পেছন থেকে বিসিবি কে চালাচ্ছেন?
ক্রিকেট মাঠ এবং মাঠের বাইরে এত বেশি অক্রিকেটীয় খেলা চলছে গত কয়েক মাস ধরে, যেটি শুধু অগ্রহণযোগ্য নয় রীতিমতো নিন্দনীয়। বিষয়টি দেশের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের জন্য উদ্বেগজনক। ক্রিকেট নিয়ে যারা খেলছেন, পানি ঘোলা করছেন, যারা ইন্ধন জোগাচ্ছেন তারা ধরেই নিয়েছেন এখনই সময় মতলব হাসিল করার কেননা এ ধরনের মওকা আগামীতে আর নাও মিলতে পারে। ক্রিকেট পড়েছে ঝড়ের কবলে। খেলা থেকে ক্রিকেটে এখন মানুষ চরিত্র বড়। ক্রিকেটে বাড়ছে যথেচ্ছাচারিতা। বাড়ছে প্রবঞ্চনা, অসম্মান, অপমান আর লজ্জাজনক ভূমিকা। ক্রিকেট ‘ডকুমেন্টারি’ ক্রমেই লম্বা করে চলেছেন কুশীলবরা। যারা ব্যক্তি স্বার্থে অবিবেচকের মতো ক্রিকেট নিয়ে লাফালাফি করছেন, শত্রুভাবাপন্ন বিরোধিতায় গা-ভাসিয়ে দিয়েছেন এটি ঠিক হচ্ছে না। এখন প্রয়োজন দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
হিংসা, বিদ্বেষ আর স্ববিরোধিতা দূরে ঠেলে রাখা। ভদ্রলোকের খেলায় যদি ধৈর্য, সহিষ্ণুতা,শিষ্টাচার আর সুস্থ জীবনবোধ না থাকে তাহলে তো আর ক্রিকেট থাকবে না। ক্রিকেটের চেয়ে বড় তো হওয়ার কথা নয়। ক্রিকেটে নিজের সঙ্গে নিজের এত চ্যালেঞ্জ কেন। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের খেলা চলছে বিরতিহীনভাবে। ক্রিকেট পার করছে কঠিন সময়। মাঠের বাইরে সুবিধাবাদীদের ভিড় বাড়ছে। ক্রিকেটে অস্বচ্ছতা আর নোংরামি নতুন কিছু নয়- এগুলো আগেও ছিল তবে ঢাকনা দেয়া ঝুড়ির মধ্যে। সেই ঢাকনা খুলে গেছে। অনেকের বিভিন্ন ধরনের রূপ বেরিয়ে পড়েছে। গাছের ওপর থেকে নিচে নেমেও কোনো রকম টিকে আছেন। এরপরও লোভ আর চাহিদার শেষ নেই।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশের ক্রিকেট প্রশাসনকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটে কর্তৃত্ববাদিতা অতীতে সচেতন মহল দেখেছে। দেখেছে চাটুকারিতার নির্লজ্জ রূপ। এই চাটুকাররাই আবার সময়ের সন্তান হয়ে তাদের নেতাদের হেনস্তা করা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি। সত্য মিথ্যার বয়ান ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। এতে করে ক্রিকেটকে ঘিরে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থা ও বিশ্বাসহীনতার জন্ম হয়েছে। সবাই চান ক্ষমতার তাপ উপভোগ করতে। মিডিয়ায় উঠে আসছে একেক জনের একেক রকম ইচ্ছার কথা; কিন্তু চাইলেই তো সবকিছু সম্ভব নয়। মতলবি খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক বেশি। কে কীভাবে কতটুকু সুযোগ বাগিয়ে নিতে পারবেন ভবিষ্যতে একটি দেখার বিষয়।
এদিকে সত্য মিথ্যাকে ঘিরে প্রচুর গুজব ডানা মেলেছে। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে অবিবেচকের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চলেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে শুরু হয়ে গেছে নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোর খেলা। অনেককেই বলতে শুনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল- কিন্তু কে আসলে বোর্ড চালাচ্ছেন পেছন থেকে? অপ্রিয় শোনালেও সত্যি যে সংস্কার সাধনের নামে ক্রীড়াঙ্গনে এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থার জন্ম হয়েছে। সংগঠকদের বাদ দিয়ে তো ক্রীড়াঙ্গন চলবে না। সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বিস্তর ফারাক। জেলা, বিভাগ এবং অন্যান্য সংস্কার ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে তো সব খেলার জাতীয় ফেডারেশনের নির্বাচন প্রক্রিয়া জড়িত।
বিসিবির প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলাম বুলবুল বেশ কিছুদিন আগেই মিডিয়াকে বলছেন, বিসিবির নির্বাচন চলতি বছর অক্টোবর মাসেই অনুষ্ঠিত হবে। আর এর জন্য অক্টোবরে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন। বিসিবির সাবেক পরিচালক সিরাজ উদ্দিন আলমগীর মনে করেন ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্র সংশোধন ছাড়া নির্বাচন হলে তাতে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে অন্যায়ভাবে অনেকের কাউন্সিলর তখন ভোটার হয়ে যাওয়ার সুযোগ আবার উন্মুক্ত হবে। আগে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলো কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আলোচনার মাধ্যমে কাউন্সিলর চূড়ান্ত করার নিয়ম ছিল। সেইসঙ্গে কাউন্সিলরের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়াও বাধ্যতামূলক ছিল।
কিন্তু পরে নিয়ম বদলে ফেলা হয়। সেই থেকে জেলা ও বিভাগের ক্রীড়া সংস্কার সভাপতির একক স্বাক্ষরে কাউন্সিলর মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। পদাধিকারবলে এই সংস্থাগুলোর সভাপতি জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসকরা। তাদের একক ক্ষমতার অপব্যবহার অনেককে অন্যায়ভাবে এখনো বিসিবিতে ঢোকার পথ করে দেবে। উনারা সরকারি চাকরি করেন। ওপর থেকে কারো নাম পাঠাতে বললে তারা সেটি করতে বাধ্য। এরই সুযোগ নিয়ে অতীতে বিসিবিতে এমন অনেকে ঢুকেছেন যারা পরীক্ষিত ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন না, যেমন- শেখ সোহেলের খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। তবু কাউন্সিলর হয়ে বিসিবি পরিচালক হতে তাদের আটকায়নি। (দৈনিক কালের কণ্ঠ ১ আগস্ট ২০২৫)।
স্রেফ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে বিভাজন আর বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সব সময় বিরাজ করে। একজনের ভালো আরেকজন দেখতে পারেন না। আর তাই পিছে লেগে থাকার খেলা সব সময় চলে। টাকা আত্মসাৎ অভিযোগ করতে এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের টিম কিছুই পায়নি। এটি একটি স্বস্তি। বোর্ডে পরিচালক হিসেবে আছেন অথচ ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। ক্রিকেট চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা কারও কারও ভোঁতা হয়ে গেছে। কপটতা এবং দ্বিচারিতা দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ৮ জন পরিচালক জোটবদ্ধ হয়ে একটি এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেভাবে বোর্ড প্রেসিডেন্টের ফারুক আহমেদ বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করে তার প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করে চিঠি দিয়ে তাকে পদ সরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে অতীতে এর নজির নেই।
এই উদাহরণটি সব সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ‘হান্ট’ করবে। ক্রিকেটে এখন যা ঘটছে এটি ঘটতে দেয়া উচিত নয়। খেলোয়াড়রা পারছেন না প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে। ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। ক্রিকেটে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব। দেশের ক্রিকেটে আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বৈশ্বিক অবস্থান ক্রমেই নিম্নমুখী- আর এটি তিন সংস্করণে। সব সময় বলা হচ্ছে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে- সেই ঠিক আর হচ্ছে না। টিম সিলেক্টর, কোচ, ক্রিকেট অপারেশন এবং টিম ম্যানেজমেন্টের দিকে আঙুল সব সময় উত্তোলিত হয়ে আছে। প্রশ্ন উঠেছে তাদের ক্রিকেট আনুগত্য নিয়ে। মানুষ ক্রিকেটকে ভালো দেখতে দায়- সিন্ডিকেটের খেলা নয়। আর তাই দেখতে চায় যোগ্যদের ক্রিকেট বোর্ডে।
যারা সত্যি কাজ করার এবং ছাপ রাখার যোগ্যতা রাখেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সব সময় মাঠের বাইরে অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণের মতো ঘটনা ঘটানো হচ্ছে- এটি কাম্য নয়। ২৫ বছর ধরে আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা গঠনের আলোচনা চলছে। এখনো সেই আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা কাজ শুরু করতে পারেনি। ক্রিকেট তো ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং রাজশাহী কেন্দ্রিক। ১৮ কোটি মানুষের দেশে ২০ জনও বিশ্বমানের খেলোয়াড় নেই। পাইপ লাইনে আগেও খেলোয়াড় ছিল না এখনো নেই। ক্রিকেটকে তো ছড়িয়ে দেয়া হয়নি। তৃণমূলে যেতে হবে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে। আসন্ন ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে অনেকেই প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
কয়েকজন আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এটা একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় আগে আসতে হবে। প্রথম কাউন্সিলরশিপ নিতে হবে। কাউন্সিলর হওয়ার পরে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। নির্বাচিত হয়ে যারা আসবেন, তারা ঠিক করবেন কে প্রেসিডেন্ট হবেন। অনেকেই মনে করেছেন ক্রিকেট বোর্ডের আসন্ন নির্বাচনে আমিনুল ইসলাম বুলবুল আবার প্রার্থী হবেন। এনএসসির (জাতীয় ক্রীড়াপরিষদ) কোটায় আবার কাউন্সিলর হয়ে পরিচালক হবে। এরপর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবেন। গত ৬ আগস্ট এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কালের কণ্ঠকে আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেছেন, আমার আবার প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার কোনো দুরভিসন্ধি নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইচ্ছায় একটি নির্বাচিত কমিটির বাকি মেয়াদ আমি পুরো করে যাচ্ছি। বলতে পারেন আমি সরকারকে সার্ভিস দিচ্ছি। এটুকুই।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে