ইসরায়েলি হামলায় গাজায় আরও ৮২ জন নিহত, মোট ৫৫,৭৮৮
অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি উপত্যকা গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযান ও বিমান হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের ৩৫ জনই নিহত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানেটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে ত্রাণ ও খাবার নিতে গিয়ে।
শুক্রবার (২০ জুন) দিনভর এসব হামলায় আহত হন আরও ৪২১ জন ফিলিস্তিনি। এ নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গত ২০ মাসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৫৫ হাজার ৭৮৮ জনে। আরও এক লাখ এক লাখ ৩০ হাজার ৫০১ জন আহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ে গাজার ১৫ হাজারের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নিহতদের মধ্যে ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকেই মারা গেছেন পাঁচ হাজার ৪৯৫ জন এবং আহতদের সংখ্যা অন্তত ১৭ হাজার ৬২৪ জন।
অন্যদিকে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সামগ্রিক সামরিক অভিযানে নিহত ইসরায়েলি সৈন্যের সংখ্যা ৪৩২ জনে দাঁড়িয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, মধ্য গাজায় কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৩ জন সাহায্যের জন্য নেতজারিম করিডরের ত্রাণকেন্দ্রের বাইরে ছিলেন। গাজা সিটিতে আরও ২৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আর দক্ষিণ গাজায় ২২ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১১ জন সাহায্যপ্রার্থীও ছিলেন।
অনেকেই এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না বলেও জানান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, সর্বশেষ হামলায় হতাহত অধিকাংশ ফিলিস্তিনিকেই গাজার মধ্যাঞ্চলের আল-আওদা ও আল-আকসা হাসপাতালে এবং বাকিদের রাফার রেডক্রস হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন, আহতদের অধিকাংশের অবস্থাই গুরুতর।
হামলার সময়কার কিছু ছবি ও ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, বিমান হামলার পাশাপাশি ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করছে ইসরায়েলি বাহিনী। ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের পাশে সড়কগুলোতে যত্রতত্র মরদেহ পড়ে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তাদের স্বজনেরা।
আল–আওদা হাসপাতালের মেঝেতেও মরদেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। হাসপাতালটির একজন মুখপাত্রও জানান, অর্ধাহার–অনাহারে থাকা হাজারো ফিলিস্তিনি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করলে ৩৫ জন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হন।
দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার আগেই ২ মার্চ গাজায় ত্রাণ প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে প্রায় তিনমাস পর ২৭ মে কিছু ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে জিএইচএফ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে গাজার অল্প কিছু স্থানে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
গাজার সরকারি সংবাদমাধ্যম কার্যালয়ের মহাপরিচালক ইসমাইল আল-থাওবাতা জানান, এখন পর্যন্ত মানবিক সহায়তার আশায় আসা ৪৫৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন তিন হাজার ৬২৪ জন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ২৩ জন, বুধবার (১৮ জুন) ২৯ জন এবং মঙ্গলবার (১৭ জুন) দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে৭০ জন, সোমবার (১৬ জুন) রাফায় ৩৮ জন ও রোববার (১৫ জুন) দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় ত্রাণ নিতে গেলে ১৭ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনারা।
এদিকে জিএইচএফ নিরাপদ ত্রাণ বিতরণ ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতে ব্যর্থ এবং হতাশাজনক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। তবে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইসারয়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আল জাজিরাকে কোনো সাড়া দেয়নি।
ইউনিসেফও সতর্ক করে দিয়েছে, গাজা উপত্যকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেখানেও মানবসৃষ্ট খরার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
সংস্থার মুখপাত্র জেমস এল্ডার শুক্রবার জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘পানীয় জল উৎপাদনের মাত্র ৪০ শতাংশ সুবিধা এখনও কার্যকর রয়েছে। শিশুরা তৃষ্ণায় মারা যেতে শুরু করবে’।
সম্প্রতি গাজা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এল্ডার বলেন, খাদ্য সহায়তা নিতে গিয়ে আহত নারী ও শিশুদের অনেক সাক্ষ্য তার কাছে রয়েছে। এর মধ্যে একটি ছোট ছেলেও রয়েছে, যে ট্যাঙ্কের গোলায় আহত হয়ে পরে মারা গেছে।
জেমস এল্ডার বলেন, সহায়তা কেন্দ্র কখন খোলা বা বন্ধ, সে বিষয়ে সঠিক তথ্যের ঘাটতি থেকেই বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, কখনও বলা হচ্ছে, সহায়তা কেন্দ্র খোলা। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বন্ধ। কিন্তু তখন গাজার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। ফলে মানুষ তথ্য জানতে পারে না।
অবশ্য বুধবার জিএইচএফ বিবৃতিতে দাবি করেছে, তারা তাদের তিনটি ত্রাণ কেন্দ্রে কোনো ঘটনা ছাড়াই ত্রিশ লাখ খাবার বিতরণ করেছে।
গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত থাকার পরেও নয়দিন ধরে ইরানেও বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান শুক্রবার সতর্ক করে বলেছেন, ইরানের সাথে ইসরায়েলের সংঘাত এবং গাজায় গণহত্যা ‘দ্রুত ফিরে আসার অযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে’।
‘ইসরায়েল আজ তার হাসপাতালের ক্ষতির অভিযোগ করেছে। তবুও তারা এখন পর্যন্ত কেবল গাজার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে ৭০০টিরও বেশি আক্রমণ চালিয়েছে’- বলেন তিনি।
ইস্তাম্বুলে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার যুব ফোরামে বক্তৃতাকালে যুদ্ধবিরতির আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন এরদোগান। তিনি বলেন, ‘এই উন্মাদনা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা উচিত’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে