ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগী হতে রপ্তানি আয় দ্রুত প্রত্যাবাসন দরকার
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আইটি এবং বিটুসি ই-কমার্স বিজনেসের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কত রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এ ধরনের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে এবং তা আরও বাড়তে পারে সঠিক নীতিমালা থাকলে এ খাত থেকে রপ্তানি এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণ সম্ভব। এরা মূলত বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়া যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এফ কমার্স ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ব্যবসায় পরিচালনা করে।
এ ছাড়াও অনলাইন মার্কেটপ্লেস এবং নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও তাদের পণ্য বিক্রয় করে থাকে তবে এরা মূলত ড্রপ শিপিং করে অর্থাৎ তার নিজের কোনো পণ্যের মজুত থাকে না- তিনি সরাসরি গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডার গ্রহণ করে অন্য উৎপাদনকারীর কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে অথবা নিজস্ব উৎপাদন থেকে পণ্য গ্রাহকের ঠিকানায় পাঠায়। বাংলাদেশে ই-কমার্স অনেকটাই এ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ড্রপ শিপিংও করা সম্ভব। ক্রস বর্ডার ই-কমার্স বাংলাদেশে পরিচালিত হলেও রপ্তানি আয় দ্রুত প্রত্যাবাসন বেশ বড় সমস্যা।
দেখা যায় বিটুসি ই-কমার্স সেলস ২০২৪ সালে ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, এবং ফোরকাস্ট রয়েছে যে আগামী ২০২৭ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ইউএসডি ৮ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন। অনলাইনে রিটেইল বিক্রি বিশেষভাবে বেড়েছে, কারণ মোবাইল শপিং, ডিজিটাল ওয়ালেট, এআইর মাধ্যমে পারসনালাইজেশন এবং সর্বোপরি লজিস্টিক্স ব্যবস্থাপনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো দেশ থেকে সুন্দর পছন্দমাফিক পণ্য ক্রয় সহজলভ্য হয়েছে। অনেক ধরনের খুচরা পণ্য বিক্রয়ের বিভিন্ন পদ্ধতির উন্নয়নের ফলে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এ থেকে খুব বেশি সুবিধা নিতে পারছে না, কারণ এর জন্য যে পদ্ধতি চালু রয়েছে তাতে পেমেন্ট পেতে উদ্যোক্তাদের সমস্যা হয়। ১০ ডলারের রপ্তানির জন্য এবং মিলিয়ন ডলার রপ্তানির জন্য নীতিমালা প্রায় একই ধরনের।
এসএমইদের জন্য মার্কেটপ্লেস তৈরি এবং তাদের বিক্রীত পণ্যের অর্থ ফেরত পাওয়া একটি দুরূহ ব্যাপার, এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এসএমই ফাউন্ডেশন, জানা গেলো তাদের পণ্যের প্রচুর চাহিদা থাকলেও পণ্য বিক্রির পর তাৎক্ষণিক অর্থ হাতে পাওয়ার জন্য যে সব প্রতিবিধান বা পেমেন্ট গেটওয়ে থাকা দরকার, তা সেভাবে নেই বা যেটুকু রয়েছে, তা এসএমইদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। অর্থাৎ বিটুসি বা বিজনেস টু কনজিউমারের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা সীমিত। অথচ বিটুসি ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক করা হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের পণ্য আরও অধিক হারে বিশ্ব বাজারে নিয়ে যেতে পারতেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ সম্ভব হতো এবং তাদের ক্যাশ ফ্লো বাড়ত এবং সেই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত হতো।
বিটুসি বিক্রয় সম্ভব হচ্ছে না কারণ পেমেন্ট গেটওয়ে তৈরি নয়। এ পর্যন্ত বেশ কিছু পেমেন্ট গেটওয়ে যেমন SSLCOMMERZ, AamarPay, and ShurjoPay ইত্যাদি কাজ করলেও তাদের সেবায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সন্তুষ্ট হতে পারছে না। এ ছাড়াও মোবাইল ওয়ালেট হিসেবে রয়েছে বিকাশ, নগদ কাজ করছে। তবে SSLCommerz বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে আছে এবং এগ্রিগেটর হিসেবে কাজ করছে। তবে ছোট পেমেন্ট এর জন্যও ইএক্সপি বা ইএক্সপি ফর্ম যা রপ্তানির জন্য একটি বাধ্যতামূলক ডকুমেন্ট তার দরকার হয়। এর জন্য রপ্তানিকারক তাদের শিপমেন্টের জন্য অথরাইজড ডিলারদের (এডি) মাধ্যমে একটি অনুমোদিত ফর্ম পূরণ করে, এডিরা পূরণকৃত ইএক্সপি ফর্ম বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রেরণ করেন যাতে মনিটরিং কার্যক্রমে সঠিকভাবে করা যায়, এটি ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশনের একটি অংশ। খুবই ছোট একটি পেমেন্টের জন্য এ ইএক্সপি ফর্ম পূরণ একটি দুর্ভোগ যে কারণে অর্ডার পেলেও রপ্তানি সম্ভব হয় না।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতকৃত চামড়া এবং চামড়াজার পণ্য, পাট এবং পাটজাত পণ্য, হাতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, হাল্কা প্রকৌশল পণ্য, সিরামিকস পণ্য এসব ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র উদ্যোগের বিশাল পরিধি রয়েছে এবং এগুলো কম বেশি বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে তবে প্রতিকূলতাও রয়েছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মনে করেন তাদের বাধাগুলো অপসারিত হলে তারা অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।
তবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর হলো যে, গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি এফই সার্কুলার ইস্যু করেছে এতে ই-কমার্স ওয়েব সাইটের মাধ্যমে যারা বিটুসি রপ্তানি করবেন তাদের ক্ষেত্রে কাস্টমসকে প্রদানের জন্য বাধ্যতামূলক ইএক্সপির দরকার হবে না, যদি রপ্তানি মূল্য ইউএস ডলার ৫০০ পর্যন্ত হয়, তবে শর্ত রয়েছে যে পেমেন্ট হতে হবে শিপমেন্টের পূর্বে। এবং অথরাইজড ডিলারদের কাছে রপ্তানিকারকের কাস্টমারের কাছ থেকে এমন একটি ডিক্লারেশন থাকতে হবে যে, পণ্যটি সঠিক রপ্তানি মূল্য পাবে। গাইড লাইন্স ফর ফরেইন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশন (জিএফটি) ভলিউম-১ এর মাধ্যমে এ বিধানটি দেয়া হয়েছে এবং এ সার্কুলারের মাধ্যমে পূর্ববর্তী সার্কুলার বাতিল করা হলো বলে ধরে নিতে হবে। এ সার্কুলারের নির্দেশনাগুলো এক বৎসরের জন্য বৈধ থাকবে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি ভালো উদ্যোগ, তবে এক্ষেত্রে বিষয়টি অনেকেই জানে না, এটি প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এমনকি ব্যাংকগুলো ও বিষয়টি তেমন নজরে আনেনি অথবা ব্যাংকের মনোভাব যেহেতু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য খুব সুখকর নয়, তাই এটা জানলেও তারা এ সুবিধা তাদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পাক, সেটা তাদের অগ্রাধিকার নয়। এক বৎসরের এ সুবিধার দুমাস পার হয়ে গেছে বাকি ১০ মাসে এ সুযোগ কতজন ব্যবহার করতে পারবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে এরই মধ্যে আইটি খাতে ফ্রিল্যান্সাররা কাজ করছে এগুলো আইটি এবং আইটিইএস বা ইনফরমেশন টেকনোলজি এনাবেল্ড সার্ভিসেস প্রদান করে, তাদের ক্ষেত্রে এক্সপোর্ট প্রসিডস পাওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার। তাই এ ক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে যেমন স্ক্রিল (Skrill) ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। এ সেবাগুলো স্পর্শাতীত সেবা এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খুব ছোট ছোট পেমেন্ট হয়ে থাকে। এরা মূলত বিটুসি এর মাধ্যমে সরাসরি বিক্রয় করে থাকে, তাদের জন্য ইএক্সপি ফর্ম এবং গতানুগতিক রপ্তানি দলিলাদি প্রায় অসম্ভব, তাই এরা মূলত ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে অল্প বা ছোট (১০-৫০ ডলার) কনসাইমেন্ট দ্রুততার সঙ্গে পেমেন্ট পেয়ে থাকে। এ সুবিধা ফিজিক্যাল বা বস্তুজাত পণ্যের ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত এক্সপোর্ট প্রসিডস ব্যাংকিং চ্যনেলে সব ধরনের প্রতিবিধান মেনে রপ্তানিতে অনুমতি প্রদানে আগ্রহী। তারা মনে করেন যে ডিজিটাল ওয়ালেটস এর সুবিধা বস্তুজাত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রদান করা হলে এখানে স্মাগলিং, আন্ডার রিপোরটিং এবং বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষতিজনিত ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
যাই হোক সার্কুলার ৩১-এর মাধ্যমে আপাত যে সুবিধা দেয়া হয়েছে সেটি গ্রহণ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কিছুটা হলেও উপকার পেতে পারে, এবং এক্ষেত্রে সফলতা আসলে ভবিষ্যতে এর পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অ্যাডভোকেসি করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যেহেতু শিপমেন্টের আগে পেমেন্ট পেতে হবে, তাই এর বিষয়টি অনেকটা টিটি বা টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার এর মতোই হতে পারে। কিছু উদ্যোক্তাদের তথ্যে জানা যায় ব্যাংকগুলো টিটির মাধ্যমে যেসব রপ্তানির পেমেন্ট আসে তার পুরোটা উদ্যোক্তাকে দেয় না, শিপমেন্ট হওয়ার পর পুরো পেমেন্ট দিয়ে থাকে। বিটুসি ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা হলে উদ্যোক্তা পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বা অন্যান্য খরচ মেটাতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে।
এ ছাড়া অন্যান্য সমস্যার মধ্য নমুনা আমদানি এক চিরন্তন সমস্যা। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তার উৎপাদনের জন্য নমুনা আমদানিতে যে সমস্যার সম্মুখীন হন তাকে ‘ঐতিহাসিক পেইন’ বলে আখ্যায়িত করলেন। নমুনা আমদানির এ সমস্যা দীর্ঘদিনের অথচ পৃথিবীর সব দেশে নমুনা আমদানিতে শুধু একটি সংজ্ঞা দিয়েই তা সমাধান করেছেন। নমুনা হলো এমন একটি জিনিস যা কারও ব্যবহারের অনুপযোগী, পারফুরেটেড, রঙের ছোপ যুক্ত ইত্যাদি যার অর্থনৈতিক মূল্য শুধু নমুনা হিসেবেই ব্যবহারযোগ্য; কিন্তু এখানে রয়েছে অসংখ্য পদ্ধতি। এটি বাংলাদেশের আমদানি নীতিতে অন্তর্ভুক্ত সংখ্যার চেয়ে বেশি আমদানি করা যাবে না। তাও আবার এখানে শুধু তৈরি পোশাক এবং চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পরিমাণের কথা বলা রয়েছে, অন্যন্য ক্ষেত্রে তাকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কাছে যেতে হবে অনুমোদনের জন্য।
একটি ডিমিনিমিস ভ্যালু অনুমোদিত আছে, যা দুহাজার ইউএস ডলার, অনুমোদিত সংখ্যার বেশি বা মূল্যের বেশি হলে তার জন্য এলসি করতে হবে, যা একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য সময় এবং অর্থ দুটি ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মতে এসব ক্ষেত্রে তাদের অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কাস্টমস থেকে নমুনা ছাড় করাতে হয়, যা তাদের অপ্রতিযোগী করে তোলে।
অন্যদিকে বেশিরভাগ এসএমই কমার্শিয়াল আমদানিকারকের কাছ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকে, তাদের বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা নেই, বিগত বাজেট ২০২৫-২৬ অর্থবছরে একটি সেন্ট্রাল বন্ডেড হাউসের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, এ ছাড়া আমদানি নীতিতে আংশিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার কথা বলা হলেও এ যাবৎ তা বাস্তবায়িত হয়নি।
২০২৪ সালের ইকোনমিক সেনসাস অনুযায়ী যে ১১ দশমিক ৮ মিলিয়ন বিজনেস এস্টাবলিশমেন্ট দেশে রয়েছে তার মধ্য প্রায় ১১ মিলিয়ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ তবে এর মধ্য রয়েছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি এ চারটি বিভাজন তার মধ্য সর্বাধিক হলো কুটির এবং তার পর মাইক্রো উদ্যোগ। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আর একটি ক্যাটাগরি হলে ভালো হতো বা মাঝারি এবং বৃহত একসঙ্গে থাকলেই বরং ভালো হতো, যেটা হতে পারতো সিএমএসে এবং এলএমএসে। তবে আমাদের মধ্য এসএমই একটি বাজ ওয়ার্ড বা গুঞ্জন হিসেবে চালু হয়ে গেছে তাই আমরা সকলে এসএমই বলতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
এ ক্ষুদ্র শিল্পগুলো যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ই-কমার্স বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিটুসি ব্যবস্যায় এগিয়ে এসেছে, তবে তাদের এক্সপোর্ট প্রসিডস বা রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ পেতে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে, সেটি কিছুটা সহজ করা হলে ক্ষুদ্র উদ্যোগ প্রাণবন্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিডিউল ব্যাংকগুলো আরও এসএমই বান্ধব হিসেবে কাজ করলে এ থেকে সুফল আসতে পারে।
ফেরদৌস আরা বেগম: অর্থনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে