গাজায় ১৮৫৯২ ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা, মোট নিহত ৬০৪৩০ জন

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ১৮ হাজার ৫৯২ জন নিহত হয়েছে। প্রায় ২২ মাস ধরে চলা যুদ্ধে মোট নিহত দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪৩০ জনে আর আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭২২ জন। অন্যদিকে অনাহারে মারা গেছেন ১৬৯ জন, যাদের মধ্যে ৯৩ জনই শিশু।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরা জানায়, শনিবার (৩১ জুলাই) ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিমান ও ড্রোন হামলা এবং স্থল অভিযানে সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩৬ জন ফিলিস্তিনি, যাদের ১৩ জন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে খাবারের জন্য এসেছিলেন। আরও ২২ জন নিহত হন শুক্রবার (১ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে রাতভরের হামলায়, যাদের ৮ জন ত্রাণপ্রার্থী। এই ২৪ ঘণ্টায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ৬৭৯ জন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ‘দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে’ আরও তিনজন শিশু, একজন কিশোর ও পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার সকালে মারা যান ১৭ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কিশোর আতেফ আবু খাতের।
বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, নিহত শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছে। অনেকেই ছিল জীবনের একেবারে প্রারম্ভে। কেউ কেউ জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বিমান হামলা বা বোমার আঘাতে মারা গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ৯ জন নবজাতক জন্মদিনেই, ৫ জন প্রথম দিনে, ৫ জন দ্বিতীয় দিনে এবং ৮ জন তৃতীয় দিনে নিহত হয়। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, নিহত শিশুদের মধ্যে ১ মাস বয়সী ৮৮ জন, ২ মাস বয়সী ৯০ জন এবং ৩ মাস বয়সী ৭৮ জন ছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে ইসরায়েল গাজায় লাগাতার সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই নিরন্তর হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
সোমবার ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন ‘বেটসেলেম’ ও ‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস-ইসরায়েল’ গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে। তারা বলেছে, পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনি সমাজকে ধ্বংস করা এবং গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে চূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে।
ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, গাজার মধ্যাঞ্চলের শুজাইয়া এলাকায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। অন্যদিকে গাজার কেন্দ্রীয় অংশে ওয়াদি গাজার কাছে ত্রাণ পেতে অপেক্ষারত ৫ জন এবং মধ্য গাজার নেটজারিম করিডোরের কাছে ১২ জন ত্রাণপ্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করেছে সেনারা।
গাজার বেসামরিক বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, উত্তর গাজার জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে অপেক্ষা করার সময় ইসরায়েলি বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন নিহত হয়েছেন। এখান থেকে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরাইল থেকে ত্রাণ ট্রাক প্রবেশ করেছে। আর দক্ষিণ গাজার একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে জনতার ওপর ইসরায়েলি গুলিবর্ষণে ২ জন নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়েছে। এই দুটি কেন্দ্রও জিএইচএফের, যার কার্যক্রম বিশৃঙ্খল এবং প্রায় প্রতিদিনই মারাত্মক ঘটনা ঘটছে।
সংস্থাটির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজার আশ্রিত ফিলিস্তিনিদের শিবিরেও হামলা চালিয়েছে। ওই হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, দেইর আল-বালাহয় একটি গাড়ির ধাক্কায় আরও চারজন নিহত হয়েছেন।
বাসাল বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী মধ্য গাজায়ও পাঁচজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। গাজা সিটি এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের খবর জানার পর, অঞ্চলটির উত্তরে অবস্থিত গাজা সিটি এলাকায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা।
জাতিসংঘ-সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গাজায় ‘এখন দুর্ভিক্ষ চলছে’। এর ওপরে ২৭ মে জিএইচএফ সীমিত খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিতভাবে ত্রাণ কেন্দ্রে বা তার কাছাকাছি ফিলিস্তিনি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালিয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, প্রায় ২২ মাস ধরে চলা যুদ্ধের পর গাজাবাসী যখন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, তখন গাজার ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছে, যার মধ্যে জিএইচএফ পরিচালিত চারটি কেন্দ্রও রয়েছে। সেসব কেন্দ্রে ইসরায়েলি সেনাদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে অন্তত ১ হাজার ৩৭৩ জন নিহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) মুখপাত্র আদনান আবু হাসনা আল জাজিরাকে বলেন, গাজায় পণ্য ও ত্রাণ প্রবেশের ওপর ইসরাইলি নিষেধাজ্ঞায় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা সরবরাহ এবং জ্বালানি, যার ওপর হাসপাতালগুলো তাদের জেনারেটর চালাতে নির্ভর করে। ইসরায়েল আরোপিত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সাহায্যের উপর সম্পূর্ণ অবরোধে এই ঘাটতি আরও তীব্রতর হয়েছে, যা জিএইচএফের কার্যক্রম শুরুর সাথে সাথে বন্ধ করে দেয়া হয়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও জিএইচএফ অস্বীকার করেছে যে, তাদের সাহায্য কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে মারাত্মক গুলি চালানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বেসামরিক বিষয়গুলোর তত্ত্বাবধানকারী ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা কোগ্যাটও দাবি করেছে, বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ২০০টিরও বেশি ট্রাক ত্রাণ সংগ্রহ এবং বিতরণ করেছে। সংস্থাগুলোর জন্য চারটি জ্বালানি ট্যাঙ্কারও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর এবং জর্ডানের সহযোগিতায় ৪৩টি প্যালেট সরবরাহ প্যারাসুট করে গাজায় পাঠানো হয়েছে।
তবে শুক্রবার মাত্র ৭৩টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পেরেছে বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ জানিয়েছে, সেখানে দিনে কমপক্ষে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ সাহায্যের প্রয়োজন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর জবাবে ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে গাজার বিভিন্ন এলাকায়।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও ১৮ মার্চ থেকে ফের সামরিক অভিযান চালাচ্ছে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৪৩ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ৩৪ হাজার ৩৭৭ জন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে