Views Bangladesh Logo

ছোটগল্প

একটি আষাঢ়ে গল্প

Selina Hossain

সেলিনা হোসেন

রকারি পদমর্যাদায় তিনি একটি বাড়ি পেয়েছেন। বাড়িটির পাশে আছে একটি ছোট জলাশয়। তৈরি করা জলাশয়। এর চারপাশ পাতা ও সবুজ গাছের সারি দিয়ে ভরা। তিনি ভাবলেন, এই জলাশয়ে নানা রঙের পদ্মফুল ফুটলে অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হবে। তিনি মনে মনে আরও উৎফুল্ল হন এই ভেবে যে তার অনেক পোষা হাঁস আছে, সেগুলো জলাশয়ে নামলে পাখি আর ফুল মিলে স্বর্গীয় দৃশ্য তৈরি হবে এবং প্রতিদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে তিনি ঘুমাতে যাবেন।


তিনি জানেন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে জনগণের জন্য কাজ করতে হলে রাতে গভীর ঘুমের দরকার হয়। যেভাবে ভাবছেন, সেভাবে কাজ করবেন বলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি বিরক্তি বোধ করেন। নতুন বাড়িতে তার পোষা হাঁসের জন্য কোনো ঘর নেই। তিনি তার সেক্রেটারিকে বলেন, সরকারি লোকগুলো আসলে খুব বেআক্কেল। পোষা প্রাণীর জন্য তাদের কোনো ঘর নেই। সেক্রেটারি মাথা নামিয়ে অনুগত স্বরে বলে, জি হুজুর, ঠিকই বলেছেন। সরকারি বাড়িতে গরুর জন্য কাউশেড, কুকুরের জন্য ডগহাউস ইত্যাদি থাকা উচিত। আপনার কথা শুনে আমার নিজেকে ছাগল মনে হচ্ছে হুজুর।


হবেই তো, আপনি নিজেই একজন সরকারি কর্মকর্তা না! আমরা হলাম জনপ্রতিনিধি। যান, নথি নিয়ে আসেন। হাঁসের জন্য একটি সরকারি ঘরের প্রয়োজন দেখিয়ে নথি উপস্থাপন করুন।
চলে যান সেক্রেটারি। আর তিনি উৎফুলচিত্তে ভাবেন, একটি যথাযথ কাজের নির্দেশ দিতে পেরেছেন। এমনি তো হওয়া উচিত। পোষা প্রাণী রাতের বেলা ঘরেই রাতযাপন করবে, রাজ্যের সরকার যদি না বোঝে তো বুঝবে কে? রাজ্যের গরিব প্রজারা? তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।


একদিন লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে ছোট একটা ঘর বানানো হয়। ঘরের ছাদে মণিমুক্তা বসিয়ে নকশা করা হয়। ঘর দেখে তিনি মহাখুশি। ভাবলেন, চমৎকার হয়েছে। গরিব প্রজাদের করের টাকা অসহায় প্রাণীকুলের জন্য ব্যয় করা তো রাজ্যের সরকারের দায়িত্ব। আর তিনি তো সরকারের অন্যতম কেউ। ইদানীং বারান্দায় দাঁড়িয়ে জলাশয়ে হাঁস আর পদ্মফুলের অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য খেলে তার দিনের বেলায়ও ঘুম পায়। ঘুম ভাঙলে কিছুক্ষণ দপ্তরের কাজ করেন। রাত নামলে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, তোমার কি শরীর খারাপ?
না তো!
তাহলে এত ঘুমাচ্ছ?
ঘুম নয়, এটা আমার বিনোদন। কারণ, রাজ্যে আমি একটা অসাধারণ সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পেরেছি।
কি যে বলো না! দেশের মানুষের পেটে ভাত নেই, আর তুমি হাঁসের জন্য বাহারি ঘর বানিয়েছ। তোমার ওই লেকের দিকে তাকালে আমার ঘুম আসে না।
তার স্ত্রী আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে চলে যায়।


স্ত্রী তার কাজের মূল্যায়ন করতে পারেনি দেখে তিনি খুব আহত হন; কিন্তু মন খারাপ হওয়াকে একটুও প্রশ্রয় দেন না। তার চারপাশে যারা আছে, তারা তাকে সব সময় বাহবা য়ে। তারাই সত্যিকারভাবে তার কাজের মূল্যায়ন করতে পারে। তারাই তো বলে, হুজুরের মতো মানুষ হয় না। দেশের চিন্তায়, মানুষের চিন্তায় তিনিতো সবসময় অস্থির থাকেন। এসব শুনলে তার চোখ বুঁজে আসে। তিনি ভাবেন, ওরা আছে বলেই তো তার বেঁচে থাকার সাধ পূর্ণ হয়। তার আয়ু বেড়ে যায়। স্ত্রী কি বলল না বলল এসব হিসাব করলে তো দেশের উন্নতির জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা করা যাবে না। স্ত্রীকে গুরুত্ব দেবেন বিছানায় ও রান্নাঘরে। তাও না দিলে হয়। মেয়ে মানুষের তো অভাব নেই। আসলে তিনি বুঝতে পারেন স্ত্রীর কথায় তিনি আহত হয়েছেন। তাই তার চিন্তাকে অন্যদিকে ধাবিত হতে না দিয়ে নতুন কিছু করার চিন্তা করতে শুরু করেন।

মাস দুয়েক পরের কথা।
একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসতেই দেখতে পান শত শত নেংটি পরা মানুষ বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে। বুক-পিঠের হাড়গোড় বেরিয়ে থাকা মানুষগুলোকে তো ভোট চাওয়ার সময় দরকার হয়। এখন ওরা কি চায়? তিনি অবাক হন এবং বিরক্তি বোধ করেন। কথা নেই, বার্তা নেই তার বাড়ির সামনেই জড়ো হলো হাভাতের দল কোথাকার, বছর বছর সংখ্যায় দ্বিগুণ হতে থাকে। পরিবার-পরিকল্পনাটাও ঠিকমতো বুঝতে পারে না। যত্তসব।
গার্ড এসে বলে, হুজুর ওরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
তিনি রাগান্বিত স্বরে বলেন, ওরা কী চায় এখানে? সব গাঁইয়া ভূত। ওদের এত সাহস যে আমার বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে।
হুজুর ওরা আপনাকে চায়। ওরা আপনার হাঁসের জন্য সোনার ধান নিয়ে এসেছে। ওরা ওগুলো আপনার পায়ের কাছে রাখতে চায়।
সোনার ধান?
হ্যাঁ, হুজুর। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
তিনি কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামেন। লোকেরা সারিবদ্ধভাবে এসে নিজেদের হাতে ধরা পুঁটলিটা তার পায়ের কাছে রেখে একপাশে সরে দাঁড়ায়। তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত উঁচু করে রাখেন। লোভে তার চোখ চকচক করে।
ধানের পুঁটলি দেয়া শেষ হলে একজন বলে, হুজুর, আমরা পত্রিকায় দেখছি আপনি হাঁসের জন্য সোনার ঘর বানিয়েছেন। আমরা ভাবলাম, সোনার হাঁসের জন্য সোনার ধান দরকার। তাই আমরা সোনার ধান ফলিয়েছি, হুজুর। এ বছর আমাদের ঘরে আর ভাতের ধান থাকবে না।
তিনি মুচকি হেসে বলেন, সারা বছর ভাত না খেলে আর কী হবে। রুটি খাবেন। তরিতরকারি সেদ্ধ খাবেন। হবে না? হবে, হুজুর, হবে।
তখন সবাই চিৎকার করে বলে, হুজুর, সোনার ধান খেয়ে আপনার হাঁস সোনার ডিম পাড়বে।
সোনার ডিম!
হ্যাঁ, হুজুর, সোনার ডিম।
সোনার ডিম দেখার জন্য আমরা সবাই আসব, হুজুর। আজ যাই আমরা।
মুহূর্তে খালি হয়ে যায় বাড়ির সামনের মাঠ।
তার হাতটি যেন দশটি হাত হয়ে যায়। তিনি সোনার ধানে ভরা পুঁটলি নিয়ে ঘরে আসেন। নিজের ঘরের আলমারিতে বোঝাই করে রাখেন। পেছনে স্ত্রী এসে দাঁড়ায়। বলে, শুনলাম তোমার হাঁসের জন্য সোনার ধান এসেছে? প্রজারা নিজেরা না খেয়ে সোনার ধান ফলিয়েছে? সেই ধান খেয়ে তোমার হাঁসেরা সোনার ডিম পাড়বে?
ঠিকই শুনেছ।
কিন্তু শোবার ঘরের আলমারি কি সোনার ধান রাখার জায়গা?
তিনি কড়া চোখে স্ত্রীর দিকে তাকান। জবাব দেন না।
স্ত্রী আবার বলে, ধানগুলো হাঁসের পেটে যাবে তো? না গেলে জনগণের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।
খামোশ! বেশি কথা বলবে না।
না, তোমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।
দুজন দুুই দিকে চলে যায়। তিনি ভীষণ বিরক্ত। স্ত্রী তার কাজে হস্তক্ষেপ করে বলে তিনি মেজাজ ঠিক রাখতে পারছেন না। তিনি তারপরও ভাবেন, তার অনুগত প্রজারা জীবনভর না খেয়ে তার হাঁসের জন্য সোনার ধান ফলাবে। একদিন সোনার ধানের পাহাড় বানাবেন তিনি। আহ, কী শান্তি! তখন তিনি এই স্ত্রীকে বিদায় করে দেবেন। এই মেয়েমানুষটি সাধারণ মানুষের পক্ষে বেশি কথা বলে, যা একদম অসহ্য।

দিন যায়, মাস যায়।
গাঁয়ের মানুষ এসে বাড়ির সামনে ভিড় জমায়।
হুজুর, আমরা হাঁসের সোনার ডিম দেখতে চাই।
তিনি রাগত স্বরে বলেন, হাঁস তো সোনার ডিম পাড়েনি।
জনগণ চিৎকার করে বলে, সোনার ধান খেলে তো হাঁসকে সোনার ডিম পাড়তেই হবে।
তাহলে কি হাঁসকে সোনার ধান খাওয়ানো হয়নি?
যদি হাঁসকে খাওয়ানো না হয়ে থাকে, তাহলে সোনার ধান গেল কোথায়? কে খেল সোনার ধান?
তিনি চিৎকার করে বলেন, আহ্ তোমরা চুপ কর। তোমরা এখন যাও।
আমরা এখন চলে যাচ্ছি, হুজুর; কিন্তু আবার আসব। আমরা গায়ের রক্ত পানি করে সোনার ধান উৎপাদন করেছি। আমরা হাঁসের সোনার ডিম চাই।
শূন্য হয়ে যায় মাঠ। যেন এটি একটি অলৌকিক দৃশ্য। নেংটি পরা মানুষগুলোর এমন বেয়াদবি তাকে বিস্মিত করে। তার ক্রোধ বাড়তে থাকে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলে দেখতে পান, সিঁড়ির মাথায় তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে তিনি শান্ত কণ্ঠে বলেন, যে হাঁস প্রতিদিন খুদকুঁড়ো খায়, সে হাঁসের পেটে সোনার ডিম আসবে কোথা থেকে?
তিনি শীতল গম্ভীর গলায় বলেন, এর জবাব তোমাকে আমি দেব!
স্ত্রী ব্যগ্র স্বরে বলে, তোমার কি জবাব আছে?
আছে কি নেই তা টের পাবে।
তিনি বারান্দায় দাঁড়ান। হাঁসের দলের জলকেলির অপরূপ দৃশ্যের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন।
পরদিন বাড়ির গার্ড এসে বলে, হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা দুটো হাঁস নিয়ে গেছে!
নিয়ে গেছে? তোমাদের বন্দুক নেই?
ওরা মেশিনগান নিয়ে এসেছিল, হুজুর। ওরা বলেছে, রাজ্যজুড়ে খবর হয়েছে যে হাঁসেরা সোনার ডিম পাড়বে। আমরা ওদের পেট থেকে সোনার ডিম বের করব। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন করে? বলল, জবাই করে।
জবাই করে? তিনি আঁতকে ওঠেন।
জি হুজুর। আরও বলেছে, ডিম বের করে নিয়ে হাঁস দুটোকে রান্না করে খাবে।
তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। সারা দিন তার অবসন্নের মতো কাটে।
মাস যায়। বছর যায়। পাঁচ বছর চলে যায়।
নেংটিপরা মানুষগুলো তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। সোনার ধান ফলিয়ে নিয়ে আসে। একদিন সকালবেলা তারা তার বাড়ির সামনে জড়ো হয়। এবার তারা দ্বিগুণ হয়ে এসেছে। তিনি ওপর থেকে দেখতে পান হাজার হাজার মানুষের সাদা-কালো মাথা। মানুষ গিজগিজ করছে। চিৎকার করছে।
নেমে আসুন। আমাদের সামনে আসুন। আমরা সোনার ডিমের হিস্যা চাই।
তিনি চিৎকার করে বলেন, হাঁস সোনার ডিম পাড়েনি।
আমরা শুনেছি, আপনি হাঁসগুলোকে সোনার ধান দেননি। আপনি ঘরের মধ্যে সোনার ধান জমিয়ে রেখেছেন। ওগুলো আপনি সঞ্চয় করেছেন। সোনার ধান বিক্রি করে ব্যবসা করবেন।
গার্ড, বন্দুক আনো। এরা বড় কথা বলছে।
বন্দুকে আর কয়টা গুলি হুজুর? তার চেয়ে মানুষের সংখ্যা এখানে বেশি। মেরে শেষ করতে পারবেন না।
গার্ড গুলি কর। শেষ করে দাও এদের। এরা বাড়িবাড়ি করছে।
গার্ড গুলি ছুড়তে চায়; কিন্তু গুলি বের হয় না।
হা হা হাসির তরঙ্গধ্বনি ওঠে জনতার সমুদ্রে।
নেংটিপরা মানুষেরা তাকে ধরে নিয়ে আসে।
তারপর তার রক্তাক্ত শরীরটা বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে রাজ্য প্রদক্ষিণে যায় ওরা। তিনি নিজে একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার শরীর থেকে টুপটাপ রক্ত ঝরে রাজপথে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ