Views Bangladesh Logo

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ

দূরের যুদ্ধ, বাংলাদেশের জন্য বাস্তব হুমকি

বাংলাদেশ বর্তমানে নানা দিক থেকে চাপে আছে- অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত। আমরা একটি সম্পদ-ঘাটতির দেশ, যার বেশিরভাগ জ্বালানি ও মৌলিক চাহিদা আমদানিনির্ভর। আমাদের অর্থনীতি এখনো কৃষিভিত্তিক অথচ জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতি বছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে। বেকারত্ব বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটি বড় সংকট।

এছাড়াও রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের সম্ভাব্য বিস্তার আমাদের অর্থনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও আমরা ভূগোলগতভাবে দূরে।

এই নিবন্ধে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোর চিত্র তুলে ধরা হলো এবং কীভাবে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে তা মোকাবিলা করা যায় তারই দিকনির্দেশনার একটা রূপরেখা নিম্নরূপ হতে পারে।


বাংলাদেশের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জসমূহ:

১. জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি
বাংলাদেশ প্রায় সম্পূর্ণরূপে তেল ও এলএনজি আমদানিনির্ভর। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ বা ঝুঁকিপূর্ণ হলে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ, পরিবহন ও নিত্যপণ্যের মূল্যে- যা সরাসরি জনগণের জীবনে প্রভাব ফেলবে।

২. রপ্তানি খাতে ধস
বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা বাড়লে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি হ্রাস পাবে। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে চাহিদা কমে গেলে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বিপদ দেখা দেবে।

৩. প্রবাসী কর্মীদের অনিশ্চয়তা
প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তারা চাকরি হারাতে পারেন, দেশে ফিরে আসতে পারেন বা রেমিট্যান্স পাঠাতে অসুবিধায় পড়বেন। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবারগুলো বিপাকে পড়বে।

৪. সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাত
বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত আমদানিনির্ভর খাতগুলোর মধ্যে সারের দাম, খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে। চাষাবাদ, চিকিৎসা ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে।

৫. সামাজিক উত্তেজনা ও মেরুকরণ
বিভ্রান্তিকর তথ্য, গুজব ও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি ধর্মীয় বিভাজন ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য করণীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:

১. জরুরি জ্বালানি রিজার্ভ ও উৎস বৈচিত্র্য
ক) তেল ও এলএনজির জরুরি মজুত গঠন
খ) আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আনা
গ) সৌর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণ

২. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
ক) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি
খ) মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
গ) বিনিময় হার নমনীয় রাখা

৩. রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য
ক) শুধু পশ্চিমা বাজারের ওপর নির্ভর না থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বাজারে প্রবেশ
খ) নতুন পণ্য খাতে বিনিয়োগ যেমন আইসিটি, ওষুধ, হ্যান্ডিক্র্যাফট

৪. প্রবাসী সুরক্ষা ও রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা
ক) মধ্যপ্রাচ্য সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার
খ) সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি
গ) ডিজিটাল রেমিট্যান্স প্রসারে উৎসাহ

৫. সামাজিক ঐক্য ও সঠিক তথ্য প্রচার
ক) ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সম্পৃক্ত করে সহনশীলতার বার্তা ছড়ানো
খ) মিথ্যা তথ্য ও গুজব ঠেকাতে কার্যকর কমিউনিকেশন টিম গঠন
গ) মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটিকে সম্পৃক্ত করা


নিরপেক্ষ ভূরাজনীতি ও কৌশলগত কূটনীতি:
বাংলাদেশকে এই যুদ্ধ সম্পর্কে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে হবে। কারণ, একপক্ষের পক্ষে অবস্থান নেয়া প্রবাসী শ্রমিক ও বাণিজ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বাংলাদেশের উচিত শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে কাজ করা এবং সব পক্ষের সঙ্গে কৌশলগত বন্ধুত্ব বজায় রাখা

দূরদর্শিতা, প্রস্তুতি ও জাতীয় ঐক্যে:

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব যদি যুক্ত হয় তাহলে তা হবে আরেকটি বড় ধাক্কা। এই ধাক্কা এড়াতে হলে সরকার ও জনগণকে একসঙ্গে পরিকল্পনা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।

এটি শুধু একটি “দূরের যুদ্ধ” নয়- এটি আমাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।

কে এম জয়নুল আবেদীন: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ