Views Bangladesh Logo

পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে আগে দরকার প্রশাসনিক সংস্কার

Rahman  Mridha

রহমান মৃধা

প্রযুক্তির যুগে আমরা প্রায়ই দেখে থাকি- যা ভালো লাগে, তাই নকল করতে চাই। হতে পারে পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান বা শাসনব্যবস্থা। তবে স্থান, কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সবকিছু একেবারে হুবহু স্থানান্তর সম্ভব নয়। যেমন সুইডেনে বসবাস করে সুন্দর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা দেখা যায়, তবে তা বাংলাদেশে সরাসরি প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।

উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনে Proportional Representation (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। এই পদ্ধতিতে জনগণ যে ভোট দেয়, তার অনুপাতে সংসদীয় আসন বণ্টন হয়। ফলে কোনো একক দল একচেটিয়া ক্ষমতা পায় না; সরকার পরিচালনার জন্য জোট গঠন অপরিহার্য।

আসুন বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগের পূর্বে আমরা জেনে নিই সুইডিশ রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। সুইডিশ রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় কঠোর নিয়ম ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র মেনে চলে। তারা দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য অর্থের প্রভাব কার্যত সীমিত রাখে। যাতে করে ভোটের ফল যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়; সংসদ সদস্যরা জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। আবার শিক্ষার মান ও সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্রে জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বাস দৃঢ় করতে তারা যে সুযোগ নেয়, ঠিক সেই পরিমাণ সুযোগ তারা জনগণকে দেয়। তাদের কাছে ভোট কেবল ক্ষমতার বণ্টন নয়, নাগরিক অধিকার ও কল্যাণের প্রতিফলন বটে। তাই নির্বাচনের স্বচ্ছতা, ভোট গ্রহণ, গণনা ও পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন থাকে।

ফলস্বরূপ, সুইডেনে সংসদ কার্যকর ও স্থিতিশীল; মতবিরোধ থাকলেও আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সঠিকভাবে নিশ্চিত হয়। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি সরাসরি চালু হলে সুইডেনের মতো ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায় না। কারণ এখানে মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রার্থী তালিকায় স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ও অর্থের প্রভাব প্রচলিত একটি ধারা। আর এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিলও বটে। অন্যদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার, সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নের বদলে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেন।
তা ছাড়া দলীয় প্রধানের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় একক নেতা বা ছোট গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি তো আছেই। তাই রাজনৈতিক প্রভাব প্রশাসনে বিরাজমান থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন রাজনৈতিক চাপের অধীনে কাজ করে। ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকট বৃদ্ধি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়া এখন সাধারণ ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে।

কাঠামোগত সংস্কারের প্রধান ধাপ
১. সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা সীমিতকরণ : মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ। প্রশাসনিক ক্ষমতা তাদের হাতে থাকা উচিত নয়।
২. স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা : ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে আইন বাস্তবায়ন, বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনার দায়িত্ব দেওয়া।
৩. জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি :
- মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
- দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ।
- জনগণের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক।
৪. দলীয় অর্থায়নের স্বচ্ছতা : তহবিল ও দানের হিসাব প্রকাশ বাধ্যতামূলক।
৫. গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা : রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি উন্মোচন নিশ্চিত করবে।

ফলস্বরূপ, রাজনীতি হবে নীতি নির্ধারণ ও দূরদর্শিতার স্থান, প্রশাসন হবে জনগণের সেবার মঞ্চ।

নিরপেক্ষ প্রশাসনের মডেল : সুইডেন
সুইডেন দেখায়, একটি দেশের অগ্রগতি তখনই স্থায়ী হয় যখন প্রশাসন রাজনীতির হাত থেকে স্বাধীন।
- স্বাস্থ্যসেবা : জাতীয় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বোর্ড।
- সামাজিক নিরাপত্তা : Försäkringskassan (সোশ্যাল ইন্সু্যরেন্স এজেন্সি)।
- শ্রমনীতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও অন্যান্য : প্রতিটি খাতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।

রাজনীতিবিদরা কেবল নীতি নির্ধারণে সীমাবদ্ধ থাকেন, বাস্তবায়ন পেশাদার প্রশাসন সম্পন্ন করে। বাংলাদেশেও যদি প্রতিটি খাতে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, রাজনীতি আর দুর্নীতির বাহন হবে না।

সুইডেনের সংসদীয় ব্যবস্থা শেখায়, পিআর কার্যকর হতে হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। বাংলাদেশে পিআর সরাসরি প্রয়োগ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই জরুরি ভিত্তিতে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা সীমিত করে স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। এবং নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি সত্যনিষ্ঠ, শিক্ষিত ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি এই সংস্কারগুলো কার্যকর করতে পারে, তবে এক প্রজন্মের মধ্যে রাষ্ট্রীয় রাজনীতি ধ্বংসের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু পিআর নয়, সুস্থ প্রতিষ্ঠান ও নিরপেক্ষ প্রশাসনই প্রকৃত পরিবর্তনের চালিকা শক্তি। 

রহমান মৃধা : গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ