নারী ফুটবলে আরেকটি নতুন অধ্যায় সৃষ্টি
নারী ফুটবলের সাফল্য এখন দেশের ক্রীড়ামোদি সমাজে বিশেষ আলোচনার বিষয়। আর এটি নারী ফুটবলাররা মাঠে নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘আর্ন’ করেছেন। দেশের ফুটবলের গবেষণা কার্যক্রম নারীরা অনেক বেশি এগিয়ে আর তাই এই মনোযোগ তাদের প্রাপ্য। নারীরা ফুটবল মাঠে এসে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। নারীরা প্রমাণ করেছেন পুরুষ শাসিত ক্রীড়াঙ্গনে তাদের বিভিন্নভাবে পিছিয়ে রাখা হলেও দেশের লড়াইয়ের মঞ্চে তারা পুরুষ ফুটবলারদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।
ফুটবলে নারীদের চিত্তাকর্ষক সাফল্য বাংলাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক ‘বিজ্ঞাপন’। নারীরা পেরেছেন মাঠের লড়াইয়ে সাহস এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লড়ে ফুটবল অনুরাগী মহলের আস্থা অর্জন করতে। মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে নারী ফুটবলাররা দেশকে অনেক দূর নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখেন, শুধু তাদের প্রয়োজন প্রটেকশন- আর এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে।
নারী ফুটবলে ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার ‘গ্রাউন্ড ব্রেকিংয়ের’ কাজটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। যেটি আগে কখনো করা হয়নি। পিটার চেয়েছেন ফুটবলারদের কাছ থেকে ‘হাই ইনটেনসিটি এবং হাই প্রেস’ ফুটবল- সেটি তার শিষ্যরা দিতে পেরেছেন। কোচ বিশ্বাস করেন ‘অ্যাবিলিটি’ আর ‘অ্যাটিটিউডে’। কিছুদিন আগে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে কোচ পিটার বলেছেন ‘মেয়েরা সব সময় আমাকে উসকে দিচ্ছে। এই মেয়েরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এদের মানসিকতা হলো সত্যি ‘গোল্ড’। এরা জানে দেশকে তারা কিভাবে গৌরবান্বিত করবে। এখন প্রয়োজন সরকার এবং ফুটবল ফেডারেশন তাদের পাশে দাঁড়াল। নারী ফুটবলে সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ বৃথা যাবে না।
নারী ফুটবলে সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো তাদের আবেগ আর সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দেশকে কিছু দেওয়ার আকুলতা। নারীরা দেশের ফুটবলে শুধু একটির পর একটি নতুন অধ্যায় রচনা করে চলেছেন তা নয়, তারা বদলে দিয়েছেন খেলার গতিধারা এবং প্রেক্ষপট। অদম্য নারীরা তাদের সাফল্যের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে প্রমাণ করেছেন ক্রীড়াঙ্গনে দেশের সম্মানের প্রশ্নে তারা অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং কমিটেড। তারা ক্রীড়াঙ্গনের মর্যাদার লড়াইয়ে প্রথম সারির সৈনিক!
নারী ফুটবলাররা তাদের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শুধু বিপ্লব সাধিত করেননি- খুলে দিয়েছেন তৃতীয় নয়ন। জন্ম দিয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনে নতুন চেতনা। কর্তৃত্ববাদী পুরুষশাসিত ক্রীড়াঙ্গনে বৈষম্য, অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার নারী ফুটবলাররা। এখন জাতির ‘ফেস লিফটার’। আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নের প্রতীক। নারী ফুটবলাররা মনে করেন, ফুটবলের আলোর মধ্যে আছে তাদের মুক্তির আলো। নারীরা পেরেছেন ক্রীড়াঙ্গনের মনোজগতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে উদাহরণ সৃষ্টি করতে। পাল্টে দিয়েছেন দেশের ফুটবলের গল্পের ‘প্লট।’
লাওসে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপে চূড়ান্ত পর্বে এবারই প্রথম খেলার যোগ্যতা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ নারী দল সেরা তিন রানার্স আপের মধ্যে স্থান করে নেওয়ায়। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ দল আগামী বছর এপ্রিল মাসে ১২ দলের সঙ্গে খেলবে থাইল্যান্ডে চূড়ান্ত রাউন্ডে। এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল গত ২ জুলাই মিয়ানমারে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল ফিফার র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা দলগুলোকে পরাজিত করে। খেলা হবে ২০২৬ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ায়।
বাংলাদেশের ফুটবলে আমরা এবারই প্রথম সবচেয়ে সুন্দর সময় উপভোগ করছি অদম্য নারী ফুটবলারদের বদৌলতে। গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এক বছরের মধ্যে চারটি আন্তর্জাতিক ফুটবলে অসাধারণ সাফল্য, যা আগে কখনো দেখিনি। আর এই সাফল্যের বীর হলেন আমাদের নারী ফুটবলাররা, যারা শুধু দিয়েই চলেছেন দেশ ও জাতিকে; কিন্তু তাদের ফুটবল উন্নয়নের জন্য কিছুই দিতে পারেনি, পারছে না জাতি একমাত্র সুন্দর সুন্দর কথা বলা আর আশ্বাস দেয়া ছাড়া! এর পরও নারীরা যুদ্ধ করে চলেছেন।
বাংলাদেশ প্রথম খেলায় র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা স্বাগতিক লাওসকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে তাদের দলগত শক্তিমত্তা এবং সাহসের পরিচয় দিয়েছে। এরপর পূর্ব তিমুরকে ৮-০ গোলে পরাজিত করেছে। গ্রুপের সর্বশেষ খেলায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে প্রথমে গোল করেও বাংলাদেশ নারী দল পরাজিত হয়েছে ৬-১ গোলে। বাংলাদেশ দল শক্তিশালী কোরিয়া দলের বিপক্ষে জয়ী হয়ে মাঠে ছাড়বে- এটি অবশ্য কখনো ভাবা হয়নি। ভাবা হয়েছে নারী দল খেলবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আক্রমণাত্মক এবং চিত্তাকর্ষক ফুটবল। ফুটবলাররা চেষ্টা করেছেন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। সর্বক্ষেত্রে ‘লিমিটেশন’ বলতে একটি কথা আছে!
দক্ষিণ কোরিয়ার র্যাংকিং হলো ২১ আর বাংলাদেশের ১০৪। শক্তির বিচারে অনেক বেশি পার্থক্য। ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়দের টেকনিক্যাল ‘সুপিরিয়রিটি’ এবং ‘ফিটনেস’ ছিল চোখে পড়ার মতো। ওদের ফুটবল পরিবেশ আর ফুটবল উন্নয়নের ক্ষেত্রে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আমাদের খেলোয়াড়দের চিন্তার বাইরে! আমাদের নারী ফুটবলে তো কোনো কাঠামো নেই। সবকিছু বাদ দিয়েই বলছি, ফুটবল প্র্যাকটিস করার জন্য একটি পৃথক মাঠও নেই। মেয়েরা নিয়মিতভাবে মাসিক বেতন পান না। পুরস্কারের টাকা বাকি পড়ে থাকে মাসের পর মাস। অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় আবাসিক ক্যাম্পে থাকেন।
খাওয়ার মান খারাপ এবং সুঠাম দেহের অনুসারী নয়। নেই পৃথক জিমনেসিয়াম নারীদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাই কোনো ধরনের তুলনা চলে না। শুধু বলব, আমাদের নারী ফুটবলারদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে খেলা ছিল একটি শিক্ষণীয় বিষয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ ব্রিটিশ ফুটবল কোচ পিটার বাটলার যেভাবে গত এক বছরে নারী ফুটবলারদের ‘মোটিভেট’ করে তাদের সম্ভাবনা এবং সাফল্যকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন, এটি সত্যি অনন্য। নারী খেলোয়াড়রা ছিলেন নিবেদিত এবং অনুগত।
তারা বুঝতে পেরেছেন কোচ তাদের কাছ থেকে কী চাচ্ছেন, কীভাবে চাচ্ছেন- তারা সেটি উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী ফুটবল আলো ছড়াতে সক্ষম হয়েছে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। আমাদের ফুটবল লোক-দেখানো চিন্তা-ভাবনা ছাড়া নারী বিবর্জিতভাবেই চলছে। ফুটবলে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এবং এ ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কোনো বাস্তবধর্মী উদ্যোগ নেই। বিষয়টি সত্যি অস্বস্তিকর। যে নারী ফুটবলাররা বারবার ফুটবলের মাধ্যমে দেশকে মহিমান্বিত করছেন, খেলার চত্বরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারাই ন্যূনতম সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এটি পুরো জাতির ব্যর্থতা।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে