সামাজিক ন্যায়বিচার ও টেকসই অর্থনীতিতে ঝুঁকতে ইউনূসের আহ্বান
একটি মৌলিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমানের শুধু সম্পদ বৃদ্ধির সংকীর্ণ পথ থেকে সরে এসে মানব কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পরিবেশ সুরক্ষার উপর কেন্দ্র করে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
সোমবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘সামাজিক ব্যবসা, যুব ও প্রযুক্তি’ শীর্ষক এক উচ্চ-পর্যায়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার সময় অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা হলো একটি কার্যকর মডেল, যা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই থাকার পাশাপাশি বৈশ্বিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা কোনো বিশেষ ধারণা নয়; এটি একটি মৌলিক নীতি যে, ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য শুধু লাভ করা নয়, বরং একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।’
অধ্যাপক ইউনূস একটি এক ডলারের ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে সামাজিক ব্যবসার শুরু হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরেন এবং স্বাস্থ্যসেবা, নবায়নযোগ্য শক্তি, শিক্ষা ও খেলাধুলার মতো বিভিন্ন খাতে এর বিশ্বব্যাপী প্রসারের কথা বলেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বর্তমান সভ্যতা যেভাবে লাগামহীনভাবে সম্পদ আহরণ ও ভোগ করছে, তা পৃথিবীকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।’ এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি একটি নতুন সভ্যতার আহ্বান জানান, যা সম্পদ ও ক্ষমতার সুষ্ঠু বণ্টন এবং সামাজিক কল্যাণের জন্য ব্যবসাকে একটি শক্তি হিসেবে ব্যবহার করবে।
তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বিশ্বজুড়ে যুবকদের প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য মোকাবিলায় সামাজিক ব্যবসায় তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা ও ব্লকচেইনের মতো নতুন প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে তিনি এই প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং অ্যালগরিদমিক পক্ষপাতিত্বের মতো নৈতিক ঝুঁকিগুলো সম্পর্কেও সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির সুফল নির্ভর করে আমরা ভবিষ্যতের নেতাদের মধ্যে কী মূল্যবোধ তৈরি করছি তার উপর।’ তিনি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশাপাশি নৈতিক উদ্ভাবনের উপরও জোর দেন।
'তিন শূন্য' অর্থাৎ শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ (যা দারিদ্র্যের অবসান ঘটাবে), এবং শূন্য বেকারত্ব—এই তিনটি ধারণার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস তরুণদেরকে টেকসই জীবনযাপন ও সামাজিক উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য ‘৩-জিরো’ ক্লাব গঠন করতে উৎসাহিত করেন।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অধ্যাপক ইউনূস বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতি সমর্থন বাড়ানোর কথা বলেন, কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এই সময়ে জাতিসংঘের বাজেট বা উন্নয়ন সহায়তা কমানো হবে আত্মঘাতী। একটি ন্যায়সঙ্গত উত্তরণ নিশ্চিত করতে বিশ্বের উচিত সমর্থন বৃদ্ধি করা।’
সবশেষে অধ্যাপক ইউনূস টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ন্যায়, স্থিতিশীলতা ও আশার উপর ভিত্তি করে একটি বিশ্ব গড়ার জন্য একটি সামগ্রিক পরিবর্তনের আহ্বান জানান।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে