বিমানের ‘মে ডে’ সংকেত: আকাশে আতঙ্কের প্রতিধ্বনি
‘মে ডে… মে ডে… মে ডে…’
‘নো পাওয়ার… নো থ্রাস্ট… গোয়িং ডাউন’
মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের একটি বার্তা। আকাশে ভাসতে ভাসতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন পাইলট সুমিত সবরওয়াল। তখনই নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বার্তাটি পাঠান তিনি। সেটিই ছিল তার শেষ কণ্ঠ। এরপরই বিধ্বস্ত হয় এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারটি। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন ধ্বংসস্তূপ- আহমেদাবাদের আকাশে সেই মুহূর্তে নেমে এসেছিল নিঃশব্দ বিভীষিকা।
গত বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের আহমেদাবাদ থেকে যুক্তরাজ্যের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হয় ফ্লাইটটি। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘যান্ত্রিক ত্রুটিতে’ পড়ে ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু বহনকারী উড়োজাহাজটি। স্বাভাবিক উচ্চতায় উঠতে ব্যর্থ হয় বিমানটি। পাইলট জরুরি সংকেত পাঠান- ‘মে ডে, মে ডে, মে ডে’। এরপরই সেটি দ্রুত নিচে নেমে আসে এবং বিস্ফোরিত হয়ে আগুনে জ্বলে ওঠে। মুহূর্তেই মৃত্যু আর আতঙ্কে ভরে ওঠে চারপাশ।
এই ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে অনেকেই আবার জানতে চেয়েছেন- ‘মে ডে কল’ আসলে কী? কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? এবং কেনই বা এটি ব্যবহৃত হয়?
‘মে ডে’ হলো একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জরুরি সংকেত, যা বিমান বা নৌযান ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হলে ব্যবহার করা হয়। শব্দটির উৎস ফরাসি ভাষার ‘m’aider’, যার অর্থ- ‘আমাকে সাহায্য করুন’। ১৯২৩ সালে ব্রিটেনে প্রথম এ সংকেত ব্যবহারের প্রস্তাব আসে এবং ১৯২৭ সাল থেকে তা আন্তর্জাতিক প্রোটোকল হিসেবে গৃহীত হয়। শব্দটি সবসময় তিনবার বলা হয়- ‘Mayday Mayday Mayday’- যাতে রেডিও তরঙ্গে তা স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা যায় এবং ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ না থাকে।
এই সংকেত সাধারণত পাঠান বিমানের পাইলট অথবা জাহাজের ক্যাপ্টেন, যখন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন যানটি গুরুতর বিপদের মুখে পড়ে। ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যাওয়া, আগুন ধরে যাওয়া, বৈদ্যুতিক বা হাইড্রোলিক সিস্টেম অচল হয়ে যাওয়া, বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়া কিংবা এমন কোনো অবস্থা, যেখানে যাত্রীদের জীবন হুমকির মুখে- তখনই ‘মে ডে’ বার্তা পাঠানো হয়।
সংকেতটি পাঠানো মাত্রই সংশ্লিষ্ট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে অন্য সব বার্তা থেমে যায়। নিয়ন্ত্রণকক্ষ বা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বার্তাটি গ্রহণ করে। তখন পাইলট তাদের অবস্থান, সমস্যা এবং কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তা জানিয়ে দেন। এরপর অবিলম্বে উদ্ধার তৎপরতা ও সহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়। এই প্রোটোকল বিমান ও নৌপরিবহন খাতের একটি সর্বোচ্চ জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থার অংশ।
অনেক সময় ‘Pan-Pan’ নামের আরেকটি সংকেতও ব্যবহৃত হয় যা তুলনামূলকভাবে কম বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য। তবে ‘মে ডে’ কল তখনই আসে, যখন সেই মুহূর্তেই ব্যবস্থা না নিলে প্রাণহানি নিশ্চিত। আহমেদাবাদের ঘটনার বেলায় যেমনটি হয়েছিল- পাইলট জানতেন, তার হাতে সময় নেই। তাই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শেষবারের মতো পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে গেছেন তিনি।
‘মে ডে’ শুধু একটি শব্দ নয়। এটি শেষ আকুতি, একটি জীবনরক্ষার ডাক। এই সংকেতের পেছনে থাকে একজন পাইলটের স্নায়ুচাপ, দক্ষতা, আবেগ এবং শেষ মুহূর্তের লড়াই। আহমেদাবাদের দুর্ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়- আকাশে ভেসে থাকলেও নিরাপত্তা কখনো নিশ্চিত নয় এবং জরুরি সংকেতের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে বহু মানুষের ভাগ্য।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে