Views Bangladesh Logo

রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা

Rasel Mahmud

রাসেল মাহমুদ

খেলাপি ঋণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশের চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। মাত্র ছয় মাসে এসব ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি ইতোমধ্যে ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত- যা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।

খেলাপি ঋণ (Non-Performing Loan বা NPL) হলো এমন ঋণ, যার নির্ধারিত কিস্তি বা সুদ ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত ৯০ দিন বা তার বেশি) পরিশোধ করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী- কোনো ঋণের আসল বা সুদের কিস্তি ৩ মাস বা তার বেশি সময় বকেয়া থাকলে সেটিকে খেলাপি ঋণ ধরা হয়। এর মধ্যে যেসব খেলাপি ঋণের কিস্তি ৩ থেকে ৬ মাস বাকি সে ঋণগুলো 'মানহীন' বলে বিবেচিত। ৬ থেকে ৯ মাস কিস্তি বাকি ঋণকে বলে 'সন্দেহজনক'। আর যেসব ঋণের কিস্তি ৯ মাসের বেশি বাকি সেগুলো 'খারাপ' বা 'ক্ষতি' ঋণ হিসেবে চিহ্নিত। চার ব্যাংকে এমন ঋণের পরিমাণ এখন ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক চারটি হলো- জনতা, সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী।

জানা গেছে, এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণই একমাত্র সমস্যা নয়। তীব্র মূলধন ঘাটতি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে কম বরাদ্দ, প্রভিশন ঘাটতি আর কমতে থাকা মুনাফায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো টিকে থাকার লড়াই করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন আর প্রশ্ন মুনাফার নয়, বরং এই ব্যাংকগুলো কতদিন টিকে থাকতে পারবে সেটাই ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বাধিক ঝুঁকিতে জনতা ব্যাংক
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক। ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৭৬ শতাংশ। এই ঋণের ৯৩ শতাংশই আবার ‘ক্ষতি’ ঋণ। ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ঋণাত্মক –৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, যেখানে ন্যূনতম থাকার কথা ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির নেট ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৭১ কোটি টাকা।

তুলনামূলক 'ভালো' সোনালী ব্যাংক
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তুলনামূলকভাবে কম। ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে 'ক্ষতি' ঋণ ১৭ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিলো ১৮ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এ সময়ে 'ক্ষতি' ঋণ ছিল ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। তবে মূলধন সংরক্ষণে সফল হয়েছে সোনালী ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার হয়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ, যা ন্যূনতম ১০ শতাংশ রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। ছয় মাসে ব্যাংকটির নেট মুনাফা হয়েছে ৫৯১ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ

অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশই ‘ক্ষতি’ ঋণ। মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্র ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ১১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যদিও আগের ছয় মাসে ক্ষতি হয়েছিল ৯৩৬ কোটি টাকা।

রূপালী ব্যাংকের 'ক্ষতি' ঋণ ৯১ শতাংশ
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকায়- যা মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে ৯১ শতাংশই ‘ক্ষতি’ ঋণ। মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকটির নেট মুনাফা হয়েছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, আগের ছয় মাসে যা ছিল ৬৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকের মূলধন ও মুনাফা কমে যায়, নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও হ্রাস পায়। এ ছাড়াও বিনিয়োগ ও ব্যবসা ব্যাহত হয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে আমানতকারীর টাকার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে ব্যাংকের প্রতি অনাস্থা বৃদ্ধি পায়।

খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, গত এক দশকে মালিকরা নিজেরাই নিজেদের ব্যাংক খাত ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। কিছু খেলাপি ঋণ আদালতের নির্দেশে আনক্ল্যাসিফায়েড দেখানো হচ্ছিল, আমরা সেই অবস্থা উপেক্ষা করে এখন সবকটিকে ক্ল্যাসিফায়েড হিসেবে দেখাচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে ফরেনসিক অডিটে দেখা গেছে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। তাই এখনই সেসব ঋণকে ক্ল্যাসিফায়েড করে ডিএফ (ডিপার্টমেন্ট ফরফিট) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ