যারাই ক্ষমতায় যায় তারা মন থেকে গণতন্ত্র চায় না
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। একাধারে তিনি ইতিহাসবেত্তা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন ও গবেষণা করেছেন তাদের অন্যতম তিনি। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক লেখক, যিনি ১৯৭৩-এর নির্বাচন নিয়ে লিখেছেন ‘তিয়াত্তরের নির্বাচন’ নামে একটি বই। লিখেছেন ‘লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’, ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন পথে’, ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ ইত্যাদি গ্রন্থ। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে এখনো লিখে চলেছেন।
সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশ-এর ‘এডিটরিয়াল ডায়ালগ উইথ রাশেদ মেহেদী’ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আলোকপাত করেছেন দেশের রাজনীতির উত্থান-পতন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশ-এর সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। চার পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় পর্ব।
রাশেদ মেহেদী: এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ম্যাচুরিটি অর্জন করল। এতে শক্ত একটি গণতান্ত্রিক অবস্থান তৈরি হলো রাজনীতির মাঠে। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গুণগত গণতান্ত্রিক চর্চার সৃষ্টি হয়েছিল সেটি বারবার ব্যাহত হয়েছে। এটি পরিকল্পনা নাকি আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা?
মহিউদ্দিন আহমদ: একটি জিনিস খেয়াল করবেন, আশির দশকজুড়ে সামরিক শাসন বা এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনে কেবল সব দল নয়, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ একযোগে সব পেশাজীবী এরশাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। শেষের দিকে একপর্যায়ে পত্রিকাই প্রকাশিত হয়নি। ওই সময় আমরা দেখলাম, গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। আমরা যতই বলি ক্ষমতায় থেকে, সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি তৈরি করা হয়েছে- এগুলো সবই সত্য; কিন্তু সেই বিএনপিকে ভেঙে দিয়েছিলেন এরশাদ। বিএনপির অনেকে হুড়মুড় করে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। সেই বিএনপিকে কিন্তু আবার রিভাইটালাইজ করার ক্ষেত্রে অবদান খালেদা জিয়ার। আমি বলব, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হলেও রাজনৈতিক দলের চরিত্র দেয়ার কাজটা করেছেন খালেদা জিয়া। তিনি নিজেকে একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রমাণ করলেন।
১৯৯১ সালে যেটা হয়েছে হাসিনা-খালেদা দুজনই কিন্তু সমানতালে রাজনীতি করেছেন; কিন্তু শেখ হাসিনা পাওয়ার পলিটিক্সটা একটু বেশি বুঝতেন। খালেদা জিয়া আবার এগুলো বুঝতেন না। একানব্বইয়ের নির্বাচনে খালেদা জিয়া একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, এ দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন। এটি কীভাবে সম্ভব হলো? কারণ ১৯৯০ সালে আমরা একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার দেখলাম বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে। সেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় এটি হয়েছে; কিন্তু তিনি এটিকে কনস্টিটিউশনে ঢুকালেন না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে নাকচ করে দিলেন। অর্থাৎ যেই ব্যবস্থার বেনিফিশিয়ারি হিসেবে আপনি প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই ব্যবস্থাটিকে আপনি রাখলেন না। সাংবিধানিক রূপ দিলেন না। যার জন্য তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো, সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন শেখ হাসিনা- যেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন।
তার মানে, নির্বাচন ম্যানিপুলেট করে জোর করে ক্ষমতায় থাকার যে রাজনীতি, যেটি হাসিনা আশির দশকে রপ্ত করেছিলেন সেটার চর্চা খালেদা জিয়া শুরু করলেন ১৯৯১-এর পর। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একটি অদম্য বাসনা তৈরি হয়। এটি খালেদা জিয়ার মধ্যে আমরা দেখলাম ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর। নির্বাচন ম্যানিপুলেট করে পছন্দের লোক যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন সেই ব্যবস্থাসহ সবকিছু করেছেন তিনি।
রাশেদ মেহেদী: বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত একবারই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল, সেটা ২০০১ সালে। তখন থেকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি ধারা শুরু হয়েছিল; কিন্তু দেখা গেল ২০০৬ সালে সেটি আর থাকল না। যে কারণে ২০০৬ সালে অনিবার্য আন্দোলন হলো, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো। যে অবস্থা বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমানের সময় দেখেছি, সেটি আর পাওয়া গেল না। ২০০৬ সালে দেখা গেল ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি হলেন। তারপর অন্য একটি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ফখরুদ্দিন আহমেদ এলেন। ২০০৮ সালে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৫ সালে খালেদা জিয়ার যে চর্চাটি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পাশ কাটিয়ে যে কোনোভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে থাকা, সেটি শেখ হাসিনা ২০১৪, ১৮ ও ২৪ সালেও করলেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের রাজনীতিবিদরা চমৎকার সুযোগ পেয়েও কেন তারা কাজে লাগাল না। কেন যে কেউ ক্ষমতা পেলে কুক্ষিগত করার মানসিকতা তৈরি হয়?
মহিউদ্দিন আহমদ: পলিটিক্যাল লজিক দিয়ে এটি বিশ্লেষণ করা খুব কঠিন। দ্বিদলীয় রাজনীতির যে ধারা ১৯৯১ সালে শুরু হয়েছিল পরস্পরের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে, সেখানে ভোটারদের সামনে একটি চয়েজ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকলে ভোটাররা ৫ বছর একটি দলকে অবজার্ভ করে। পছন্দ না হলে তারা ওই দলের বদলে নতুন দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে। এটি ১৯৯১, ১৯৯৬ এমনকি ২০০১ সালেও দেখা গেল।
এখন সমস্যাটি হয়েছে, যারাই ক্ষমতায় যায় গণতন্ত্রের চর্চাটি তারা মন থেকে চায় না। মুখে হয়তো বলি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে থাকে ক্ষমতাটিকে একেবারে কুক্ষিগত করে রাখতে, যাতে আজীবন থাকা যায়। এ আজীবন ক্ষমতায় থাকার চিন্তা থেকেই কিন্তু এক সময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকার বিরোধিতা করেছিল। আবার একই কারণে আজীবন ক্ষমতায় থাকার লিপ্সা থেকে হাসিনা সরকার ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি বাতিল করে দিয়েছিল। কারণ এই ব্যবস্থা থাকলে ভোটারদের সামনে একটি চয়েজ থাকে, আপনি সেই চয়েজটি আর রাখলেন না। ১৯৭৫ সালেও আপনি দেখবেন, সাংবিধানিকভাবে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ শেখ মুজিবুর রহমান রাখেননি। তাহলে আপনি কীভাবে পরিবর্তন করবেন? তখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনটি আসতে বাধ্য। সেটি গণঅভ্যুত্থানও হতে পারে, সামরিক অভ্যুত্থানও হতে পারে। ১৯৭৫ সালে যেটি দেখা গেল- একই জিনিস দেখা গেল ২০২৪ সালেও।
মানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ রেজিম বদলানোর কোনো সুযোগ শেখ হাসিনা রাখেননি। হাসিনার আমলে আমরা তিনটি নির্বাচন দেখলাম ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪। ২০১৪ সালের নির্বাচন হাসিনা বৈধতা দিতে পারেন, কারণ বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। বিএনপি যদি বর্জন করে তাহলে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একশ পেল, দেড়শ পেল নাকি দুইশ পেল- সেটি বিএনপির প্রশ্ন করার কোনো রাইট (অধিকার) থাকে না। কারণ তারা তো যায়নি। হ্যাঁ, তারা একটি দাবি নিয়ে বলেছিল, এটি না হলে যাবে না। একই সঙ্গে বিএনপি বলেছিল এই নির্বাচন তারা প্রতিহত করবে; কিন্তু তারা পারেনি। এ কারণে সাধারণ মানুষকেই প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। আপনি নির্বাচন বর্জন করে যদি না ঠেকাতে পারেন তাহলে বর্জন করে কোনো লাভ নেই। তারপর ২০১৮-তে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল, কেন করল? কারণ নির্বাচন কমিশনের আইনে আছে, আপনি যদি পরপর দুবার নির্বাচনে না যান তাহলে আপনার নিবন্ধন কমিশন স্থগিত করে দিতে পারে। তাই দল হিসেবে অস্তিত্ব রাখার জন্য নির্বাচনে যেতেই হতো।
তারপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগে খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। তাকে রেখে বিএনপি নির্বাচনে গেল। জানি না নেপথ্যে কী আলাপ হয়েছিল, কয়টি সিট দিবে না দিবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যারা প্রার্থী তারা কেউ তার আসন ছাড়তে চায়নি। মনে করেন, বিএনপিকে হয়তো ১০০টির মতো সিট দিত, একটা সম্মানজনক শক্ত অবস্থান থাকত, সেটা হয়নি। বিএনপি তো আর ৬টি সিট পাওয়ার দল না; কিন্তু ৬টিই হলো; কিন্তু তারপরও বিএনপি পার্লামেন্টে গেল।
যাহোক অনেক কিছুই আমরা বুঝি না কেন এটি করল, কেন এটি করল না। আমাদের দেশে দুটি নির্বাচন সবচেয়ে বেশি ন্যক্কারজনক। একটি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন যেটির কোনো প্রয়োজন ছিল না। আরেকটি ন্যক্কারজনক নির্বাচন দেখলাম ২০১৮ সালে। ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে কি আর বলার আছে।
রাশেদ মেহেদী: এখানে একটি প্রশ্ন, বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আর সাধারণ কর্মীদের রাজনৈতিক দল থাকল না। দুর্বৃত্তায়িত ব্যবসায়ী, সুবিধাভোগী আমলা এমন কিছু লোক মিলে একটি সিন্ডিকেট করল। ২০২৪ সালে চূড়ান্তভাবে আওয়ামী লীগ মাঠের রাজনীতি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও গণমানুষের রাজনীতি থেকে পুরোপুরি হারিয়ে কিছু দুর্বৃত্তায়িত সিন্ডিকেটের সরকারে পরিণত হলো। যে কারণে জুলাই অভ্যুত্থানের আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের অনেকে সমর্থন দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন। এটি কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বড় ক্ষতি করে দিল না?
মহিউদ্দিন আহমদ: আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দল থেকে দানবে পরিণত হয়েছিল। দল, সরকার, রাষ্ট্র- তিনটি এক হয়ে গিয়েছিল এবং এক ব্যক্তির হাতে, শেখ হাসিনার। এতে দলটিকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দল নেই, সবকিছু হাসিনাময়। ওই সময় শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনগুলোতেও কে কী প্রশ্ন করবে ওটিও বলে দেয়া হতো। যারা উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবেন বলে তারা মনে করত, তাদের তো সংবাদ সম্মেলনে ঢুকতেই দিত না। আবার কেউ যদি একটি প্রশ্ন করেই ফেলত শেখ হাসিনা প্রচণ্ড রি-অ্যাক্ট করতেন। প্রায় দেখতাম, সুইচ টিপে দুইশ, তিনশ চারশ প্রকল্প উদ্বোধন করছেন শেখ হাসিনা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ছোটখাটো কালভার্ট ওনাকেই উদ্বোধন করতে হতো। পরিবারের সদস্যদের নামে, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবার নামে স্থাপনা। মানে পারিবারিকিকরণ এটি যে কত দৃষ্টিকটু, একেবারে মুঘল বাদশাদের মতো। সবকিছু বাদশাহের নামে হবে। এমনকি কারেন্সি নোটগুলো ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকার নোট সব কিছুতেই শেখ মুজিবের ছবি থাকতে হবে কেন? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, হাছন রাজা, ভাসানী, জাতীয় চার নেতার ছবি কি থাকতে পারত না? সবকিছুতে শেখ মুজিব থাকতে হবে কেন? এ কাজগুলো তিনি করেছেন। এটিতো পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আমি দেখি না, থাকলে আলাদা কথা।
(চলবে)
শ্রুতিলিখন: শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে