সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন উন্নত গবেষণা
বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রেই উন্নতি করছে। বড় বড় ব্রিজ, শিল্প-কারখানা, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর সবই নির্মিত হচ্ছে; কিন্তু দিন দিন দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে গবেষণা খাতে। ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর অনেক কাজ চলে যাচ্ছে বিদেশিদের দখলে। বাংলাদেশেরই বড় বড় প্রকল্পে বাংলাদেশিরা কাজ করছে কায়িক শ্রমিক হিসেবে, যা শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই ক্ষতিকর নয়, মান-সম্মানের দিক দিয়েও লজ্জাজনক।
আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর দেশে উন্নত গবেষণা ছাড়া কোনো দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে থাকা দেশগুলোও তার প্রমাণ। চীন-জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে উন্নত গবেষণার কারণেই। বর্তমান সরকারও দেশকে বৈশ্বিক কাতারে এগিয়ে নেয়ার জন্য রূপকল্প-৪১ চালু করেছে; কিন্তু এসবই অসম্ভব হয়ে যাবে যদি দেশকে উন্নত গবেষণার দিকে এগিয়ে না নেয়া যায়। উচ্চতর গবেষণা-সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের স্থান প্রায় শূন্য।
ইউনেসকোর পরামর্শ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা; কিন্তু বাংলাদেশে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ ব্যয় করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দের হার সবচেয়ে কম। আবার যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকে, তারও সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক-কর্মীদের বেতন-ভাতায়। গবেষণায় বরাদ্দ থাকেই না বললেই চলে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রমে বাংলাদেশ যে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে, তারও অন্যতম কারণ যে গবেষণায় দুর্বলতা ও অপ্রতুলতা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশ গবেষণায় পিছিয়ে থাকার মূল কারণ- পুরোনো আমলের কারিকুলাম, শিক্ষকদের একটা অংশের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, দলীয় বা ‘প্রশাসন অনুগত’ শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি। শিক্ষা ও চিকিৎখাতে প্রয়োজনের তুলনায় বাজেট-বরাদ্দ অনেক কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা ছিল বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জিডিপির শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে গড় ব্যয় ছিল ৪১টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে পঞ্চম সর্বনিম্ন।
কিন্তু উন্নত গবেষণার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, প্রচুর অর্থ, গবেষণার মানসিকতা, গবেষকদের জ্ঞানসাধানা, নিশ্চিত জীবন। নানা কারণেই এসব বাংলাদেশে অপ্রতুল। একটি সমস্যা আরেকটি সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। ফলে আমরা আর গবেষণাহীনতার দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছি না; কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, সরকার তা পূরণ করতে বেগ পেতে হবে।
গবেষণা যে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে, তা না। উন্নত গবেষণা সামগ্রিক জীবনমানেই প্রভাব ফেলে। গবেষণা কেবল বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিনির্ভর নয়। গবেষণার ক্ষেত্র শিক্ষা-স্বাস্থ্য-ইতিহাস-সাহিত্য যে কোনো বিষয় নিয়েই। গবেষণা একটি বিষয়ের উন্নত জ্ঞান প্রকাশ করে। পাশাপাশি অনেক সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে। গবেষণাবিহীন একটি আধুনিক রাষ্ট্র মূলত প্রাচীন সমাজব্যবস্থার মতোই। কারণ, জ্ঞানগত ত্রুটি দূর না করলে অন্য সব সমস্যারও সমাধান সম্ভব হয় না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে কোনো সমস্যাই মূলত জ্ঞানগত সমস্যা; তা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় গভীর জ্ঞানচর্চা; যা কেবল উন্নত গবেষণার মধ্য দিয়েই অর্জন সম্ভব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে