Views Bangladesh Logo

বিজয় থালাপতির রাজনৈতিক দল ব্লকবাস্টার হবে, নাকি ব্যালট বক্সে মুখ থুবড়ে পড়বে?

Dipankar  Dipon

দীপংকর দীপন

তামিল সিনেমার সুপারস্টার বিজয় থালাপতি তার রাজনৈতিক দল ‘তামিলাগা ভেট্রি কাঝাগাম’ (TVK) শুরু করার ১৮ মাসের মধ্যেই তামিলনাড়ুর রাজনীতি কাঁপিয়ে দিচ্ছেন! ‘তামিলাগা ভেট্রি কাঝাগাম’ এর অর্থ হলো তামিল জনগণের বিজয়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কি শুধু আলোড়ন তুলে থেমে যাবেন, নাকি সত্যি সত্যিই পুরো খেলার নিয়মটাই পাল্টে দেবেন? আসুন সেটাই বোঝার চেষ্টা করি আজ। থালাপতি বিজয় (জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর) তামিল সিনেমার একজন সুপারস্টার অভিনেতা ও গায়ক, যিনি ১৯৯০-এর দশকে অভিনয় শুরু করে পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা হয়ে উঠেছেন। তার ক্যারিয়ার শুরুর দিকে তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও বর্তমানে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানীপ্রাপ্ত অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম। ভক্তদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা অত্যন্ত প্রবল, ফোর্বস ইন্ডিয়ার সেলিব্রিটি ১০০ তালিকায় তিনি সাতবার স্থান পেয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার বিশাল ফলোয়িং, যেমন ইনস্টাগ্রামে মাত্র ৮ মাসের মধ্যে ১০ মিলিয়ন ফলোয়ার সংগ্রহ করেছেন, যা কোলিউড অভিনেতাদের মধ্যে একটি রেকর্ড। দক্ষিণ ভারতের সিনেমা নায়কদের এমন ক্রেইজ নতুন নয়- নায়কদের পূজা করার নজিরও আছে, সেখানে কিন্তু এই জনপ্রিয়তা কি রাজনীতির মঞ্চে সব সময় সফল হয়? কংগ্রেস বা বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলগুলোর বিপরীতে আঞ্চলিক দলগুলোর সফলতাই বা কতটুকু? এই হিসাবটাই এখন কষা হচ্ছে। তামিলনাড়ুর রাজনীতি এর আগে দুবার বড়সড় ওলটপালট দেখেছে। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে আন্নাদুরাইয়ের দল ডিএমকে (Dravida Munnetra Kazhagam) কংগ্রেসকে হারায়। সেই প্রথমবার, তামিলনাড়ুতে দিল্লি-ভরসা কংগ্রেসের বদলে স্থানীয় বা আঞ্চলিক দল ক্ষমতায় আসে। আর দ্বিতীয়বার ১৯৭৭ সালে এম জি রামচন্দ্রন (MGR) নিজের দল এআইএডিএমকে (AIADMK) দিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন।

সি এন আন্নাদুরাই, এম. জি. রামচন্দ্রন ও বিজয় থালাপতি


সেই সময় থেকেই তামিলনাড়ুর রাজনীতি দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়- ডিএমকে বনাম এআইএডিএমকে। আর এই দ্বন্দ্বই পরের কয়েক দশক ধরে রাজনীতির মূল চিত্র হয়ে থাকে। এবার সেই একই রকম বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখছেন- সিনেমার আরেক সুপারস্টার, থালাপথি বিজয়! মাদুরাইতে তার দলের সম্মেলনে মঞ্চের ছবিটাই ছিল দেখার মতো। একদিকে আন্নাদুরাই আর এমজিআর, আর তাদের পাশে বিজয়ের বিশাল কাটআউট। নিচে লেখা- "ইতিহাস ফিরছে"। সেখানে বিজয় মঞ্চে বলেছে, ‘আমাদের একমাত্র আদর্শগত শত্রু হল বিজেপি। আমাদের একমাত্র রাজনৈতিক শত্রু হল ডিএমকে। এই ফ্যাসিবাদী বিজেপির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জোট বা সম্পর্ক রেখে আমরা কি বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দল হতে চাই?" সুপারস্টার বিজয় ঘোষণা করেছেন, তিনি ২০২৬ সালের তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে মাদুরাই পূর্ব আসন থেকে লড়বেন।

তার দল ‘তামিলাগা ভেট্রি কাঝাগাম’ (টিভিকে) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে- কোনো অবস্থাতেই ডিএমকে বা বিজেপির সঙ্গে জোট করবে না। দলীয় সম্মেলনে বিজয় বলেন, ‘টিভিকে গোপন চুক্তি করে না, আমরা কাউকে ভয় পাই না। সিংহ সবসময় সিংহ- সে ভিড়েও অনন্য, আবার একাও দুর্ধর্ষ। শিকারই তার লক্ষ্য, বিনোদন নয়।’ ৩৫ মিনিটের ভাষণে তিনি ডিএমকে সরকারকে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও জনবিরোধী নীতির অভিযোগে তুলোধোনা করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনকে সরাসরি আক্রমণ করেন। একই সঙ্গে বিজেপির বিভাজনমূলক রাজনীতিকেও একহাত নেন- ‘এটি ধর্মনিরপেক্ষ ভূমি, এখানে বিজেপির বিভেদনীতি কখনোই চলবে না।’ তিনি জেলেদের সমস্যা, নিট পরীক্ষা ইস্যু এবং কচ্ছাথিভু দ্বীপ ফিরিয়ে আনার দাবিও জোরালোভাবে তুলে ধরেন। সবচেয়ে বড় ঘোষণা- টিভিকে ২০২৬ সালের নির্বাচনে ২৩৪টি আসনেই প্রার্থী দেবে এবং বিজয় নিজেই দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী।

২১ আগস্টের মাদুরাই – এ টিভিকে – এর দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলনে থালাপতি বিজয়


সেপ্টেম্বরে শুরু হবে তার রাজ্য সফর, ডিসেম্বরের মধ্যে ২ কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে টিভিকে। বিজয় আশা করছেন, ২০২৬ সালটা তার কাছেও ঐতিহাসিক হবে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিজয় কি সত্যিই কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলছেন, নাকি পুরোটাই একটি সিনেমার মতো জমকালো শো? অনেকে বলেন, তার ভাষণগুলো যেন সিনেমার ডায়ালগ! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তার ভক্তদের কাছে এটাই দারুণ কাজ করছে। বিজয়ের দল এখনও কোনো ভোটে লড়েনি; কিন্তু তার জনপ্রিয়তা শুধু ফ্যান ক্লাবের মধ্যে আটকে নেই, বরং ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের মতো। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আর বাড়ির মহিলারাও এখন তার দিকে ঝুঁকছেন। যেখানেই যাচ্ছেন, চুম্বকের মতো ভিড় টানছেন।

গত বছর ভিকরাভান্দিতে তার প্রথম রাজ্য সম্মেলনে বিশাল ভিড় হয়েছিল। মাদুরাইতে দ্বিতীয় সম্মেলনটি ২৫০ একর মাঠে আয়োজন করা হয়েছিল। স্পষ্টতই, বিজয় একজন ভিড় টানার মতো নেতা। ভিড় দেখেই ভোটের হিসেব করা যায় না। তবে বড় দলগুলো কিন্তু বিজয়কে নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে। এআইএডিএমকে চাইছে বিজয়কে নিজেদের দিকে টানতে। আবার বিজেপি ভাবছে, বিজয় একা লড়লে ডিএমকের ভোট কাটবে, যা তাদের জন্য সুবিধাজনক। যে কারণে নিন্দকরা বিজয়ের টিভিকে (TVK) বিজেপির সি টিম বলে আখ্যা দিতে শুরু করেছে। তাই বিজয় এই সম্মেলন দিয়ে বুঝিয়ে দিল বিজেপির পতন তার উদ্দেশ্য। অন্যদিকে কট্টর তামিল জাতীয়তাবাদী নেতা সীমানও একসময় বিজয়ের সঙ্গে জোট করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ, বিজয়কে নিয়ে সবারই নিজস্ব অঙ্ক আছে; কিন্তু বিজয় কী ভাবছেন?

মনে রাখতে হবে বিজয় থালাপতি যে সময়ে অভিনয় ছেড়ে রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটি দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়গুলোর একটি। তামিল সিনেমা তখন হিন্দি সিনেমাকে টক্কর দিয়ে বাজার মাত করতে শুরু করেছে। প্রযোজনার খরচ হাজার কোটির ঘর ছাড়িয়েছে, আর প্রধান নায়কের পারিশ্রমিক পৌঁছে গেছে ২০০ কোটিরও বেশি। বিজয় নিজেও ৬৯তম সিনেমা ‘জানায়াগান’ এর জন্য ২৭৫ কোটি রুপি সম্মানী নিয়েছেন। সিনেমাটি আগামী বছর জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার কথা আছে এবং মিডিয়া জোর আলোচনা আছে যে, এটাই তার শেষ সিনেমা- কারণ এর পর থেকে তিনি রাজনীতিই করবেন শুধু। সে কারণে আর কোনো সিনেমা হাতে নেননি তিনি। তাতেই বোঝা যায়, চিন্তা-ভাবনা না করে নিজের ক্যারিয়ারের শীর্ষ সময়ে এবং দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার স্বর্ণযুগে সিনেমার জগৎ ছেড়ে রাজনীতির মঞ্চে পা রাখেননি তিনি।

বিজয়ের যে একটি কৌশল আছে সেটার সহজেই বোঝা যায়, কারণ বিজয় খুব মেপে পা ফেলছেন। তিনি তামিলনাড়ুর রাজনীতির চেনা ছকেই খেলছেন- রাজ্যের অধিকার, ফেডারেলিজম এবং হিন্দুত্ব-বিরোধী কথা বলছেন। তিনি ডিএমকেকে তার ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ আর বিজেপিকে ‘আদর্শগত শত্রু’ বলে ঘোষণা করেছেন। এক কথায়, তিনি এমন এক দ্রাবিড় রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চান, যেখানে দুর্নীতি বা পরিবারতন্ত্রের কোনো জায়গা থাকবে না। ‘দ্রাবিড় রাজনীতি’ (Dravidian Movement) ২০শ শতকের শুরুতে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও উত্তর ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল। যেখানে তামিল পরিচয়, ভাষা আর সংস্কৃতির সুরক্ষা, রাজ্যের অধিকারকে কেন্দ্রের উপরে প্রাধান্য দেওয়া (ফেডারেলিজম), বর্ণভেদ আর ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা, সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও শিক্ষার প্রসার বিষয়ে জোর দেয়া হয়। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে (DMK) আর এআইএডিএমকে (AIADMK)- এই দুই বড় দলই মূলত এই দ্রাবিড় রাজনীতির উত্তরসূরি।

থালাপাতি বিজয়ের পরের সিনেমা জানা নায়াগান ও সিনেমার একটি দৃশ্য তালাপতি বিজয়


এখনও পর্যন্ত কোনো বড় রাজনৈতিক দলই বিজয় থালাপতির নতুন দল টিভিকের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহ দেখায়নি। এর কারণও স্পষ্ট- তামিলনাড়ুর মানুষ বহুদিন ধরেই তৃতীয় শক্তিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বিজয়কান্ত বা কমল হাসানের মতো তারকারাও সেই দেয়াল ভাঙতে পারেননি। তবে এবার পরিস্থিতি আলাদা। বিজয়কে এখনই বাতিল করে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ তিনি কেবল দ্বিতীয় স্থানের জন্য খেলতে নামেননি, তার লক্ষ্য সরাসরি নেতৃত্ব। ডিএমকে আর এআইএডিএমকে- দুই শিবিরই বুঝতে পারছে, বিজয় এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছেন। তিনি জাতি, ধর্ম আর শ্রেণির ভেদাভেদ পেরিয়ে নানা স্তরের মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন থেকে বিরোধী নেতা পালানিস্বামী- সবাই এখন নিজেদের প্রচারে বাড়তি জোর দিচ্ছেন, যেন বিজয়কে আটকানো যায়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়- ইতিহাস কি এত সহজে তৈরি হয়? আন্নাদুরাই বা এমজিআর একদিনে নেতা হননি; তারা বছরের পর বছর মানুষের সঙ্গে থেকে নিজেদের জায়গা বানিয়েছেন।

সেখানে বিজয় চাইছেন একপ্রকার শর্টকাট; কিন্তু রাজনীতিতে শর্টকাটে কি সত্যিই সাফল্য আসে? তামিলনাড়ুতে সরকারের প্রতি ক্ষোভ আছে ঠিকই; কিন্তু শুধু সেই ক্ষোভের ভরসায় কি মানুষ একেবারে নতুন একজনকে রাজ্যের চাবি তুলে দেবে? বিজয়ের ক্যারিশমা আছে; কিন্তু ভোট জেতার জন্য শুধু ক্যারিশমা যথেষ্ট নয়। তার দরকার শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন আর বুদ্ধিদীপ্ত জোট কৌশল। আপাতত, বিজয় হলেন তামিলনাড়ুর রাজনীতির সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা। তিনি যে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু তিনি সত্যিই পরিবর্তনের কাণ্ডারি হতে পারবেন, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ২০২৬-এর নির্বাচনটা কি তাহলে সুপারস্টার বিজয় থালাপতির জন্য একটা পলিটিক্যাল ব্লকবাস্টার হতে চলেছে, নাকি বক্স অফিসের মতো ব্যালট বক্সে মুখ থুবড়ে পড়বে? উত্তরটা সময়ই বলে দেবে।

দীপংকর দীপন: চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ