ইন্টারনেটের দাম কমাতে কাজ করছে টাওয়ারকো, ইনডোরেও অবকাঠামো শেয়ার জরুরি
টেলিকম খাতে অবকাঠামো শেয়ার নিয়ে অপারেটর-টাওয়ারকো বিরোধ, টাওয়ারকো অ্যাসোসিয়েশন গঠনের প্রেক্ষাপট, ফাইভজি ও ইন্টারনেটের দাম, টেলিকম পলিসিসহ এই খাতের গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যু নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশ এর মুখোমুখি দেশের সবচেয়ে বড় টাওয়ার কোম্পানি ইডটকো বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও টাওয়ারকো অ্যাসোসিয়েনের সভাপতি সুনীল আইজ্যাক। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আল-আমীন দেওয়ান।
আল-আমীন দেওয়ান: বাংলাদেশ টাওয়ারকো অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) কেন গঠন করা হলো?
সুনীল আইজ্যাক: কর্মসুত্রে আমি গত আড়াই বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করলেও এই বাংলাদেশের মার্কেটের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক পুরনো। আমি প্রথম এখানে কাজ করতে শুরু করেছি ১৯৯৭ সালে। আর ২০১৪ সাল থেকে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের সাথে পেশাগতভাবে যুক্ত আছি। সেই অর্থে এই বাজারটি আমার কাছে নতুন নয়, বরং অত্যন্ত বোধগম্য ও সুপরিচিত।
আমরা বিটিএ তৈরি করেছি টাওয়ার শিল্পকে একটি সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠ ও প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার জন্য। নেটওয়ার্ক রোলআউট, স্পেকট্রাম, এনার্জি, এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন আমরা হই, যে কোনো একটি কোম্পানির জন্য একা এগুলো সমাধান করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন ভারতের DIPA বা ইউরোপীয় ওয়্যারলেস ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যাসোসিয়েশন প্রমাণ করেছে, যখন টাওয়ার কোম্পানিগুলো একসাথে আসে, তখন তারা নীতি প্রভাবিত করতে পারে, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে এবং ডিজিটাল প্রস্তুতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
আমাদের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে টাওয়ার অবকাঠামোকে একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এর মানে হলো শক্তিশালী নীতি-অ্যাডভোকেসি, বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) এবং স্থানীয় মূলধন উভয়কেই উৎসাহিত করা। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন আস্থা তৈরি করা যে বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো বিনিয়োগযোগ্য। একই সাথে আমরা চাই প্রতিটি জিবি ডেটা উৎপাদনের খরচ কমাতে। অবকাঠামোর শেয়ার করার মাধ্যমে, যেমন টাওয়ার, পাওয়ার সিস্টেম, ফাইবার ব্যাকহল বা DAS, ইত্যাদির মাধ্যমে অপারেটরদের খরচ কমে যায় এবং দ্রুত রোলআউট সম্ভব হয়। এতে ভোক্তাদের জন্য মোবাইল ব্রডব্যান্ড সাশ্রয়ী হয় এবং গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বাজার প্রতিযোগিতামূলক থাকে।
আল-আমীন দেওয়ান: গ্রামীণফোন ও রবি দেশের কিছু জায়গায় ৫জি চালু করেছে। অবকাঠামোর দিক থেকে কি বাংলাদেশ প্রস্তুত?
সুনীল আইজ্যাক: অবকাঠামোর দিক থেকে ৫জি হলো প্রযুক্তি-অ্যাগনস্টিক। আমাদের বিদ্যমান টাওয়ারগুলো ইতোমধ্যেই ৫জি সক্ষম। অপারেটররা নতুন অ্যান্টেনা বা রেডিও ইউনিট স্থাপন করতে পারে এবং প্রয়োজনে পাওয়ার সিস্টেম আপগ্রেড করতে পারে। ৫জি এর মূল নির্ভরশীলতা স্পেকট্রাম বরাদ্দ, সফটওয়্যার অ্যাক্টিভেশন এবং রেডিও ডিভাইসের ওপর, নতুন টাওয়ার গড়ার ওপর নয়।
তবে ইনডোর সিস্টেমে পরিবর্তন রয়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ প্যাসিভ অ্যান্টেনা ব্যবহার হয়, কিন্তু ৫জি এর জন্য অ্যাক্টিভ ইন-বিল্ডিং সলিউশন প্রয়োজন। তাই আউটডোর সাইটগুলো প্রস্তুত থাকলেও, ইনডোর কভারেজ ও পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট হবে পরবর্তী অগ্রাধিকার।
আল-আমীন দেওয়ান: টাওয়ার মোবাইল অপারেটরের আর টাওয়ারকোর মালিকানায় থাকার মধ্যে কী পার্থক্য ? ইন্ডাস্ট্রিতে কী প্রভাব পড়ে ?
সুনীল আইজ্যাক: যদি টাওয়ার কোনো অপারেটরের মালিকানায় থাকে, তবে সেটি তাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়। একটি মোবাইল টাওয়ারকে ৫জি প্রতিস্থাপনের জন্য অনুকুল ও শক্তিশালী করতে অতিরিক্ত ডিসি পাওয়ার, ব্যাটারি আপগ্রেড, ইত্যাদি ধরনের সংযোজন ও আপগ্রেডেশন এর কাজ করতে হয়। এই কাজগুলো ব্যয়বহুল।
কিন্তু যদি টাওয়ারের মালিক আমরা হই, সেক্ষেত্রে অপারেটরকে শুধু মাসিক ফি দিতে হয়। ফলে অপারেটরদের নগদ অর্থ স্পেকট্রাম, রেডিও এবং কাস্টমার ডিভাইসে বিনিয়োগ করতে পারে, যা প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রাহককে উন্নত নেটওয়ার্ক সেবা নিশ্চিত করতে কাজে দেয়।
উদাহরণ দিয়ে বললে বিষয়টি আরও সহজ হবে। ধরুন, একটি অপারেটরের কাছে যদি ১০০ কোটি টাকা থাকে:
নিজেদের টাওয়ার থাকলে হয়তো ৪০% খরচ হবে টাওয়ার আপগ্রেডে, ৩০% সক্রিয় যন্ত্রে, বাকিটা স্পেকট্রামে।
কিন্তু মোবাইল টাওয়ারের মালিকানা টাওয়ার কোম্পানির হলে ব্যবহার করলে এই অর্থ ব্যয় করবে টাওয়ার কোম্পানি। সেক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলো এই অর্থ প্রায় পুরোপুরিই সক্রিয় যন্ত্র, স্পেকট্রাম এবং কাস্টমার রোলআউটে খরচ করতে পারে।
ফলশ্রুতিতে, একই বাজেটে আরও বেশি ৫জি সাইট তৈরি করা যায় সহজে, কভারেজ দ্রুত বাড়ে এবং খরচও কমে।
আল-আমীন দেওয়ান: স্পেকট্রাম এবং নীতি সমর্থন কি যথাযথ?
সুনীল আইজ্যাক: স্পেকট্রাম হলো ৫জি এর অক্সিজেন। বর্তমানে বিটিআরসি ৭০০ মেগাহার্জ ও ৩৫০০ মেগাহার্জ ব্যান্ড মুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু শুধুমাত্র ৭০০ মেগহার্জ নির্ভর কৌশল অনেক দেশে ব্যর্থ হয়েছে। টেকসই পথ হলো উভয় ব্যান্ড একসাথে ব্যবহার করা। ৭০০ এর বিস্তৃত কভারেজ এবং ৩৫০০ এর গতি ও ক্ষমতার সন্নিবেশ। সেইসঙ্গে এই স্পেকট্রাম সাশ্রয়ী দামে হতে হবে।
প্রচলিত নিলাম পদ্ধতিতে স্পেকট্রাম বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের অগ্রিম ফি নেওয়া কার্যকর নয়। এর পরিবর্তে, স্পেকট্রাম বরাদ্দকে গ্রহণযোগ্য ও সাশ্রয়ী করতে হবে। সফল ৫জি বাজার, যেমন ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সবাই এই পথেই সফল হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রকদের উচিত হবে এটি শিক্ষা নেওয়া। সঠিক দামে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্পেকট্রাম দিলে টেলিকম শিল্প ও ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হবে।
আল-আমীন দেওয়ান: সম্প্রতি সরকার নতুন টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং পলিসি ২০২৫ অনুমোদন করেছে। বিটিএ এটিকে কীভাবে দেখে?
সুনীল আইজ্যাক: আমরা মনে করি এটি বাংলাদেশের টেলিকম খাতের জন্য অত্যন্ত বড় ও আশা জাগানিয়া পদক্ষেপ। এই নীতিতে টাওয়ার কোম্পানিকে জাতীয় অবকাঠামো প্রদানকারী হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে টাওয়ার আর কেবল অতিরিক্ত সম্পদ নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নতুন প্রণীত নীতিতে ফাইবারাইজেশন, গ্রামীণ কভারেজ প্রণোদনা, আইওটি (IoT), এজ কম্পিউটিং, প্রাইভেট নেটওয়ার্ক, স্মার্ট সিটি ইত্যাদি বিষয়গুলোতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এটি ইতিবাচক। তবে কিছু জায়গায় আরও স্পষ্টতা দরকার, যেমন বিদেশি বিনিয়োগ সীমা বা ইনডোর সিস্টেম ও ক্ষুদ্র সেল নির্মাণের স্বাধীনতা। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হলে এবং নতুন নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারবে, জিবি প্রতি খরচ কমবে এবং ডিজিটাল অবকাঠামোয় নেতৃত্ব নিতে পারবে।
আল-আমীন দেওয়ান: ৫জিতে আইবিএস (IBS), ডাস (DAS) ও নিউট্রাল-হোস্ট মডেল কীভাবে ইন-বিল্ডিং কভারেজ উন্নত করতে পারে?
সুনীল আইজ্যাক: বাংলাদেশে টাওয়ার কোম্পানিগুলো আউটডোর সাইট শেয়ার করতে পারে। কিন্তু ইনডোর অবকাঠামো (IBS/DAS) কেবল অপারেটররা শেয়ার করতে পারে। ফলে ইনডোর কভারেজ অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়, একই সাথে খরচ বেশি এবং ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে টাওয়ার কোম্পানি বা তৃতীয় পক্ষ নিউট্রাল-হোস্ট মডেল তৈরি করে, যা সব অপারেটর ব্যবহার করে। এভাবে খরচ কমে, কভারেজ বাড়ে এবং ভোক্তারা উন্নত ও নিরবিচ্ছিন্ন সেবা পায়। বাংলাদেশে নীতিতে এখনও এই শেয়ারিং অন্তর্ভুক্ত নয়—যা একটি বড় অসম্পূর্ণতা।
আল-আমীন দেওয়ান: বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতে বিদ্যুৎকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলা হয়। ৫জি এর জন্য এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সুনীল আইজ্যাক: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ৪জি সাইট ৩–৬ কিলোওয়াট ব্যবহার করে, যেখানে ৫জি সাইট সচল রাখতে লাগে ১০–২০ কিলোওয়াট। দেশজুড়ে ৫জি কভারেজ এই হিসাবের আওতায় ধরলে খরচ কয়েক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
এজন্য আমরা ইউটিলিটি কোম্পানির সাথে বাল্ক পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট, হাইব্রিড সিস্টেমে বিনিয়োগ, এবং গ্রিন এনার্জি সরঞ্জামে কর ছাড়ের দাবি করেছি। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক পরিকল্পনা অপরিহার্য।
আল-আমীন দেওয়ান: অতিবৃষ্টি, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে কেন দেখা যায়? এ সমস্যা সমাধানে বিটিএ কি ভূমিকা রাখতে পারে?
সুনীল আইজ্যাক: এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোবাইল টাওয়ার সচরাচর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় মূলত বিদ্যুৎ না থাকার কারণে। একটি মোবাইল টাওয়ার সচল রাখতে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়, তা ব্যাকআপ দিতে পারে মাত্র ৪–৬ ঘণ্টা। এর পরবর্তী সময়ে টাওয়ার সচল রাখতে হলে জেনারেটর আনতে হয়, কিন্তু বন্যা, অতিবৃষ্টি বা সাইক্লোনের সময় রাস্তা বন্ধ থাকে, ফলে অনেক জায়গায় জেনারেটর পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
এ সমস্যা সমাধানে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিটিআরসির সাথে কথা বলেছি। এই অবস্থার উন্নয়নে বিটিআরসি এখন বিদ্যুৎ কোম্পানি ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করছে। আমরা সোলার, স্মার্ট ব্যাটারি এবং উঁচু প্ল্যাটফর্মে যন্ত্র বসাচ্ছি। ভবিষ্যতে এর স্থায়ী সমাধানে কমিউনিটি-ভিত্তিক সমাধানেও ইচ্ছুক, যেমন মাইক্রো-গ্রিড, যা স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে।
আল-আমীন দেওয়ান: ৫জি-এর কোন ব্যবহারিক উদাহরণ থেকে বাংলাদেশ শিখতে পারে?
সুনীল আইজ্যাক: ফিলিপাইনে ৫জি ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস দিয়ে ঘরে দ্রুত ইন্টারনেট দেওয়া হচ্ছে। ভারতে জিও, এয়ারটেল এটিকে ওয়াইফাই রাউটার, টিভি চ্যানেল, স্ট্রিমিং অ্যাপসহ বান্ডল করেছে। মালয়েশিয়াতে শেয়ারড নেটওয়ার্ক হয়েছে।
বাংলাদেশেও পোশাক কারখানা, বন্দর, ঘরবাড়ি, সবখানে একই রকম ব্যবহার সম্ভব, যদি ইনডোর কভারেজ উন্নত হয় এবং নীতি সহায়ক হয়।
আল-আমীন দেওয়ান: সামনে বিটিএ-এর সবচেয়ে বড় ফোকাস কী?
সুনীল আইজ্যাক: আমরা শুধু আগামী বছরের জন্য নয়, আগামী দশকের জন্য পরিকল্পনা করছি। আমাদের টাওয়ারগুলো এখনই ৫জি-এর জন্য প্রস্তুত এবং ভবিষ্যতে ৬জিও সামলাতে পারবে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো প্রতি জিবি খরচ। খরচ কমলে দেশের প্রতিটি গ্রামীণ শিক্ষার্থী, আরএমজি কর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সবাই ডিজিটাল অর্থনীতিতে যুক্ত হতে পারবে।
আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের জন্য টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যদি ৫জি সেবা দিতে গিয়ে প্রতি জিবি খরচ বেড়ে যায়, তবে সেটা জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক। আমাদের উদ্দেশ্য তেমন কিছু কখনো ঘটতে না দেওয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে