তৃতীয়বারের মতো বিধ্বস্ত এফ-৭ বিমান, পদ্ধতিগত পরিবর্তন না আনাই দায়ী
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এখন পর্যন্ত পাইলটসহ ১৯ জন নিহত এবং দেড় শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে বিধ্বস্ত হলো এফ-৭ সিংগেল ককপিটের এ ধরনের মালটি রোল ফাইটার এয়ারক্রাফটটি।
সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর বেলা ১টা ২৪ মিনিটে বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়নের পর পরই বিধ্বস্ত হয়। সেটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হলে আগুন ধরে যায়। নিহত ১৮ জনের তথ্য প্রকাশ করে আহত ও দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ১৬৪ জন চিকিৎসাধীন বলেও জানিয়েছে আইএসপিআর। হতাহতদের বেশির ভাগই মাইলস্টোনের শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সূত্র জানায়, বিধ্বস্ত এফ-৭ বিজিআই বিমানটি মূলত চীনের তৈরি চেংদু জে-৭ সিরিজের যুদ্ধবিমান। প্রস্তুতকারক চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে এই সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক মডেলের যুদ্ধবিমান সরবরাহের পর চীন এই সিরিজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয় চীন।
বাংলাদেশে এই মডেলের বিমানের তৃতীয় দুর্ঘটনা এটি। এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরের রসুলপুরে ফায়ারিং রেঞ্জে মহড়ার সময় বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দিপু নিহত হন। এরপর ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ এমবি। এতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিহত হন। আর এবার অন্যদের সঙ্গে নিহত হলেন পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার তৌকির ইসলাম সাগরও।
এফ-৭ বিজিআই (যেখানে আই বলতে ইমপ্রুভড বা আগের ভার্সনের চেয়ে উন্নত বোঝানো হয়) যুদ্ধবিমানটি মূলত এফ-৭ বিজি-এর উন্নত রূপ, যার মূল ভার্সন জে-৭ জি। এই এফ-৭ বিজিআই মূলত বাংলাদেশের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছিল।
এফ-৭ বিজির তুলনায় এফ-৭ বিজিআইয়ের বেশ কিছু চোখে পড়ার মতো আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন এফ-৭ বিজিআইয়ে তিনটি মাল্টি ফাংশনাল ডিসপ্লে এবং আরও শক্তিশালী ফায়ার কন্ট্রোল রাডার রয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০১১ সালে ১৬টি যুদ্ধবিমান সরবরাহের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সাল নাগাদ এই যুদ্ধবিমানগুলো আসে বাংলাদেশে।
সূত্রের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই ভ্যারিয়েন্ট। তবে এফ-৭ এমবি ও এফটি-৭ ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে। তবে মোট ফাইটার ভ্যারিয়েন্ট ৩৬টি।
লাইটওয়েট মাল্টিরোল ফাইটার ধরনের এই যুদ্ধবিমানগুলোর গতি সাধারণত মাক ২ দশমিক ২ বা শব্দের গতির অন্তত ২ দশমিক ২ গুণ। এগুলোতে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার গাইডেড বোমা, জিপিএস গাইডেড বোমা এবং বাড়তি জ্বালানি ট্যাংক ও অস্ত্র বহনে পাঁচটি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে। এই যুদ্ধবিমানগুলো ১ হাজার ৫০০ কেজির মতো ভার বহন করতে পারে।
এ ধরনের যুদ্ধবিমানের ককপিটে একজনমাত্র পাইলট বসতে পারেন। ককপিট সম্পূর্ণ কাচের। এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করা হয়েছে কেএলজে-৬ এফ রাডার। এই যুদ্ধবিমান ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ মিটার বা ৫৭ হাজার ৪২০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, বেশির ভাগ রাশিয়ার বিগ-২১ ও অন্যান্য সমসাময়িক অনেক যুদ্ধবিমানের চেয়ে এটি বেশি দ্রুত ম্যানুভার বা দিক পরিবর্তনে সক্ষম। এর পাল্লা কমবেশি ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার।
বিধ্বস্ত বিমানটিতে একাই ছিলেন ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট তৌকির। সূত্র জানায়, সলো ফ্লাইটে থাকা এই পাইলট বিমান চালানো শিখছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। এর আগে তিনি কে-৮। সেখান থেকে এফ-৭ এ ট্রানজিশন করছিলেন। সেই হিসাবে এটাকে ট্রেনিং ফ্লাইট বলা যেতে পারে, কিন্তু ট্রেনিং এয়ারক্রাফট নয়।
এসব কারণে এবারের দুর্ঘটনার পেছনে আগের দুটি দুর্ঘটনার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পদ্ধতিগত পরিবর্তন না আনাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আগের দুর্ঘটনায় দায়ী কারণ বা পদ্ধতিগুলোর সংশোধন করা গেলে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি এড়ানো যেতো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে