গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ১২১ ফিলিস্তিনি
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন আরও ১২১ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন তিন শতাধিক। নিহতদের ২১ জনই মারা যান ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্রে খাদ্য ও ত্রাণ আনতে গিয়ে।
এ নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত প্রায় ২১ মাসে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৬৯৬ জনে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৩৭ হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে জিএইচএফের কেন্দ্রগুলো থেকে খাবার সংগ্রহ করার সময় কমপক্ষে ৭৭১ ফিলিস্তিনি নিহত ও আরও অন্তত পাঁচ হাজার ৬২ জন আহত হয়েছেন। হতাহতদের ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ে গাজার ১৫ হাজারেরও বেশি শিশুকে হত্যা করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের লাগাতার বোমাবর্ষণে বুধবার (৯ জুলাই) সারাদিনে ৭৪ জন এবং বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত আরও ৪৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রের আশেপাশে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে বুধবার আটজন মারা যান। বৃহস্পতিবার নিহত ১৩ জন কেন্দ্রীয় শহর দেইর এল-বালাহে পুষ্টিকর খাবার বিতরণের জন্য লাইনে অপেক্ষা করছিলেন। নিহতদের বেশ কয়েকজন শিশু বলে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা, যার মধ্যে ১০ বছর বয়সী একটি ছেলেও রয়েছে।
চিকিৎসা সূত্রগুলো জানায়, দেইর এল-বালাহে আরও চারজন নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি বিমান থেকে ফেলা বোমার আঘাতে। গাজা শহরের জেইতুনে অন্য একটি হেলিকপ্টার হামলায় নিজেদের বাড়ির বাইরে নিহত হন শিশুসহ চারজন। আল বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের একটি বাড়িতেও বিমান হামলায় চার ফিলিস্তিনি নিহত এবং নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
দেইর এল-বালাহ থেকে পাওয়া ভিডিওচিত্রও প্রকাশ করেছে আল জাজিরা। সেখানকার ব্যস্ততম সড়কে ইসরায়েলি হামলায় রক্ত এবং ছোট কিন্তু খুব গভীর গর্ত দেখা গেছে। ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে মারা যাওয়া একজন ফিলিস্তিনি শিশুর রেখে যাওয়া জুতা এবং কাছের একটি বাড়ির ভাঙা জানালার দৃশ্যও ছিল ভিডিওতে। ইসরায়েলি ড্রোনের টুকরোর অবশিষ্টাংশ বাড়ির দেয়ালেও গর্ত করে। ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন স্থানীয়রা।
এদিকে জিএইচএফ ঘোষণা করেছে, তারা গাজার বেশ কয়েকটি সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রে কার্যক্রম স্থগিত করেছে। আল জাজিরা বলছে, ফলে এখন কেবল একটিমাত্র কেন্দ্র খোলা আছে, গাজার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের চাহিদা মেটাতে যা যথেষ্ট নয়। এর অর্থ হবে, খাদ্য সরবরাহের জন্য মানুষ দক্ষিণাঞ্চলে ভ্রমণ করতে বাধ্য হবে এবং রাফায় দীর্ঘ ও বিপজ্জনক যাত্রা করে প্রায়শই খালি হাতে ফিরে আসবেন।
লোকেরা আল জাজিরাকে জানান, প্রচণ্ড আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই ভাবছেন, পরবর্তীতে কী হতে পারে। একটি কার্যকর জিএইচএফ সাহায্য কেন্দ্র গাজার চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইসরায়েলের অবরোধের মধ্যে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা দাতব্য সংস্থাগুলোর সরবরাহ করা খাদ্য সরবরাহে নির্ভরশীল। অথচ তারা এখন খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গুলিতে মারা যাচ্ছেন। এটা যেন এক নিত্যদিনের ভয়াবহ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে’।
অন্যদিকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি অবরোধে জ্বালানি সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, এই সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং আরও মৃত্যু ও দুর্ভোগ তৈরি করবে অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান হাসপাতাল নাসের হাসপাতাল জানায়, তারা জ্বালানি সংকটে চরম সঙ্কটময় অবস্থায় রয়েছে। হাসপাতালটির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জ্বালানি প্রায় শেষ, চিকিৎসকেরা সময়ের সঙ্গে লড়ছেন। তাপ, ক্লান্তি, ক্ষুধা সত্ত্বেও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ৬০০টিরও বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলার ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে ৩৬টি সাধারণ হাসপাতালের মধ্যে কেবল ১৮টি আংশিকভাবে চালু রয়েছে।
বিবিসি জানায়, গাজার বেশিরভাগ জনগণ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নব্বই শতাংশের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ঘাটতি রয়েছে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ এবং আশ্রয়েরও।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকেই গাজায় অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ)। হামলায় ইসরায়েলে অন্তত এক হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
হামলার জবাবে শুরু হওয়া অভিযানে একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েল। তবে ওই বিরতি ভেঙে ১৮ মার্চ থেকে আবারও গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই আক্রমণে গত প্রায় চার মাসে প্রাণ হারিয়েছেন আরও সাত হাজার ১৩০ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ হাজার ২৩৮ জন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে