Views Bangladesh Logo

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস

সিআরপি প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর এর সাথে একটি বিকেল

Maria Salam

মারিয়া সালাম

জ (৩ ডিসেম্বর) বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হচ্ছে। এই দিনে এমন একজন মানুষের কথা তুলে ধরতে চাই, যিনি তার কাজের মাধ্যমে আমার মতো হাজারও মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ যখন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মতো গুরুতর সমস্যার সাথে লড়াই করে ক্লান্ত, এই বিষয়ে ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই হাতে আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হন ভ্যালেরি অ্যান টেইলর।

প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের যাত্রা ভিন্ন। লক্ষ্যও ভিন্ন। এই ভিন্নতার মধ্যেও কিছু মানুষ এমন অনন্য হয়ে ওঠেন যে, তারা অন্যদের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠেন। সেই রকম একজন মানুষ ফিজিওথেরাপিস্ট ও সমাজসেবী ভ্যালেরি অ্যান টেইলর। বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানবতার জন্য তার অসামান্য অবদান তাকে দেশে ও বিদেশে সম্মানিত করেছে। নিজের জীবনের সবটা বিলিয়ে দিয়ে তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের পাশাপাশি পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে গেছেন। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশের মাদার তেরেসা খ্যাত এই মহীয়সী বৃটিশ সমাজসেবীর সাথে কয়েক বছর আগে পুরা একটা বিকেল কাটানোর সুযোগ হয়েছিল আমার। সেই সুযোগটা খুব অদ্ভুতভাবেই এসেছিল, সেটা ভিন্ন গল্প। আজ এটুকুই বলব, আমি কঠিন একটা বিপদে পড়েই তার সহযোগিতা প্রার্থনা করেছিলাম। আমার মতো সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের ডাকে তিনি এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে সাড়া দিয়েছিলেন। এভাবেই আমাদের মধ্যে কথোপকথনের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। একদিন বিকেলে আমরা মুখোমুখি বসেছিলাম। শুনেছিলাম সিস্টার ভেলরির সাফল্য, সংগ্রাম ও জীবনের আখ্যান।

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছেন সিস্টার ভ্যালেরি। কৌতূহলের বশেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তিনি ভিনদেশি মানুষদের জন্য এভাবে নিজের সবটা উজার করে দিলেন? একটু হেসে তিনি বললেন, এই দেশের মাটিতে যেদিন পা রেখেছি, সেদিনই তোমাদের এই সুন্দর দেশটার প্রেমে পড়ে গেছি। সালটা ১৯৬৯। ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) নিয়ে এখানে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করতে এসেছিলাম। শুরুতেই যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে ব্যথিত করেছিল, সেটা ছিল মেরুদণ্ডের আঘাতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় অবহেলা। সে অর্থে তাদের চিকিৎসা করার মতো কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এসব মানুষদের অসহায়ত্ব এমনভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছিল, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য কিছু একটা করার জন্য আমার মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল।

একটু থেমে তিনি আবার কথা শুরু করলেন, আমি সত্যিই অসহায় পক্ষাঘাতগ্রস্তদের কষ্ট লাঘব করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আমি দেশে ফিরে যাই। কিন্তু চট্টগ্রামের সেই ১৫ মাসের সময়টা আমাকে বারবার এখানকার অসহায় মানুষদের দুর্দশার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সেই সময়ই আমি বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিই।

উনি এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)। সেই স্মৃতিচারণও করলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে আমি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসি। সময়টা খুবই নাজুক ছিল। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের মধ্যে যুদ্ধাহত অনেকেই ছিল। কিন্তু তাদের সেবা দেবার মতো আমার সামর্থ্য ছিল না, অর্থনৈতিক অনটন ছিল। তাই ১৯৭৩ সালে তহবিল সংগ্রহের জন্য আবার ইংল্যান্ডে যাই। ১৯৭৫ সালে যখন ঢাকায় ফিরে আসি তখনও খুব সামান্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারি, যা দিয়ে আসলে পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, কিন্তু অসহায় মানুষের কথা চিন্তা করে আমি হতাশ হই না। প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাই। সিআরপি প্রতিষ্ঠার জন্য এরপর আমাকে আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৭৯ সালে সিআরপি যাত্রা শুরু করে। আমাদের ঠিকানা হলো ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাঠের দুটি সিমেন্টের গুদাম। এরপর ১৯৯০ সালে সাভারে ১৩ একর জায়গায় এই স্থায়ী কাঠামো স্থাপন করতে সক্ষম হই।

এই পুরা সময়টার সেই যাত্রা খুব একটা মসৃণ ছিল না। সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে উনি বললেন, আমাদের এই ২১ বছরের যাত্রা সহজ ছিল না। আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, বিশেষ করে স্থায়ী জমি আর ভবন নির্মাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করাটাই কঠিন ছিল। আমি ও আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ধাপে ধাপে এই সমস্ত কাজ করেছি। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পেতেও প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। এসময় প্রাথমিকভাবে পাশে ছিল বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত সাহায্য ও উন্নয়ন দাতব্য সংস্থা অক্সফাম।

কথা বলার এই পর্যায়ে সিস্টার কিছুক্ষণ থামলেন। কিছুটা উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখলেন। ভবনের ঠিক পাশেই মাঠে বেশ কিছু সুবিধাবঞ্চিত শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার শিশু ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলা করছিল। বাচ্চাদের হাসিমুখ দেখে সিস্টারের মুখে একটা প্রশান্তি দেখা গেল। তিনি বললেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বিশ্বজুড়েই সমাজ জীবনের একটা অংশ। কিন্তু বাংলাদেশে দারিদ্র্যের কারণে এই পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে ওঠে এবং শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একারণেই আমাদের একটা লক্ষ্য থাকে রোগীকে, চিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসন সহায়তা সেবা প্রদান করা। সঠিক প্রশিক্ষণ আর অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। আর এজন্য আমরা নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করে থাকি।

`সচেতনতা ও সহানুভূতির অভাব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। তাই, আমরা জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবন্ধীতা সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।

প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয়ে কথা উঠতেই আমার মনে পড়ে গেল, তিনি প্রতিবন্ধকতার শিকার শিশুদের জন্য একটি আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশে উনিই প্রথম এই উদ্যোগ নেন। ভ্যালেরি তার বাবা উইলিয়াম ও মা মেরি টেইলরের নামে স্কুলটির নামকরণ করেন। স্কুলের কথা উঠতেই তিনি বলেন, এখন আমাদের আবাসিক ও অনাবাসিক দুই ধরনের শিক্ষার্থীই আছে।

এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুব নিদারুণ সত্যের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। এই পর্যায়ে আমি সেটা নিয়েই সরাসরি একটা প্রশ্ন করে ফেলি, সংবাদপত্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন এরকম অনেক শিশুকে ফেলে যাচ্ছে আর আপনি তাদের অনেককেই পুনর্বাসন করেছেন। এই অভাগা শিশুদের জন্য স্থায়ীভাবে কোনো প্রকল্প হাতে নিতে চান?

আমার উদ্বেগের বিষয়টা উনি মনে হয় বুঝতে পারলেন। উনি আশ্বস্ত করলেন, অবশ্যই, আমরা এসব শিশুদের আশ্রয় দিতে চাই, তাদের বিশেষ শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করতে চাই। আমরা আমাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে এমন কিছু শিশুকে লালন-পালন করছি। মাঝে মাঝে কিছু কোরিয়ান নান আমাদের সাহায্য করে। এরকম পরিত্যক্ত শিশুদের তারা বিশেষ সেবা দেয়। প্রয়োজনীয় তহবিল আর সহায়তা পেলে অবশ্যই বড় আকারে কিছু করতে পারব।

এরপর আমরা পুরো বিকেল আরও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে কাটালাম। বিদায় নেবার সময় শক্ত করে সিস্টারের হাত ধরে বললাম, আমি আপনাকে খুব সম্মান করি। আপনি আমার মতো হাজারও মানুষের সামনে আমার এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।

তিনি মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, মারিয়া, আমি শুধু বলতে চাই যে, আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি এবং আমি খুশি যে আমি মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য কিছু করতে পেরেছি। আমাদের প্রতি এদেশের মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সমর্থনের বিষয়টা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সবসময়। এই দেশের মানুষই আমার পরিবার। আমার দুই প্রতিবন্ধী দত্তক কন্যা পপি ও জয়তি আমার পরিবার, তোমরা আমার পরিবার।

উল্লেখ্য, ভ্যালেরি অ্যান টেইলর ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফিজিওথেরাপিস্ট ও সমাজসেবী। তিনি ঢাকা জেলার সাভারে অবস্থিত সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজডের (সিআরপি) প্রতিষ্ঠাতা। সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ