দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে যে কারণে
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধির গতি। ফলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে সাধারণ নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ এখন বড়ই বিপদে রয়েছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চাইলেও তাদের আয় বাড়াতে পারছে না। যারা কিছুটা হলেও ক্ষমতার ধারক তারা মোটামুটি ভালো অবস্থানে রয়েছে; কিন্তু সাধারণ মানুষ মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছে। অন্যের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো আয় বর্ধনের কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। যেমন, রিকশা মালিক ইচ্ছে করলে মূল্যস্ফীতির অজুহাতে তার রিকশার জমা বৃদ্ধি করতে পারেন। রিকশা মালিক জমা বৃদ্ধি করলে রিকশাচালক ভাড়া বৃদ্ধি করে তা উসুল করতে পারেন; কিন্তু অসহায় যাত্রীতো আর চাইলেই তার উপার্জন বাড়াতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে যাত্রীকে বেশি ভাড়ায় গন্তব্যস্থলে যেতে হয়।
অথচ তাকে হেঁটেই উদ্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে হবে। অর্থাৎ যার হাতে সেবা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে তিনি চাইলেই তার আয় সামান্য হলেও বাড়াতে পারেন; কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সেটা করা সম্ভব হয় না। তাই দরিদ্র এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে তাদের সাংসারিক ব্যয় কর্তন করে জীবনযাত্রা পরিচালনার চেষ্টা করতে হচ্ছে। একসময় যারা মধ্যবিত্ত ছিলেন এখন তারা খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মুখ ফুটে তাদের সমস্যার কথা কারো নিকট প্রকাশ করতে পারেন না। যারা নির্দিষ্ট আয়ের চাকরিজীবী তারা আরো বেশি মাত্রায় বিপদের মধ্যে রয়েছেন। তারা যে বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। অথচ বাইরে তাদের নির্দিষ্ট স্ট্যাটাস বজায় রেখে চলতে হয়। যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তাদের সংসার চালানোর জন্য ব্যয় কর্তন করতে হচ্ছে। যারা নির্দিষ্ট বেতনের বাইরে অসৎভাবে অর্থ উপার্জন করেন তাদের কথা ভিন্ন।
অনেকের মধ্যেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, অভাবের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে; কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। আসলে কিছু মানুষ অভ্যাসগতভাবে দুর্নীতিতে আসক্ত। তারা দুর্নীতি করবেই। বর্তমান সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকগুলো ছাড়া অধিকাংশ মানুষই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ কতটা স্বস্তিতে থাকেন বা তাদের জাগতির জীবন কতটা সুখকর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে; কিন্তু তারা দৃশ্যত ভালোই আছেন। তারা মনে করেন, জাগতির শক্তির উৎস হচ্ছে অর্থ। আর কিছু মানুষ তো প্রকাশেই বলে বেড়ান ‘মানি ইজ সেকেন্ড গড।’ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা হচ্ছে অর্থের দাশ। অর্থ ছাড়া সমাজ কিছুই বুঝে না। যত প্রতিভা থাকুক না কেন কারো যদি অর্থ-বিত্ত না থাকে তাহলে সমাজে তার কোন মর্যাদা থাকে না। এর মধ্যেও কিছু মানুষ সৎভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন এটাই সান্ত্বনা।
বিগত সরকার আমলে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জনের গল্প শোনালেও প্রকৃত পক্ষে দেশে দরিদ্র মানুষের হার বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে স্বল্প আয়ের অধিকাংশ পরিবার তাদের জীবন যাত্রার ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ বা ঋণ করে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের হাতে এখন নগদ টাকার উপস্থিতি বাড়ছে। আসলে মানুষের হাতে নগদ টাকার উপস্থিতি বাড়ছে না, তারা ব্যাংকে সঞ্চিত তাদের অর্থ উত্তোলন করে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করছে বলেই এমনটা হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক গবেষণা উল্লেখ করেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়াছে। বর্তমানে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। এর মধ্যে অতিদরিদ্র মানুষের হার হচ্ছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
আরো অনেকেই আছেন যারা দারিদ্র্য সীমার সামান্য উপরে অবস্থান করছেন। সামান্য অভিঘাতেই তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে আসতে পারেন। দারিদ্র্য বৃদ্ধির এই প্রবণতা যে কোনো বিচারেই উদ্বেগজনক। তিন বছর আগেও দেশে দারিদ্রের হার কম ছিল। ২০২২ সালে সার্বিকভাবে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই সময় অতি দরিদ্র মানুষের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। দারিদ্র্য সীমার উপরে বসবাস করছে কিন্তু সামান্য অভিঘাতেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে এমন পরিবারের সংখ্যা হচ্ছে ১৮ শতাংশ। পিপিআরসি দেশের ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এই জরিপ কার্য সম্পন্ন করে।
সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, ২০২৫ সালে পরিবারপ্রতি মাসিক জাতীয় আয় ছিল ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। এর মধ্যে শহরে মাসিক আয় হচ্ছে পরিবার প্রতি ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা এবং গ্রামে ২৯ হাজার ২০৫ টাকা। পরিবার প্রতি গড় জাতীয় ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। মোট আয়ের ৫৫ শতাংশই চলে যায় খাবার ক্রয় করতে। মাসে একটি পরিবার গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা ব্যয় করে খাবার ক্রয়ের জন্য। বিগত ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। গত বছর জুলাই মাসে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ শতাংশ। এটা বিগত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির অভিঘাত একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কর্মজীবীদের মধ্যে ছদ্ম বেকারের হার বাড়ছে। কর্মজীবীদের প্রায় ৩৮ শতাংশই পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থানে নেই।
পিপিআরসি তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছে, গত তিন বছরে শহরের পরিবারগুলোর মাসিক আয় কমেছে কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। ফলে দারিদ্র্য ব্যবস্থার ওপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। একসময় যারা তুলনামূলক সচ্ছল অবস্থায় ছিলেন তারাও এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবার ঝুঁকিতে আছে। সংস্থাটি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেছে, দেশে ৮০ শতাংশ পরিবার তাদের তাদের উপার্জন দিয়ে সংসারের খরচ বাবদ যে ব্যয় হয় তা পূরণ করতে পারছে না। জনসংখ্যার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ পরিবারের মাসিক গড় আয় হচ্ছে ১৪ হাজার ৮৮১ টাকা। আর একই পরিবারের মাসে ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ১৭ হাজার ৩৮৭ টাকা। মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা ৪০ শতাংশ পরিবার গড়ে প্রতি মাসে আয় করে ২৮ হাজার ৮১৮ টাকা। আর তাদের ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ২৯ হাজার ৭২৭ টাকা। ৫২ শতাংশ পরিবার তাদের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোন না কোনোভাবে ঋণ গ্রহণ করছে। সবচেয়ে বিত্তবান ২০ শতাংশ পরিবার ভালো অবস্থায় রয়েছে।
তাদের মাসিক আয় হচ্ছে গড়ে ৭৮ হাজার ৫০৩ টাকা। আর ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৭০ হাজার ৭৭০ টাকা। গত তিন বছর ধরে অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় অধিকাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয় বাড়ছে না। যেমন ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। একই সময়ে মজুরির হার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর মজুরির হার ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে মানুষ সংসারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বারবার বাড়িয়েছে। পলিসি রেট আগে ছিল ৫ শতাংশ। অর্থাৎ শিডিউল ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট থেকে স্বল্পকালীন ঋণ বা ধার গ্রহণের ক্ষেত্রে ৫শতাংশ হারে সুদ দিতে হতো। এখন তা ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে; কিন্তু এই উদ্যোগ হিতে বিপরীত হয়েছে। পলিসি রেট বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে দেশে বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে। বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। উচ্চ শিক্ষিত বেকারের হার গত ১৩ বছরে আট গুন বেড়েছে। ২০১০ সালে স্নাতক পাশ বেকারের হার ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এটা ২০২৩ সালে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে; কিন্তু এটা আর বেশি দিন থাকবে না। ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে।
একটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের হার যদি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি হয় এবং নির্ভরশীল জনসংখ্যা (শূন্য থেকে ১৪ বছর এবং ৬৫ বা তার বেশি বয়সী) যদি কমে যায় তাহলে সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশের বয়স ছিল ১৫ বছর থেকে ৬৪ বছর। ২০১৯ সালে এটা ছিল ৬৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। তার অর্থ হচ্ছে আমরা অচিরেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল লাভ থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছি; কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগানোর কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন দেশে কারিগরি শিক্ষার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একে আধুনিকায়নের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষিতের হার ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে পারলে কর্মহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হতে পারে।
তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। কোনোভাবেই প্রকৃত আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রকৃত আয় কমে যাবার কারণে অধিকাংশ পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছু পরিবার আছে যারা এখনো দারিদ্র্য সীমার সামান্য উপরে অবস্থান করছে কিন্তু যে কোন সামান্য আর্থিক অভিঘাতেই তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে আসবে। ২০২৪ সালে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। একই সময় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অধিকাংশ পরিবারই মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বর্ধনের শ্লথ গতিতে বিপর্যস্ত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উপায় খুঁজতে হবে।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে