প্রধান উপদেষ্টার প্রতি খোলা চিঠি
মহাত্মন,
যথাযথ সম্মানের সঙ্গে জানাচ্ছি, সারাজীবন একজন আইন মান্যকারী সুনাগরিক হিসেবে নির্বিবাদে চলার চেষ্টা করেছি। জীবনের শুরুতে লেখাপড়ার দিকে তেমন আকৃষ্ট হতে পারিনি, পরিবেশও তেমন ছিল না। আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কংগ্রেস এবং চল্লিশের দশকে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে মুসলিম লীগের হাল ধরে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী পাকিস্তানের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। পাকিস্তান হওয়ার আগেই তিনি পরপারে চলে যান। পাকিস্তানের জন্মের আগে আগে ’৪৭ এর ১৪ জুন আমার জন্ম। পাকিস্তানের জন্মের আগে জন্মেছিলাম বলে এক সময় আমার গর্ব হতো যে আমার জন্মের সঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম। ছেলেবেলায় পাকিস্তান দিবসে কত আনন্দ করেছি, গ্রামের বাড়িতে, শহরের বাড়িতে মাটির প্রিদিম জ্বালিয়েছি। কখনো কখনো ছোট ছোট মোমবাতি জ্বালিয়ে বুকের মধ্যে স্বাধীনতার আলো জ্বালাতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছি।
বোঝার বয়স হওয়ার আগেই মায়ের ভাষার ওপর আঘাত আসে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে। কিছুই বুঝতাম না। ৫ বছর বয়সে তেমন কি-বা বুঝা যায়; কিন্তু রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ মাতৃভাষার মর্যাদায় এবং মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় জীবনপণ লড়ে যায়। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের দাবি পাকিস্তান স্বৈর শাসক মেনে নিতে বাধ্য হয়। জ্বলে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। কত ঘটনা ঘটে। ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে সারা দেশ এক হয়ে যায়। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। যে মুসলিম লীগ তার নেতৃত্বে পাকিস্তান এনেছিল, সেই মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ’৫৪-এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টিতে জয়লাভ করে। সেই থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দখলদার সরকার সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের প্রতি কখনো ন্যয়বিচার করার চেষ্টা করেনি। ’৫৪ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারকে কখনো কাজ করতে দেয়নি। ইচ্ছেমতো শেরেবাংলাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে নামিয়েছে, আবার বসিয়েছে।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আতোয়ার রহমান খানকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে, আবার বাদ দেয়া হয়েছে। আবু হোসেন সরকার সকালে মুখ্যমন্ত্রী, বিকেলে গদিহারা। মানুষ যারপরনাই বিক্ষুব্ধ হয়। ’৫৬ সালের এক সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১২ সদস্য নিয়ে ১৩ মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ফিরোজ খান, ইস্কান্দার মির্জা, ’৫৮ সালে আয়ুব খান। এরপর আমরা কখনো পাকিস্তানকে বুকে লালন করতে পারিনি। এর মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ’৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারীতে মহাসম্মেলন ডাকেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তার বঞ্চনা অব্যাহত রাখলে আমরা আস্সালামু আলাইকুম বলতে বাধ্য হবো। কথাটি ছিল ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতো। আজ হয়তো কথাটি বলতে বা লিখতে জীবননাশের কোনো সম্ভাবনা নেই; কিন্তু হুজুর মওলানা ভাসানী যে সময় যে প্রেক্ষাপটে কথাটি বলেছিলেন সেসময় জীবননাশের সমূহ সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তবু তিনি দীপ্ত কণ্ঠে সিংহের তেজে ব্যাগ্রের ক্ষিপ্রতায় কথাটি বলেছিলেন। যেটা দেশের মানুষ মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল।’
এরপর পদ্মা মেঘনা যমুনার পানি বহু গড়িয়েছে। আয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় করে ইংল্যান্ডে হোটেল ম্যানেজার হিসেবে পাঠিয়ে দেন। এরপর ১০ বছর চলে নানা রং তামাশা। আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেই বলে বসেন, পাকিস্তানের জনগণ ভোট দিতে জানে না, তাদের ভোট দেয়া শিখাতে হবে। তাই তিনি বেসিক ডেমোক্রেসি বা বুনিয়াদি গণতন্ত্র নামে সাপের পাঁচ পার মতো এক নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার, পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার মোট ৮০ হাজার সদস্য নির্বাচিত করবেন। তারা হবেন বিডি মেম্বার। তারাই সবাইকে ভোট দিবেন। এ পদ্ধতিও চলে ১০ বছর। বিডি মেম্বারের প্রথম ভোট হয়েছিল ’৬২ সালের ২৮ এপ্রিল। ভোটের আগে বর্ষীয়ান নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বারবার আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন, হে আল্লাহ আমি যে পাকিস্তান বানিয়েছি সেই পাকিস্তানে আমিও ভোটার না। তুমি আমাকে উঠিয়ে নেও। আল্লাহ তার ডাক শুনেছিলেন কিনা বলতে পারব না। তবে ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এ দুনিয়া ত্যাগ করেছিলেন।
এরপর অনেক কিছু হয়েছে। ’৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সেখানে পাকিস্তান নিদারুণভাবে হেরেছিল। তারপরও প্রচার করা হয়েছিল পাকিস্তানের জয় হয়েছে। মিথ্যা প্রচার এমনই হয়। অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে; কিন্তু মিথ্যা কখনো স্থায়ী হয় না। পরিণামে মিথ্যা মিথ্যা হিসেবেই বেরিয়ে আসে এবং যারা মিথ্যা বলে লাভবান হওয়ার ঢেকুর তুলেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষের মন মনন সব থেকে বড় ধাক্কা খায় প্রথমত ’৫২ সালে, তারপর ’৬২ সালের শিক্ষা কমিশনে। ’৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা সেই সময়ের এক বিস্ময়। এরপরের ইতিহাস আরও দ্রুত ’৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের একেবারে অসহায় বোধ করে। কোনো নিরাপত্তা ছিল না। অতবড় একটা যুদ্ধ, তার মধ্যে বড়জোর কয়েকশ, হাজার দুই-তিনের বেশি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। তাদের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র ছিল কিনা তাও বলা যায় না। এরকম অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গর্জে ওঠে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বদল চায়। নৌবাহিনীর সদর দপ্তর করাচি থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামে করতে চায়। তখন দুই-আড়াই লাখ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র ৬-৭ হাজার ছিল বাঙালি।
সেনাবাহিনীতে নৌ-বিমান সীমান্ত রক্ষা সবক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্যের দাবি ওঠে; কিন্তু পাকিস্তান সরকার কোনো দাবিকেই পাত্তা দিতে চায় না। এর মধ্যে ’৬৬ সালের ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। সেখানে অনেক মানুষ জীবন দেয়। যেখানে ছিল শ্রমিকরাই বেশি। তেজগাঁয় মনুমিয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এই সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৬ দফা দাবি পেশ করা হয়। জ্বলে ওঠে উভয় অঞ্চল। ধরপাকড় চলতেই থাকে। অনেকেই জেলে যায়। কেউ আবার বেরিয়ে আসে। আমরা একদিন বাড়িতে খাই তো অন্যদিন আয়ুব খানের জেলে। এর মাঝে ময়মনসিংহের মোনায়েম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন। সে এক বিচিত্র মানুষ। তিনি এক সময় দম্ভ করে বললেন, আমি যতদিন গভর্নর থাকব শেখ মুজিবকে সূর্যের মুখ দেখতে দিব না। তিনি তাই করেছিলেন; কিন্তু সূর্যই বরং তার সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এরপরও চলতে থাকে আন্দোলন, কখনো তীব্র-কখনো ধীর। হঠাৎই ’৬৭ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদ্ভব ঘটে। ৩৫ জনকে আসামি করে প্রথম মামলাটি করা হয়। ১৮ জানুয়ারি ’৬৮ সালে শেখ মুজিবকে ঢাকা কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনীর লোকজন এসে গেট থেকে তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
কিছুদিন আগে সৃষ্ট ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে করা হয় এক নম্বর আসামি। তাতে আসামি হয় ৩৬ জন। মানুষ আরও উতালা হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ চলে রাস্তাঘাটে। মামলার বিচার শুরু হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ যে যা পারে অর্থ সংগ্রহ করে আওয়ামী লীগের তহবিলে দান করতে থাকে। মামলা চালাতে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার আনার চেষ্টা হয়। অন্যদিকে ততদিনে আন্দোলন আরও দানা বাঁধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি ছাত্র-জনতার প্রাণের ধন মাথার মুকুট তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে মানুষ উদ্বেল হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ততদিনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি তৈরি করে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। সে সময় আয়ুব-মোনায়েমের সমর্থক একমাত্র ছাত্র ফেডারেশন ছাড়া আর সব ছিল বাংলার মুক্তির পক্ষে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের পক্ষে। ’৬৮-এর জানুয়ারি থেকে ’৬৯-এর জানুয়ারি পার হতে পারেনি সমস্ত দেশ ফুঁসে ওঠে। ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হয়। মানুষ আরও জ্বলে ওঠে। এরপর তো শুধু আন্দোলন আর আন্দোলন।
’৬৯-এর ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের লৌহ কপাট ভেঙে বেরিয়ে আসেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে বাংলার শৌর্য বীর্যের বরপুত্র তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে তিনি হন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। আন্দোলন চলতে থাকে। মোনায়েম খানের পতন হয়। পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর হন এসএম আহসান। কদিনের মধ্যে আয়ুব খানের বিদায়, ২৪ মার্চ ’৬৯ প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের আগমন। তিনি এসে বললেন আমার রাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে আমি ব্যারাকে ফিরে যাব। তিনি প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ করেন; কিন্তু ঘরোয়া রাজনীতি নয়। পহেলা জানুয়ারি ’৭০ প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হলো। ১১ জানুয়ারি ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পল্টনে বিশাল জনসভা হলো। তারপর শুরু হলো নির্বাচনি তৎপরতা। পূর্ব পাকিস্তানে অসংখ্য দল। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের পরেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির স্থান। যার নেতা হুজুর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সেই প্রথম রেডিও টেলিভিশনে রাজনৈতিক নেতাদের দলীয় বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ হলো। প্রায় সবাই বক্তৃতা করলেন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছিল ততই অন্যান্য দল পিছিয়ে পড়ছিল।
এর মধ্যে হঠাৎই উপকূলীয় এলাকায় শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়। ইয়াহিয়া খান চীন সফরে ছিলেন। চীন থেকে ঢাকা হয়ে তিনি করাচিতে যান; কিন্তু দুর্গত এলাকা বিমান থেকেও দুচোখে দেখার প্রয়োজনবোধ করেননি। এমন উপেক্ষা বাঙালিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। ১২ নভেম্বর যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল সেটা পিছিয়ে নেয়া হয় ৭ ডিসেম্বর। এদিকে হুজুর মওলানা ভাসানী তার দল নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি বলেন, ভোটের আগে ভাত চাই। ভোট ভোট করে যারা ইয়াহিয়ার দালাল তারা, পাকিস্তানের দালাল তারা। জ্বালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও, ভোটের বাক্স পুড়িয়ে দাও। হুজুরের দল যত স্লোগানই দিক প্রত্যক্ষভাবে তারা কেউ জ্বালাতে-পোড়াতে যায়নি।
৭ ডিসেম্বর ’৭০ এক ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়। আমার মনে হয় তখনো পাকিস্তানের পক্ষে ১৫-২০ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল; কিন্তু ভোটে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীক। আর দুই আসন তারাও পাকিস্তানের পক্ষের না। একজন ময়মনসিংহের নান্দাইলের নুরুল আমিন অন্যজন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায়।
এরা দুজনের একজনও সরাসরি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ছিলেন না। নির্বাচনি ফলাফলে বাংলার মানুষ চরমভাবে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। তারা ভাবতে শুরু করে এই বুঝি বঞ্চিত বাংলার মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে। তাদের মান-মর্যাদা, ধন-সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা ফিরে আসবে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে টালবাহানা শুরু করে। ইয়াহিয়া খান এক সময় ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন; কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তার জমিদারি লারকানায় ৫ ঘণ্টা গোপন বৈঠক করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে তখন আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির বৈঠক চলছিল।
অন্যদিকে ঢাকা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় এই প্রথম খেলা বাদ দিয়ে সবাই মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীর সামনে জড়ো হয়। সেখানে গর্জে ওঠা লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশ চায়। অন্যদিকে ২ মার্চ ঢাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় বাংলাদেশের সবুজের ওপর লাল সূর্য তাতে সোনালি রঙের মানচিত্রসহ পতাকা উত্তোলন করেন। পরদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে আহূত পল্টনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ সেখানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধু পৌঁছার আগেই ইশতেহারের এক অংশ পাঠ করা হয়েছিল তাই তিনি আবার তা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, আমার সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত, জয়বাংলা রণধ্বনি- এমনি আরও যা প্রয়োজন একটি রাষ্ট্র গঠনে তার কোনো কিছুই বাদ ছিল না। বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে তেমন কিছু না বলে শুধু বলেন, ‘আমার যা বলার ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলব।’
৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের সবচাইতে বৃহৎ উদ্দীপনাময় সেই সমাবেশে। আগেই প্রচার করা হয়েছিল রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হবে। সেইভাবেই রেডিও-টেলিভিশনে টুংটাং হচ্ছিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু কিছু শোনাও যাচ্ছিল; কিন্তু হঠাৎই বন্ধ করে দেয়া হয়। হয়তো সভাস্থলের কেউ জানতে পারেনি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বন্ধ করে দেয়া হলে রেডিও-টেলিভিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে দেয়। যে কারণে পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ধারণ করা বক্তৃতা প্রচার করা হয়। তিনি বলেন, “ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখ বলে দিয়েছি, ঐ শহীদদের রক্তের ওপর দিয়ে পারা দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদন করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল’ উড্ডো করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে আমরা বসতে পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই।”
ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক সপ্তাহ আলোচনা করেন। কখনো মনে হয় এই বুঝি সমস্যার সাময়িক সমাধান হয়ে যাচ্ছে আবার জট পাকাতে থাকে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান সত্যিকার অর্থেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যান। ইদানীং যখন শুনি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, আমার কাছে কথাটি ব্যাকরণগত শুদ্ধ মনে হয় না। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর ২৬-২৭ জুন সিরাজউদ্দৌলা ভাগীরথী দিয়ে এক সাধারণ নৌকায় মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে ছিলেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ১৭ ঘোড়ার খুড়ের দাপটে মহারাজা লক্ষ্মণ সেন তার রাজধানীর পেছন দরজা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিক্রমপুরে পালিয়ে ছিলেন; কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যাপারটা তেমন হয়নি। তিনি কি করে পালাবেন? তিনি তো বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমানে ভারতের কোনো বিমানবন্দর নয়, বিমান বাহিনীর গাজীয়াবাদ ঘাঁটিতে অবতরণ করেছেন। এটা তো দুই দেশের পারস্পরিক সমঝোতার ফসল।
তা যাই হোক বিশুদ্ধ পালানো ছিল ইয়াহিয়া খানের, বিশুদ্ধ পালানো ছিল নবদ্বীপ থেকে রাজা লক্ষ্মণ সেনের। শেখ হাসিনারটা বিশুদ্ধ পালানো নয়। তাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। যাই হোক ২৫ মার্চের পর দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায়। সারা পৃথিবী হয়তো ভাবেনি নিরস্ত্র মানুষের ওপর একটা সশস্ত্র বাহিনী ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আমরা যে যাই বলি, ’৭১-এর ২৫ মার্চের বর্বর হত্যাকাণ্ড ছিল সবার কাছে অকল্পনীয়। ২৫ মার্চ এক রাতেই সারা দেশে ৪-৫ লাখ নিরীহ নির্বিবাদী মানুষ নিহত হয়েছিল। তারপরও বাঙালিরা মাথানত করেনি। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, বঙ্গবন্ধু সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকা যুদ্ধের জন্য ক্ষতি হয়েছিল; কিন্তু আমার ধারণায় আমাদের অন্য নেতাদের মতো বঙ্গবন্ধু যদি ভারতে আশ্রয় নিতেন ভারতের দালাল বলে পাকিস্তানিরা যতটা সোচ্চার প্রোপাগান্ডা করেছে তাতে তাদের প্রোপাগান্ডা আরও জোরদার হতো, গ্রহণযোগ্যতা পেত। তাতে ৯ মাস তো দূরের কথা ৯ বছরেও আমরা স্বাধীন হতাম কিনা সন্দেহ ছিল।
এক সাগর রক্ত ঢেলে ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, পাকিস্তানি সামরিক শক্তিকে পরাজিত করেছিলাম সত্য; কিন্তু পাকিস্তানি অন্য শক্তিগুলো যেমন- রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোথাও আমরা নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে পারিনি। পাকিস্তানের পক্ষের ব্যবসায়ীরা নির্বিবাদেই ছিল, সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক জগৎ আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছিল। নানা কারণে স্বাধীনতার পরও ‘যে লাউ সেই কদু’ তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন পাকিস্তানি প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে। তার পক্ষে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না, তাই পারেনওনি।
মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে পারিনি; কিন্তু রক্ত দিয়েছি। সেই দেশ ভালো হবে না, মানুষের মুক্তি হবে না ভাবতেও কেমন যেন বুকের ভেতর তোলপাড় করে। আমরা শুরু থেকেই ভুল করে চলেছিলাম, এখনো সে ভুলের শেষ হয়নি। কবে হবে তাও খুব একটা জোর দিয়ে বলতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। বিজয়ী নেতৃত্বে ছিল মুজিবনগর বিপ্লবী সরকার। অনেক জায়গায় শোনা যায় পূর্ব পাকিস্তান সরকার মুজিবনগর সরকারে মিলেমিশে বিলীন হয়ে যায়নি। বরং পরাজিত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এ যদি সত্য হয় তাহলে আমাদের অস্তিত্ব কোথায়?
১০ জানুয়ারি ৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। ২৪ জানুয়ারি ’৭২ পিতার এক কথায় কাদেরিয়া বাহিনীর সমস্ত অস্ত্র তার পায়ের কাছে জমা দেয়। দেশ ভালো চলছিল না, চলার কথাও না। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন পরাশক্তিকে পরাজিত করে কেউ কখনো অমন দুর্বার বিজয় অর্জন করেনি যেটা আমরা করেছিলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোনো সময়ই এমন পরাশক্তি অতটা নিদারুণভাবে পরাজিত হয়নি যেমনটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা, চীন, ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য আরব দেশগুলো কেউ আমাদের সমর্থন করেনি। একমাত্র ভারত এবং রাশিয়া মুক্তিকামী মানুষের বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। যে যাই ভাবুন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করা হয়েছিল।
১৫ আগস্ট তাকে অমন নির্মমভাবে হত্যা করা না গেলে রাজনৈতিকভাবে তার চরিত্র হনন করা হতো। চরিত্র হননের আপ্রাণ চেষ্টাও হয়েছে। দুর্নীতিবাজ সে যত চেষ্টাই করুক এক সময় তার দুর্নীতি ঢেকে রাখতে পারে না। আর যে বা যাকে দুর্নীতি স্পর্শ করে না বা করতে পারে না শত চেষ্টা করেও তাকে দুর্নীতিবাজ বানানো যায় না। বিগত পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা শতবার বলেছেন, জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন তখন তিনি ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি রেখে গিয়েছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্ম তারেক রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করার জন্য। জিয়াউর রহমান যেখানে ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি রেখে গেলেন তার বংশধররা এত সম্পদ পেল কোথা থেকে? বিগত সরকার প্রধান শেখ হাসিনার কথাই যদি সত্য হয়, তাহলে তো তার স্বজনরা কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ হতে পারেন; কিন্তু জিয়াউর রহমান নন। তিনি দুর্নীতিমুক্ত পূত-পবিত্র একজন স্বচ্ছ মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও অমন বলা হয়েছিল; কিন্তু তার মৃত্যুর ৫০ বছর পরও ২৭ হাজার টাকার বেশি সম্পদ কেউ বের করতে পারেনি।
তাই বঙ্গবন্ধুর ৫০তম মৃত্যুদিনে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমার রাজনৈতিক পিতা রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আত্মার শান্তি কামনায় একজন মুসলমান এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাসুলে কারীম (সা.)-এর উদ্দেশ্যে পবিত্র মিলাদ শরিফের আয়োজন করায় টাঙ্গাইল পুলিশ অনাহুতভাবে আমার ব্যক্তিগত বৈঠকখানায় আয়োজিত পবিত্র মিলাদ শরিফে বাধার সৃষ্টি করে। একজন মহান নেতার মহাপ্রয়াণে মুসলমান হিসেবে দোয়া-খায়ের করা ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুলিশের বাধা কতটা আইনানুগ বা যুক্তিযুক্ত? আমরা যদি ব্যক্তি পর্যায়ে মিলাদ মাহফিলটি না করে সামাজিক বা রাজনৈতিক পর্যায়ে করতাম তাহলে অবশ্যই প্রশাসনিক সহযোগিতার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে লিখতাম। তারা সেখানে আইবি, ডিআইবি যাকে যেখানে নিয়োগ করার করতেন; কিন্তু ৮০ ঊর্ধ্ব একজন সুনাগরিক এবং মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে সর্বোচ্চ সাহসীকতা খেতাবপ্রাপ্ত বীর উত্তমের বাড়িতে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ কতটা আইনানুগ-কতটা যুক্তিযুক্ত? আদালতের নির্দেশ থাকলে আমার বলার কিছু থাকতো না। প্রশাসন থেকে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা দিলে আপত্তি জানালে আপনাকে কিছু বলতে যেতাম না।
এক সময় শেখ হাসিনার সরকারের আমলে আপনি যথেষ্ট নিগৃহীত হয়েছেন। এমনিতে আপনাকে আমি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখি। আপনার গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম আমার বাড়ির পাশে আকুরটাকুরপাড়ায় সেজন্য আমি খুবই গর্বিত। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর যখন আঘাত আসে তখন ড. কামাল হোসেনের অনুরোধে উল্কার মতো আপনার পাশে ছুটে গিয়েছি। যখন যেভাবে যেখানে প্রতিবাদ করার কথা সেখানে সেভাবেই প্রতিবাদ করেছি। আমার কি হবে, আমাদের দলের কি হবে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি। জানি সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখার সময় আপনার এখন খুবই কম; কিন্তু তবু বলতে ইচ্ছে করে, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি যেদিন ভাঙা হলো মুক্তিযুদ্ধের এই ঠিকানা বাঙালির অস্তিত্ব বাঙালির বিশ্বাস সেদিন কি আপনি এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য রক্ষার কোনো চেষ্টা করেছেন? নাকি এ ভাঙায় আপনার সম্মতি ছিল? আপনি যদি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙা থেকে ফেরাতে অপারগ হয়ে থাকেন তাহলে আমার তেমন কিছু বলার নেই; কিন্তু যদি আপনার সম্পৃক্ততা থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই বলবো, আপনার গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে যখন এক দুর্বার আন্দোলন হচ্ছিল তখন আমি এবং আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে না দাঁড়ালে আপনার শ্রমে ঘামে গড়া অর্ধেক গ্রামীণ ব্যাংক ৭০ হাত মাটির নিচে ধ্বংস হয়ে যেত।
অর্ধেক বলি কেন, আরও অনেক বেশি ধ্বংস হতে পারত। কত জায়গায় কত পত্রিকায় আমাকে ঘিরে আমাদের দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে ঘিরে কতবার বলেছেন, কাদের সিদ্দিকী আমাদের পাশে দাঁড়ানোয় আমরা শক্তি পেয়েছি। তার দল আমাদের সঙ্গে কথা বলায় আমরা সাহসী হয়েছি। অথচ ১ বছর ১ মাস আপনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। মাত্র কয়েকটি দলের সঙ্গে রাতদিন আলোচনা করছেন, আমাদের অনেককেই খরচের খাতায় ফেলে রেখেছেন- এটা আপনার মতো দক্ষ যোগ্য খ্যাতিমান ব্যক্তির কাছে আশা করা যায় না। শুধু স্বৈরাচার স্বৈরাচার আর স্বৈরাচারের দোসর বলে জাতিকে বিভক্ত করবেন না। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা এক না। বাংলার অন্তরাত্মা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবে বিলীন হয়ে আছে। দেশের সিংহভাগ মানুষ স্বাধীনতা চায়, মুক্তিযুদ্ধ চায়, বঙ্গবন্ধু-জয়বাংলা চায়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে জয়বাংলা স্লোগান দেয়ায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারাই প্রকৃত মানুষ। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবে ব্রিটিশরা যাদের ফাঁসি দিয়ে মুর্শিদাবাদ বহরমপুরের রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার বাবলা গাছে ঝুলিয়ে ছিল আজ তাদেরই সারা পৃথিবী সম্মান করে, ব্রিটিশের ফাঁসি দেয়াকে করে না। শত বছরর পরে হলেও তেমনটাই হবে। জয়বাংলা স্লোগানে যারা জেলে পুড়েছে তারা নিন্দিত হবে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যারা ভেঙেছে তারা বাঙালির হৃদয় ভেঙেছে এজন্য ইতিহাসের কাছে দায়ী হতে হবে।
আমি একজন মুসলমান হিসেবে কোনো স্ট্যাচু পছন্দ করি না, কোনো মুর্তি সমর্থন করি না; কিন্তু তারপরও বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু ভাঙা বঙ্গবন্ধুর মাথায় পেশাব করা মুক্তিযুদ্ধ এবং যোদ্ধাদের মাথায় পেশাব করার শামিল। এক অর্থে আমার মাথাতেও পেশাব করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের মাথায় পেশাব করা হয়েছে, বাঙালি জাতির মাথায় পেশাব করা হয়েছে। শরিয়তমত এ এক ঘোরতর অন্যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা দেয়া হয়েছে। অথচ সরকার নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে এটা কিসের ইঙ্গিত? একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে আপনার মাধ্যমে এসবের প্রতিকার আশা করি।
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন দিতে চেয়েছেন। অবাধ নিরপেক্ষ একটি ভালো নির্বাচন করতে পারলে যত যা কিছুই হোক আপনি জাতির সামনে একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি হয়ে থাকবেন। যে যত কথাই বলুক, বাংলাদেশের মানুষ স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া তেমন আর কিছুই চায় না। এত রক্ত ক্ষয় এত যুদ্ধ বিগ্রহ ’৭১-এ পাকিস্তানিরা বাঙালির ভোটের রায় মেনে নিলে তখনো অমনটা হতো না। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের ভোটের রায় মানাবার জন্য এত রক্ত কোন দেশ বা জাতি দেয়নি।
আপনি একজন যোগ্য দক্ষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণী মানুষ। তাই অনেক কিছু লিখলাম। যদি বাঁশি আর না বাঁজে, আর যদি কলম না চলে, লেখার সুযোগ না পাই তাই আপনার অমূল্য সময় নষ্ট করার জন্য সত্যিই আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবু যা বলার কিছুটা চেষ্টা করলাম। আপনি বিবেচনা করে দেখবেন। সব কথা সব সময় সবাইকে বলা যায় না। আপনাকে বলা যায় বা বলা উচিত অন্তরের অন্তস্থল থেকে এমন তাগিদবোধে আপনার সমীপে আমার এই নিবেদন।
ধন্যবাদ
আপনারই একান্ত
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে