মেসি কি পারবেন ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ খেলতে?
১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু। উৎসব প্রতি চার বছর পর পর। ২০২৬ এর বিশ্বকাপ ফুটবলের ডাক যত সময় যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে। ইতোমধ্যেই গত বিশ্বকাপ (২০২২) বিজয়ী আর্জেন্টিনা এবং বিগত বিশ্বকাপে ৫ বারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ২০২৬-এর রোমাঞ্চকর বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে ফেলেছে। বিশ্বকাপে ৯৬ বছরের ইতিহাসে কয়েক হাজার খেলোয়াড় দেশের হয়ে বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তাদের শেষ খেলা খেলেছেন। দেশের হয়ে খেলার চেয়ে গৌরবের তো আর কিছু নেই।
বিশ্বকাপে দেশের হয়ে মেসি শেষ খেলা খেলেছেন, আর তা দারুণ রঙিনভাবে উদযাপন করেছে তার দেশ। সারা বিশ্বের ফুটবল পিপাসুদের দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল এই খেলার প্রতি। মহাতারকা খেলোয়াড়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস আর শেষ খেলায় তার ভূমিকা দেখার জন্য। এমন নজির আর্জেন্টিনার জার্সিতে লিওনেল মেসি ছাড়া অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে মনে করতে পারছেন না পৌঢ় ব্রিটিশ ফুটবল লেখক ডেভিড স্মিথ। যিনি বিগত ৭৫ বছর ধরে বিশ্ব ফুটবল অনুসরণ করেছেন। যিনি ১৫টি বিশ্বকাপ প্রেস বক্স থেকে কাভার করেছেন। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে ম্যাচ রিপোর্টিং ছাড়াও প্রচুর সাইড স্টোরি লিখেছেন।
লিওনেল মেসি বলেই তো কথা। তিনি তো অতুলনীয় এবং অসাধারণ ফুটবল তারকা। বলা হয়ে থাকে এই পৃথিবী নয়, অন্য গ্রহ থেকে আসা তারকা। তিনি তার ক্যারিয়ারে যেভাবে আলোচিত, বিশ্লেষিত এবং কাঙ্ক্ষিত হয়েছেন- ফুটবলের ইতিহাসে এ ধরনের ভাগ্যবান এবং সর্বজনীন ভালোবাসা নিশ্চিত করার মতো তারকা খেলোয়াড়ের তালিকা খুব লম্বা নয়।
এক সময় সব খেলোয়াড়কেই মাঠ থেকে বিদায় নিতে হয়। কখনো বয়সের ভারে আবার কখনো ফর্মে উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলার জন্য। আসন্ন ২০২৬ বিশ্বকাপের সময় ৩৯ বছর পেরিয়ে যাবেন মেসি। ন্যাশনাল ডিউটির জন্য এটি কি চিন্তার বিষয়। যদিও মেসি তো এখনো আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রখর মধ্যাহ্নের মতো জ্বলছেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর বুয়েনস এইরেসের মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে বিশ্বকাপ ম্যাচে মেসি যেভাবে খেলেছেন, দেশকে তিন শূন্য গোলে জয়ের স্বাদ দিয়েছেন, নিজে ২টি গোল করেছেন। এরপর ২০২৬ বিশ্বকাপে তার ফর্মের অবস্থা কি হতে পারে এটি নিয়ে আশঙ্কা এবং গবেষণার কি সত্যি প্রয়োজন আছে? দলটি তো আর্জেন্টিনা আর ফুটবলের মহানায়ক যে মেসি।
আর্জেন্টিনা স্বপ্ন দেখছে ২০২২-এর বিশ্বকাপ শিরোপা ধরে রাখার। অবশ্যই এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত রাউন্ডের খেলা যত সময় গড়াচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ততই বাড়ছে। অবশ্যই এই ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি ভাগ্যের বিষয়টি জড়িত। মেসির জন্য যেটি সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো দলীয় খেলায়ও তিনি প্রধান ভরসা। তাকে ঘিরে সব ‘ফোকাস’। তিনি যে আস্থার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। দেশকে তিনি সবকিছুই দিয়েছেন- তারপরও তো প্রত্যাশার শেষ নেই। আর্জেন্টাইনরা ভাবছে আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবলে কি শেষ পর্যন্ত মেসি মাঠে নামতে পারবেন? তার চোখ জুড়ানো ফর্ম নিয়ে বয়স তো অবশ্যই একটি বিষয়। দেশের সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি কি পারবেন ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ খেলতে? মেসির সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনেছেন ‘দেখা যাক’। পরম করুণাময় প্রদত্ত প্রতিভার শেষ কোথায় বলা মুশকিল।
এটি বাস্তবতা ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে মেসির শেষ ম্যাচ। তার পক্ষে তো আর কখনো বিশ্বকাপ (২০৩০) বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ হবে না। আর তাই শেষ ম্যাচে আবেগপ্রবণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে ফুটবল তাকে অনেক অনেক দিয়েছে সেই ফুটবল তার আর খেলা হবে না, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ ফুটবল।
হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে এসেছিলেন ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে বিশ্বকাপে মেসির শেষ ম্যাচ দেখতে ভীষণভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে। একটি চিন্তা কাজ করেছে দেশের মাঠে শেষ খেলায় মেসি কি করেন? মেসি কিন্তু ম্যাচটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তার ফুটবল জাদুর মাধ্যমে। দর্শকদের দিয়েছেন স্বস্তি। স্বাভাবিকভাবেই মেসি ছিলেন প্রচণ্ড মানসিক চাপে; কিন্তু তারপরও ফুটবলের রাজপুত্র মাঠে প্রমাণ দিয়েছেন এখনো তিনি সেরা। এখনো তার প্রয়োজনীয়তা আছে। তিনি আগের মতো ফুটবল উপভোগ করেন।
মেসির ফুটবল ক্যারিয়ার যে সবসময় মসৃণ এবং আনন্দঘন ছিল তা কিন্তু নয়। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচিত হয়েছেন। তিনি কিন্তু লড়াই চালিয়ে গেছেন। মাঠেই সব কিছুর জবাব দিয়েছেন। তার যে বিষয়টি উল্লেখ করার মতো সেটি হলো আত্মবিশ্বাস এবং খেলার প্রতি ভালোবাসা এবং অনুরাগ। অনেক সময় নেতিবাচক প্রচারণা হয়েছে মেসির বিরুদ্ধে- বলা হয়েছে ন্যাশনাল ডিউটি থেকে অনেক বেশি কমিটেড তিনি ক্লাব ফুটবলে। মেসি কখনো বিতর্কে জড়াতে চাননি। তিনি তার মাঠের কাজটি করে গেছেন ধর্ম পালনের মতো।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে মেসির ক্যারিয়ার ২০ বছর। দেশের জার্সিতে খেলেছেন ১৯৪টি ম্যাচ। গোল করেছেন ১১৪। সহায়তা করেছেন ৫৮ গোলে। ১৭২ গোলে অবদান রেখেছেন। হ্যাটট্রিক করেছেন ১০টি। কোপা আমেরিকা জয় ২০২১ ও ২০২৪। কাতার বিশ্বকাপ জয় ২০২২। ফিনালিসিমা জয়ও ২০২২-এ। ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জয় ২০০৫। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক স্বর্ণ জয়। ৪৬টি ম্যাচে সেরার পুরস্কার। ৬টি টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার। মেসি দেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বাধিক আন্তর্জাতিক গোল করেছেন। এছাড়া ক্লাব পর্যায়ে ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৩টি ক্লাব বিশ্বকাপ, ১০টি লা লিগাসহ বার্সেলোনার জার্সিতে ছোট-বড় মিলিয়ে জিতেছেন ৩৪টি শিরোপা। পিএসজির হয়ে ৩টি আর ইন্টার মায়ামিতে ২টি শিরোপা জিতেছেন। অসাধারণ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। তিনি যেটি এক সময় ভাবেননি- সেই উৎসব করার আনন্দ তিনি পেয়েছেন। মানুষের প্রত্যাশাকে সবসময় সম্মান করেছেন প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ অথচ দৃঢ় চেতার অধিকারী মেসি। পেশাদারিত্বে তিনি হতে পেরেছেন পুরো ফুটবল বিশ্বের তরুণ খেলোয়াড়দের আদর্শ এবং অনুপ্রেরণা।
লিওনেল স্কালোনি আর্জেন্টাইন দলের প্রধান কোচ। এক সময় মেসির সঙ্গে খেলেছেন। মেসিকে খুব ভালোভাবে বোঝার এবং দেখার সুযোগ হয়েছে। অকপটে বলেছেন ‘আর্জেন্টিনা বা বিশ্ব ফুটবলে মেসির উত্তরাধিকারী কেউ হতে পারবে না। হয়তো কয়েকজন দুর্দান্ত খেলোয়াড় আসবে যারা একটি যুগকে সংজ্ঞায়িত করবে; কিন্তু এতদিন ধরে সে যা করেছে আমার মনে হয় তা অতুলনীয় হয়ে থাকবে।’
ফুটবলে মেসির জন্ম দেয়া রোমাঞ্চকর গল্পগুলো সবসময় সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। ফুটবলের মাধ্যমে আমোদ দেয়া এই চরিত্রকে আগামী বছর বিশ্বকাপ ফুটবল চত্বরে দেখার অপেক্ষায় থাকব।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে