জাসদের নেতা আক্তার হোসেন, কৃষক ও মজদুর সংগঠনের সভাপতি সজীব রায়, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতা মুজিবুর রহমান, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান, গণঅধিকার পরিষদের সম্পাদক রাশেদ খান, প্রকাশনা সংস্থা বাঙ্গালা গবেষণার প্রকাশক আফজালুল বাশার, বাসদ মার্ক্সবাদীর নেতা মাসুদ রানা, বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি কাজী ইকবাল প্রমুখ।
এ ছাড়া শোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের লেখক অর্ক ভাদুড়ি, ডায়মন্ড হারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিন্দিতা ঘোষ এবং ‘অনিক’ পত্রিকা সম্পাদকমণ্ডলীর পাঠানো পৃথক শোকবার্তা পড়ে শোনানো হয়। শোক সভায় নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি হাসান ফখরী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে