ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৬১৫৯৯ ফিলিস্তিনি, ‘দুর্ভিক্ষে’ ২২৭ জন
গত ২৪ ঘন্টায় গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত ১০০ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ বিভিন্ন হাসপাতালে আনা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন আগের হামলায় মারা যাওয়া ১১ জনও। আহত আরও ৫১৩ জনকে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া অনাহার ও অপুষ্টিতে মারা গেছেন দুই শিশুসহ আরও পাঁচজন।
হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন বা অন্য ধ্বংসস্তূপগুলোতে আরও অন্তত অসংখ্য হতাহত ফিলিস্তিনি আটকে আছেন, যেখানে পৌঁছাতে পারছেন না উদ্ধার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের বাদ দিয়েই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২২ মাস ৬ দিনে নিহত দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৫৯৯ জনে এবং আরও অন্তত এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৮ জন আহত হয়েছেন।
মন্ত্রণালয়ের বরাতে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) স্থানীয় সময় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিহত ৪৮ জনের মধ্যে ২৩ জনই যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে খাবারের জন্য এসেছিলেন। উদ্ধার হওয়া বাকি ৫২ জনের মরদেহের মধ্যে সোমবার (১১ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে রাতভরের হামলায় নিহত ৪১ জনের আটজন ত্রাণপ্রার্থী ছিলেন। ওই ২৪ ঘণ্টায় সাহায্য চাইতে গিয়ে সেনাদের গুলিতে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩৮৮ জন।
টেলিগ্রামে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগের ইসরায়েলি হামলার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১১ জনের মরদেহও উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের চাপিয়ে দেয়া জোরপূর্বক অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৭ জনে, যাদের ১০৩ জনই শিশু। সর্বশেষ মারা যাওয়া দুই শিশুর মধ্যে রয়েছে ছয় বছরের একজন ছেলে। নাসের হাসপাতালে মারা যান দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরের ৩০ বছর বয়সী উইসাম আবু মোহসেন ও বৃদ্ধ জামাল ফাদি আল-নাজ্জার।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি ও রয়টার্স জানিয়েছে, গাজা সিটি পুরোপুরি দখলে নিতে দক্ষিণের খান ইউনিস শহর ছাড়াও উপত্যকাটির পূর্বাঞ্চলে ট্যাংক, বিমান ও ড্রোন থেকে ভারি বোমা হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা সিটিতে নতুন সম্প্রসারিত অভিযান খুব দ্রুতই শেষ করতে চান বলে জানানোর পর সেখানে তিনদিন ধরে এই তীব্র হামলা চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ফিলিস্তিনিরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র বোমাবর্ষণ চলছে। তিনদিনের টানা ইসরায়েলি হামলায় গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলীয় সাবরা, জয়তুন এবং শেজাইয়ায় বোমাবর্ষণে বহু পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে পশ্চিমের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। গাজা শহরের দারাজ এলাকায় হামলায় আরও একজন নিহত হয়েছেন বলেও তারা জানান।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরের আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুত বেসামরিক নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে সোমবারের ইসরায়েলি হামলায় নিহত পাঁচজনের মরদেহ এবং আরও বেশ কয়েকজন আহতকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবারও আল-মাওয়াসিতে হামলা অব্যাহত রয়েছে, যেটিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজেরাই ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা দিয়েছিল।
ওয়াফা আরও জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটির সাবরা এলাকার আল-ফারুক মসজিদের কাছে ভয়াবহ হামলা চালায়, যেখানে আল-হাসারী পরিবারের একজন শিশুসহ কমপক্ষে তিনজন নিহত হন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন আরও ২০ জন। অন্য হামলায় বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় শহরের কেন্দ্রস্থলে ইউনিভার্সিটি কলেজ এলাকার পশ্চিমের একটি আবাসিক ভবন, যেখানে আল-সালমি পরিবারের একজন নিহত হয়েছেন। এখানেও বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন।
আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ-পূর্ব গাজা শহরের জেইতুনপাড়ার একটি বাড়িতে ইসরায়েলি হামলায় আল-নাদিম পরিবারের চারজন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন এবং আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
গাজা সিটির কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সোমবারের রাত ছিল সবচেয়ে বাজে। মঙ্গলবার সকালেও তাদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচজনের একটি পরিবার নিহত হয়েছে। হামলায় আবাসিক বাড়িগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। আল-সাহাবা এলাকার আল-নাদিম স্ট্রিটে আল-নাদিম পরিবারের বাড়িতে বিমান হামলায় কমপক্ষে চারজন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন।
গাজার ২৫ বছর বয়সী বাসিন্দা আমর সালাহ বলেন, ‘যুদ্ধ আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ট্যাংক থেকে বাড়িঘরে গোলা ছোড়া হচ্ছে। বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে গোলা আঘাত হেনেছে। বিমান থেকে ছোড়া হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র। কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র গাজার পূর্বাঞ্চলের কিছু রাস্তায় পড়েছে। সিটিজুড়ে আরও জোরদার সামরিক হামলা হওয়ার শঙ্কা বেড়েছে’।
এদিকে আল জাজিরা সম্প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে গাজা সিটিতে মারাত্মক ইসরায়েলি হামলার পরের দৃশ্য দেখা গেছে। সেখানে দেখা গেছে, রাস্তায় ভিড় জড়ো হচ্ছে, যখন একটি ছোট দল একটি গাড়িতে করে একজনের নিথর দেহ চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাটি রক্তের ঘন ধারায় ভরে গেছে, যা মানুষকে এর চারপাশে হাঁটতে বাধ্য করছে।
অন্য ভিডিওতে দেখা গেছে, সিভিল ডিফেন্সের একজন সদস্য একটি পরিবারকে উদ্ধারে বাড়ির ভেতরে গেলে আরেকটি বিস্ফোরণে বোমার আঘাতে আহত হন। তিনি মাঝারি আঘাত পেয়ে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অন্যদিকে উদ্ধার অভিযান তদারককারী গাজার ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, আল-মাওয়াসির নিজ তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলায় তাদের একজন সদস্য নিহত হয়েছেন। নিহত আব্দুল রহমান মাহের আবু লতিফা খান ইউনিসের কাছে বানি সুহেলা শহরে অগ্নিনির্বাপক হিসেবে কাজ করতেন। উদ্ধারকারী সংস্থাটি জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় তার বাবা-মাও নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধে ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত গাজার সিভিল ডিফেন্সের ১৩৭ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
তবে গাজা সিটিতে তীব্র বোমাবর্ষণে সিভিল ডিফেন্স দলগুলোকে বেঁচে যাওয়াদের কাছে পৌঁছাতে লড়াই করতে হচ্ছে। তারা কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই এবং খালি হাতে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া ফিলিস্তিনিদের সন্ধানে নিরলসভাবে কাজ করছেন।
অন্যদিকে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানায়, গাজার মধ্যাঞ্চলের নেটজারিম করিডরের কাছে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। উত্তর-পশ্চিম গাজার জিকিম ক্রসিংয়ের একটি, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের দুটি এবং রাফাহ শহরের কাছের একটি ত্রাণকেন্দ্রে মারা যান বাকি ২৮ জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২৭ মে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র চালু করে জিএইচএফ। সে সময় থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে এক হাজার ৮৩৮ জন। এর মধ্যে এক হাজার ৩২৪ জন জিএইচএফ কেন্দ্রের কাছে এবং বাকি ৫১৪ জন নিহত হয়েছেন ত্রাণবহরের রুটে। এ সময়কালে আহত হন আরও ১৩ হাজার ৪০৯ জন ত্রাণপ্রার্থী।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর জবাবে ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে গাজার বিভিন্ন এলাকায়।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও ১৮ মার্চ থেকে ফের সামরিক অভিযান চালাচ্ছে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১০ হাজার ৭৮ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ৪২ হাজার ২১৯ জন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে