ক্রিকেটে আলোচনা এবং আত্মোপলব্ধি কোথায়?
যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া এখন আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নামার কথা কেউ ভাবতে পারে না। প্রস্তুতি আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। দেশের হয়ে যারা খেলতে নামেন তারা শিক্ষানবিস নয়। দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো সামর্থ্য না থাকলে- সুযোগ মিলবে না। ফাঁক তালে সুযোগ মেলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ক্রিকেটে খেলাটার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো নিজকে তুলে ধরার সুযোগ। আর এই সুযোগ সবসময় হাতছানি দেয়।
স্কিল এবং ট্যাকনিককে কাজে লাগানো মানেই উৎকর্ষ। অজুহাত দাঁড় করিয়ে পার পাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। ক্রিকেট নাট্যমঞ্চে সাদা-কালো বোঝার শক্তি এখন অনেক বেশি। তিন সংস্করণে মাঠে প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। আধুনিক ‘এন্টার টেইনিং’ ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ এখন তুঙ্গে। এই ক্রিকেটের ছন্দ যে সবার পছন্দনীয়। দেশের হয়ে খেলা অনেক বড় প্রেরণা এবং সম্মান। আর এই ক্ষেত্রে সম্ভাবনার চূড়ান্ত প্রতিফলন বাস্তবায়ন তো বাড়তি বোনাস। দেশের ক্রিকেট ৫৩ বছর তো সমকালকে অতিক্রম করে ইতিহাসের উপাদান হয়ে গেছে। ক্রিকেটে আবেগ নয়- যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা উচিত।
আসন্ন টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রস্তুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইসিসির সহযোগী সদস্য নেদারল্যান্ডস সিলেটে খেলবে টি-টোয়েন্টি তিন ম্যাচের সিরিজ- যথাক্রমে ৩০ আগস্ট এবং ১ ও ৩ সেপ্টেম্বরে। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, জাতীয় দলের হেড কোচ ফিন সিমন্স এবং অন্যরা হতাশ এবং বিরক্ত মিরপুরের উইকেট নিয়ে। উইকেটের যে আচরণ এটি দেশের ক্রিকেট উন্নয়নের পরিপন্থি। ক্রিকেট বোর্ড, কোচ, ক্রিকেট পরিচালনা এবং টিম ম্যানেজমেন্ট সবাই চান সিলেটে স্পোর্টিং উইকেট তৈরি করে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ অনুষ্ঠিত হোক। বোর্ড ইতোমধ্যেই পরিক্ষিত প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান পিচ কিউরেটর টনি হেমিংকে বাংলাদেশে আবার নিয়ে এসেছে।
বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত পিচ কিউরেটর শ্রীলঙ্কান গামিনি ডি সিলভাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। উইকেট নিয়ে এত হতাশা এবং ক্ষোভ- কিন্তু গ্রাউন্ডস কমিটির ভূমিকা কি ছিল। চাওয়া হচ্ছে টনি হেমিং সিলেট স্টেডিয়ামের উইকেট পাল্টে দিয়ে নতুন করে স্পোর্টিং উইকেট তৈরি করবেন- যেখানে রান বেশি হবে। বোলাররাও সুবিধা পাবেন। সমস্যা হলো সিলেটে এবার অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। উইকেট তৈরির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে আবহাওয়া। হাতে সময় কম। এই অল্প সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর কতটুকু কি করতে পারবেন। সিলেট ছাড়াও মিরপুরে উইকেটকে স্পোর্টিং করতে হবে। উইকেটের আচরণ প্রায়ই সমালোচিত হয় দেশের বাইরে। উইকেট নিয়ে কাজ করতে হবে চট্টগ্রামেও। ‘স্পোর্টিং উইকেট’ তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় দাবি। ক্রিকেটের ‘অ্যাপরোচ’ তো পাল্টে গেছে।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সিরিজে সুযোগ আছে নিজকে পরখ করার এবং সংশোধিত হওয়ার। এই সিরিজ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ দল উড়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে। সেখানে বাংলাদেশের প্রথম খেলা টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপে ১১ সেপ্টেম্বর হংকংয়ের বিপক্ষে। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে এসব অবাস্তব কথাবার্তা না বলে টিম বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত ম্যাচ টু ম্যাচ এগিয়ে যাওয়া। ধারাবাহিকতার সঙ্গে ভালো খেলা। পারিবারিক কারণে ছুটি নেয়াতে মেহেদি হাসান মিরাজ সিলেটে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবেন না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে এশিয়া কাপে খেলবেন। এশিয়া কাপ শেষ হওয়ার পর পর বাংলাদেশ দল আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডে এবং তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলবে।
এরপর দেশে খেলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। অনেক দিন ধরে ক্রিকেটের মধ্যে থাকতে হবে। ইতোমধ্যেই বোর্ড স্ট্রেন্স এবং কন্ডিশনিং কোচ, পাওয়ার হিটিং কোচ (তিনি থাকবেন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সিরিজ পর্যন্ত) এবং মনোবিদ নিয়োগ দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো খেলোয়াড়দের তরফ থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া এবং সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বসেছেন, তাদের মনোভাব জানতে চেয়েছেন এটি ইতিবাচক। এতে করে খেলোয়াড়দের সঙ্গে দূরত্ব দূর হবে। ক্রিকেটের কিছু কর্মকর্তা নিজের ভাবমূর্তি যেভাবে বাজারে প্রচার করতে পারেন- সেটা খুব কম কর্মকর্তাই পারেন। লক্ষ্য করি তারা নিজকে শক্তিশালী এবং আত্মপ্রত্যয়ী একজন হিসেবে উপস্থাপন করেন।
তারা ক্রিকেটের সাফল্য নিয়ে কৃতিত্ব দাবি করেন, আবার যখন পরিস্থিতি খারাপ হয় তখন পূর্বসূরিদের দোষারোপ করেন। কে ক্রিকেটের বন্ধু আর কে শত্রু এটি নিয়ে শুরু করা হয় বায়াস। দেশের ক্রিকেটে সুস্থ জনবান্ধব পরিস্থিতি সব সময় অনুপস্থিত। খেলাটি মুক্তি পাচ্ছে না বাতিল সংস্কৃতি থেকে! ক্রিকেটে শুধু কথা আর কথা- বাস্তবতায় এর গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায় খুব কম। অনেকেই বলতে শুনি ক্রিকেটে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে- বিষয়টি কিন্তু অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। অতিরঞ্জন শুধু খেলাকে নয়- খেলার চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জটিলতার সৃষ্টি করছে। মনে রাখতে হবে ক্রিকেটকে ঘিরে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর আবেগ, অনুভূতি, অভিব্যক্তি অবশ্যই অন্যরকম। ক্রিকেট তো শুধু বাংলাদেশে একটি খেলা নয়- এর চেয়েও বেশি কিছু! মানুষ ক্রিকেটের মধ্যে দেশ এবং জাতি চরিত্রকে সবসময় খুঁজে।
ক্রিকেটে প্রয়োজন প্রগতিশীল সংস্কার। প্রয়োজন গঠনতন্ত্রে জরুরি সংশোধন। যাতে করে মতলববাজ এবং সুবিধাবাদীরা গঠনতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে রাতারাতি কাউন্সিল হয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে না পারে। বিশ্বাস করি গঠনতন্ত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন থাকবে। ক্রিকেটে এক ধরনের কৌশলী অস্পষ্টতা আছে। আর এই অস্পষ্টতা দেশজুড়ে খেলার বিকাশে এখন অন্যতম অন্তরায়ের একটি। ক্রিকেটে তো সবাই চান জনগণের ইচ্ছার একটি সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ প্রকাশ।
একে অপরকে দোষারোপ করা সবসময় বিরুদ্ধাচারণ, সমস্যার সমাধান নয়। একদল অতীতের সব কিছুতেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। অতীতের সবকিছুই যে খারাপ ছিল না; কিন্তু নয়। চাটুকাররা তো ব্যক্তি স্বার্থে সবসময় তৎপর। ক্রিকেটে একটি প্রশ্ন সবসময় উচ্চারিত হয় আর সেটি হলো লাইনচ্যুত খেলাটি কখন লাইনে উঠতে পারবে। ক্রিকেটে কথা আর নসিয়তের শেষ নেই। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এই ক্ষেত্রে বাস্তবতার সঙ্গে ফারাক অনেক। ক্রিকেটে মানুষ দেখতে চায় দৃশ্যমান অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ফলাফলভিত্তিক কাজ। মাঠের ক্রিকেট থেকে বাইরের ক্রিকেটের আলোচনা যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ পেতে শুরু করেছে তখন থেকে দেশের ক্রিকেটের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। বিসিবির আসন্ন নির্বাচনের পালে জোরেই এখন বাতাস লেগেছে। এই ক্ষেত্রে এবার কিছু ব্যতিক্রম লক্ষণীয় হবে বলে মনে হচ্ছে।
খেলা থেকে কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড এবং পদে পদে তাদের বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক দুর্বলতা, ব্যর্থতা এবং ডিগবাজি প্রকটভাবে লক্ষণীয় হচ্ছে। ক্রিকেটের সাংগঠনিক কার্যক্রম ভুগছে আস্থাহীনতায়। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি গ্রাফ এখন নিম্নমুখী।
ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি হলো তরুণ সমাজ। তারা আগের যে কোনো প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী চিন্তাশীল বুদ্ধিমান, সচেতন এবং ইতিবাচক। পাশাপাশি অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষীও। তাদের ‘নয়ছয়’ বুঝিয়ে পার পাওয়ার দিন আর নেই। এদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে এদের চাহিদা। ক্রিকেটে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা নেই বলেই- খেলাটি যে অবস্থায় থাকার কথা ছিল সেখানে পৌঁছাতে পারেনি বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশে ক্রিকেট এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বলা মুশকিল আগামী দিনগুলোতে মর্যাদাশীল টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ‘স্ট্যাটাস’ কি হতে যাচ্ছে। ক্রিকেটে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক, পছন্দনীয়, অপছন্দনীয় এবং পক্ষপাতদুষ্টতায় ঠাসা। আর নাগরিক সমাজ তো অন্য ক্ষেত্রে মহাব্যস্ত। তাদের অনেকের কাছে ক্রিকেট তো নেহাৎ একটি খেলা।
ক্রিকেট চর্চা বা খেলা তো একদিন বা কয়েকদিনের বিষয় নয়। এটি সারা জীবনের খেলা। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাঙালি জাতির জীবন। তাদের আবেগ, সুখ ও দুঃখ। মানুষ যে ক্রিকেটারদের পেছনে ভালো এবং খারাপ উভয় সময় ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এটি অনেক বড় বিষয়। দুঃখ হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এই ইতিবাচক শক্তি এবং প্রেরণাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। পারেনি এতগুলো বছরেও দেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে একটি সহনীয় অবস্থায় নিয়ে যেতে। ওয়ানডে সংস্করণ ছিল বাংলাদেশ দলের শক্তির জায়গা। বিশ্ব ক্রিকেটেও তো কয়েক বছর আগে টিম বাংলাদেশ উল্লেখ করার মতো দুর্দান্ত পারফর্ম করেছে। এখন ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কি? আত্মসমালোচনা এবং আত্মোপলব্ধি কোথায়? কোথায় হারানো স্থান ফিরে পাওয়ার সংকল্পবদ্ধ মানসিকতা?
ক্রিকেট প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা সবসময় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে! ‘টেকসই’ ভবিষ্যতের বিষয়টি সম্মিলিতভাবে খুব কমই উচ্চারিত হয়। ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত ক্রিকেটকে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। খেলাটি বের হতে পারছে না বিভ্রান্তির জাল থেকে। স্ববিরোধিতা ক্রিকেটের নৈতিক অবস্থান সবসময় বিতর্কিত করছে। ক্রিকেটে বাড়ছে বাইরের হস্তক্ষেপ। যেটি কাম্য নয়। আইসিসি ঘুম থেকে জেগে উঠলে দেশের ক্রিকেটে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ক্রিকেটে নেতিবাচক প্রচারণা বড় বেশি বেড়ে গেছে।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে