Views Bangladesh Logo

রুশ-মার্কিন পরমাণুযুদ্ধ এবং একজন ওপেনহাইমার

রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন- এ প্রবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে; কিন্তু হিরোসিমা-নাগাসাকিতে যখন নিউক্লিয়ার বোমার তাণ্ডবনৃত্য চলছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তখন বিজয়ে হাসি হাসছেন। সেটা এতটাই দৃষ্টিকটুভাবে যে, তাদের নিউক্লিয়ার বোমা প্রকল্পের প্রধান ওপেনহাইমারকে অপমান করতে এতটুকু বাঁধেনি তার। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ক্রিস্টোফার লোলান ওপেনহাইমারকে নিয়ে একটা ছবি বানিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। সিনেমার নামও ‘ওপেনহাইমার’। তাতে ওপেনহাইমারকে উপস্থাপন করা হয়েছে গ্রিক পুরাণের দেবতা প্রমিথিউসের সঙ্গে, যিনি দেবরাজ জিউসের নিষেধ অমান্য করে মানবজাতিকে আগুন জ্বালাতে শিখিয়েছিলেন। প্রমিথিউসের সঙ্গে ওপেনহাইমারের তুলনা কেন?


ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টর প্রধান। তিনিই মানবজাতিকে প্রথম পারমাণবিক বোমা উপহার দিয়েছেন একদল বিজ্ঞানী বন্ধুদের নিয়ে; কিন্তু জিউস কিংবা ঈশ্বর কেউই তো ওপেনহাইমারকে নিউক্লিয়ার বোমা বানাতে নিষেধ করেননি, তবু তিনি কেন প্রমিথিউসের খেতাব পেলেন? এর পেছনে রয়েছে এক গভীর-গোপন ভূরাজনৈতিক খেলা, যার অন্যতম কুশিলব তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্ট্যালিন ও একদল কমিউনিস্ট গুপ্তচর।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ছিল মিত্রবাহিনীর প্রধানতম শক্তি। সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালীও; কিন্তু হিরোসিমা-নাগাসাকিকাণ্ডে জার্মানি-জাপান-ইতালি বলয়ের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। তখনই সূচনা হয় নতুন এক যুদ্ধের। গণতন্ত্রের বুলি আউড়ানো যুক্তরাষ্ট্র আর সমাজতন্ত্রের তল্পিবাহক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় ঠান্ডা লড়াই। নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের লড়াই চলে। সেই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ নেয় জাপানের। অন্যদিকে এশিয়ার কিছু দেশেও সমাজতন্ত্রের বীজ ছড়িয়ে পড়ছে। জাপানের হাত থেকে সদ্য স্বাধীন উত্তর কোরিয়া ঢুকে পড়ে সমাজতন্ত্রের বলয়ে। এমনকি স্ট্যালিনের মদদে দক্ষিণ কোরিয়াকেও আক্রমণ করে বসে। লক্ষ্য ছিল দুই কোরিয়া একত্রিত করার। সেটা শেষমেশ হয়নি; কিন্তু গোটা বিশ্ব তখন দুই শিবিরে বিভক্ত। মার্কিনপন্থি দেশের সংখ্যা যদিও বেশি, তবুও সোভিয়েতের জ্বালানিতে মার্ক্সবাদী আন্দোলন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। চীনে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছেন মাও সেতুংয়ের চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। যুক্তরাষ্ট্রের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সেই ভাঁজ আরও বাড়িয়ে দেয় পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েতের দাদাগিরি। পশ্চিম জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের। খোদ বার্লিন শহরটাকেই দুভাগে ভাগ করে নিয়েছে দুই পরাশক্তি। সোভিয়েত সেনারা খাবার-রসদ নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে ঢুকতে দিচ্ছি না যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের। উত্তেজনা তখন তুঙ্গে।

২.
বিখ্যাত ইসরায়েলি লেখক ইউভ্যাল নোয়াহ হারিরি ‘স্যাপিয়েন্স’ নামের এক বই লিখে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছেন। মানব জাতির বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের যেমন সুলুক-সন্ধান করেছেন তেমনি বইয়ের ছত্রে ছত্রে জুড়ে দিয়েছেন নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক-সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর মানবসভ্যার উত্থান-পতন, হিংস্রতা, ভালোবাসা, আর্ট-কালচার- কোন বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেননি? মানুষের যে আজকের যুদ্ধবাজনীতি- এগুলো আসলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর নিজের জিনে বয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। তিনি বিবর্তনের আয়নায় মানুষের পরিবর্তনের দৃশ্যও দেখিয়েছেন। বিবর্তনবাদ বলে, পরিবেশ মানুষকে, প্রাণীকে নিজেদের আচরণ বদলাতে বাধ্য করে। হিংস্রতা, লড়াই এগুলো মানুষ যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে নিজেদের ভেতর, এগুলোই মানুষকে টিকিয়ে রেখেছে।


একসময় নিজে টিকে থাকতে মানুষ ভাতৃঘাতী হয়েছে- নিয়ান্ডারথাল, ইরেক্টাস, ডেনিসোভান, হোমো নালেদি, ফ্লোরিসিয়েন্সিস ও হাইডেলবার্গেনসিসদের মতো জ্ঞাতি ভাইদের রক্তে রঞ্জিত মানুষের হাত। তখন অবশ্য এর কারণও ছিল। সেই আদিম যুগে, ‘মারো অথবা মরো’ যখন টিকে থাকার মূলনীতি- তখন পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে, নিজেদের টিকিয়ে রাখতে স্যাপিয়েন্সরা ভাতৃঘাতী হয়েছিল। আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই অপরাধ তাই ক্ষমা করাই যাই; কিন্তু আজ, কেন আজ নিজের স্বজাতির হাতেই নিজেদের হাত রঞ্জিত হচ্ছে? বিবর্তনবাদের অন্যতম মূলমন্ত্র হচ্ছে- যেটা প্রয়োজন বা যে কাজ প্রাণীকে প্রতিনিয়ত করতে হয়, মানুষের সেই অভ্যাস, সেই আদিম প্রবৃত্তির কখনো বিলোপ ঘটে না। যুদ্ধ, হিংস্রতা, হত্যার প্রবণতার চর্চা মানুষ কখনো বন্ধ করেনি। তাই মানুষের ভেতর থেকে এই প্রবৃত্তির বিলোপ কখনোই ঘটেনি বিবর্তনীয় ধারার মাধ্যমে। তবে মানুষ দীর্ঘদিনের চেষ্টা, অধ্যবসায় মাধ্যমে নিজের ভেতর সুকুমারবৃত্তির উন্মেষ ঘটিয়েছে। তাই একদল উন্মাদ যখন যুদ্ধের দামামা বাজায়, আরেকদল তখন শান্তির কথা বলে, মানবতার কথা বলে। ফলে কিছুটা হলেও ভারসাম্য তৈরি হয়। তবু নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মোকাবেলা শান্তির বুলি আউড়ে করা সম্ভব নয়। তাই বিশ্ব এখন এই নীতি বিশ্বাসী- নিউক্লিয়ার বোমার হাত থেকে বাঁচতে নিজে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করো। তাই হিরোসিমা-নাগাসাকির ভয়াবহতা দেখে যদি রুশ নেতা স্ট্যালিন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির উদ্যোগ নেন, তাকে দোষ দেয়া যায় না। আজ যে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বড় পরিসরে যুদ্ধ হয় না, সেটা ওই নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ভারসাম্যের কারণে। ঠিক তেমনি ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইরান আক্রমণ করেও পিছিয়ে আসে কিংবা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু উত্তর কোরিয়াকে ঘাঁটাতে সাহস করে না মহাশক্তিধর মার্কিন শক্তি- সেও ওই নিউক্লিয়ার অস্ত্রের কারণে। তাই হারিরি ‘স্যাপিয়েন্স’ বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ওপেনহাইমারসহ নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রজেক্টে কাজ করেছিলেন যারা, সেইসব বিজ্ঞানীদের নোবেল দেয়া উচিত ছিল- পদার্থবিজ্ঞানে নয়, শান্তিতে। কারণ, তার মতে নিউক্লিয়ার অস্ত্রের ভয়েই এখনো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগেনি।


হারিরির এই কথার সঙ্গে আপনি একমত নাও হতে পারেন। বড় পরিসরে বিশ্বযুদ্ধ না বাঁধলেও, গোটা বিশ্বই এখন যুদ্ধংদেহী ভূমিকায় অবতীর্ণ। হারিরির নিজের দেশ ইসরায়েল গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে দশকের পর দশক ধরে। তবে একথা সত্যি, যদি ফিলিস্তিন, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়ার হাতে নিউক্লিয়ার বোমা থাকত তাহলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। তাই এক অর্থে হারিরির কথা ঠিক।

৩.
১৯৪৫ সালে গুঞ্জন ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিউক্লিয়ার বোমা বানাতে চলেছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী থেকে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সেটা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। কারণ পদার্থবিজ্ঞানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দৌড় তাদের জানা, যতটা পিছিয়ে তারা, এখনো অন্তত দশ বছর সময় লাগবে; কিন্তু ১৯৪৯ সালের একটা গোয়েন্দা বিমান নাটকীয় মোড় এনে দেয় পরিস্থিতিতে। সে বছর ২৯ আগস্ট জাপান থেকে আলাস্কায় যাচ্ছিল মার্কিন গোয়েন্দা বিমান বি-২৯। খুব কাছেই সাইবেরিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা বিমানটির তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রের সিগন্যাল বেজে ওঠে। বাতাসে ধরা পড়ে মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার সংকেত। কোথা থেকে আসছে?


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাইবেরিয়ার কামাৎশাকায় নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় হাত। ম্যানহাটনের বিজ্ঞানী লেসলি গ্রোভস এবং বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার বলেছিলেন ১৯৫৭ সালের আগে সোভিয়েতের পক্ষে নিক্লিয়ার বোমার মালিক হওয়া সম্ভব নয়! তাহলে ১৯৪৯ সালেই কোথায় পেল তারা বোমার ফর্মুলা?
যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরই নিউক্লিয়ার বোমা বানাতে লেগেছে তিন বছর!


অবস্থা আরও করুণ হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারে হিরোসিমায় যে বোমা ফাটিয়েছিল মার্কিন বাহিনী, তারই হুবহু কপি হলো কামাৎশাকায় ফাটানো বোমাটির নকশা। তদন্তে নামে এফবিআই। জানতে পারে এক অপ্রিয় সত্যি। তার দেশের বিজ্ঞানীরাই করেছে এ কাজ। তার মানে তাদের স্বপ্নের ম্যানহাটন প্রকল্পেই ঘাপটি মেরে ছিল রুশ গুপ্তচরের দল।
এফবিআই তদন্তে নামে; কিন্তু প্রমাণ কই?


অবশেষে কিছুটা কিছুটা আলোর রেখার সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৫০ সালে। বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউইয়র্ক থেকে মস্কোয় পাঠানো একটা সাংকেতিক চিঠির মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। সেই চিঠি থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিউক্লিয়ার বোমার নকশা চুরি করে পাঠানো হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। আর এ কাজ করেছেন ম্যানহাটন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত অন্যতম বিজ্ঞানী ক্লস ফুকস। এরপর ফুকস নিজেই লন্ডনের ওয়ার হাউজে গিয়ে স্বীকার করেন নকশা চুরি আর পাচারের কথা। ধরা দেন স্বেচ্ছায় এবং এও জানান, টাকার লোভে বা চাপে পড়ে তিনি এ কাজ করেননি। করেছেন কমিউনিজমকে ভালোবেসে। চিরকালই তিনি কমিউনিজমের প্রতি অনুরক্ত। তার জন্য চক্ষুশূল হয়েছিলেন হিটলারের। তাই বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানীর মতো তিনিও পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ফুকস আত্মসমর্পণের পর ম্যানহাট প্রজেক্টে কাজ করা অনেক বিজ্ঞানীর নাম চলে আসে গুপ্তচরবৃত্তির তালিকায়। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং নামটা হলো রবার্ট ওপেনহাইমার। যিনি ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রধান।

৪.
১৯৫০-এর শুরুর দিকের কথা। বিশ্বে তখন সমাজতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। যদিও বেশিরভাগ দেশই গণতন্ত্রের পক্ষে; কিন্তু চীন-রাশিয়ার মতো দুটো বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ যখন এক ছাদের তলায় সঙ্গে উত্তর কোরিয়া, চেকোস্লাভেকিয়া, পূর্ব জার্মানি- পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা ততদিনে মার্কসবাদের ছায়াতলে। যুক্তরাষ্ট্রের কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ। পারমাণবিক বোমা তৈরি করে যারা নিজেদের পৃথিবীর একক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল, তাদেরই নকশা চুরি করে সোভিয়েত এখন তাদের চোখ রাঙাচ্ছে! সুতরাং আরও বড় কিছু করতে হবে। ইউরেনিয়ামভিত্তিক নিউক্লিয়ার বোমার চেয়েও ভয়ানক এক অস্ত্রের কথা ততদিনে বিজ্ঞানীরা জেনে গিয়েছেন। হাইড্রোজেন বোমা। এটাও নিউক্লিয়ার বোমা; কিন্তু হিরোসিমা-নাগাসাকির বোমার চেয়ে অনেক অনেকগুণ শক্তিশালী। বোমা আর পাল্টা বোমা তৈরির সন্ধিক্ষণেই বিশ্ব দেখে অন্যরকম এক যুদ্ধ চলেছে দুই পরাশক্তির মধ্যে, যার নাম কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ। ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলেও সম্প্রতি সেই স্নায়ুযুদ্ধ বর্তমানে আবার চরমে উঠেছে। একপক্ষে বর্তমান রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া অন্যপক্ষে যুক্তরাষ্ট ও তাদের মিত্রশক্তি।

হিরোসিমার ভয়াবহতা ওপেনহাইমারকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। নতুন করে আরও ভয়াবহ বোমা তৈরির বিপক্ষে ছিলেন তিনি; কিন্তু তার দিকেও সন্দেহের তীর নিক্ষেপ হলো। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে সরব হলেন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের সিনেটর জোসেফ রেমন্ড ম্যাককার্থি। রিপাবলিকান দলের এই নেতা ঘোরতর কমিউনিস্টবিরোধী। তিনি রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন কমিউনিস্টদের বিপক্ষে। সরকারি বিভিন্ন পদে বসে থাকা কমিউনিস্টদের বরখাস্ত করার জন্য আওয়াজ তোলেন। সরকারি গোয়েন্দা এফবিআইয়ের প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন জন অ্যাডগার হুভার। তিনিও কমিউনিস্টবিরোধী এবং মনে করেন প্রশাসনকে কমিউনিস্ট মুক্ত করা দরকার। তিনি নিজেই নামেন তদন্তে। খড়গটা পড়ে ইহুদি বিজ্ঞানীদের ওপরই। কারণ তখনকার ইহুদিদের একটা বড় অংশ কমিউনিস্ট সমর্থক।


হুভার খোদ আলবার্ট আইনস্টাইনের বিরুদ্ধেও তদন্তে নামেন, তৈরি করেন একটা খসড়া প্রতিবেদনও। অথচ আইনস্টাইন প্রথমত কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না; কিন্তু ইহুদি পরিবারে জন্ম বলেই কিনা তার বিরুদ্ধে এই তদন্ত তদন্ত খেলা?


ম্যাকার্থি-হুভারদের ইহুদি ও কমিউনিস্টবিদ্বেষী মনোভাব জনগণের ভেতরেও আন্দোলিত হয়। তারই প্রভাবে ১৯৫২ সালের নির্বাচন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা ডেমোক্রেটদের হারিয়ে সেবার যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসেন রিপাবলিকান নেতা ডেভিড আইসেনহাওয়ার। ফলে মাক্যার্থি-হুভার জুটির হাত আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসের ‘জয়েন্ট কমিটি অন অ্যাটমিক এনার্জি’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর উইলিয়াম লিসকাম বোর্ডেন আগুনে ঘৃতাহুতি দেন। চিঠি লেখেন হুভারকে। বলেন, সম্ভবত ওপেনহাইমার একজন সোভিয়েত গুপ্তচর। ব্যস আর যাবে কোথায়! একে তো লোকটা হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, তারওপর তার অতীত ইতিহাস। কমিউনিস্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তার খুব দহরম মহরম ছিল এক সময়। এখনো অনেক কমিউনিস্ট বন্ধু আছে তার, তারওপর ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও ইহুদি পরিবারে জন্ম। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।


সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির কোনো প্রমাণ এফবিআই পায়নি। তবে কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে ওপেনহাইমারকে ফাঁসানো হয়। মঞ্চস্থ করা হয় এক প্রহসনের বিচার। লতায়-পাতায় তার সঙ্গে কমিউনিস্ট সম্পর্কের তথ্য জোগাড় করা হয়। এমনকি বিচারকের প্যানেলে যারা বসেছিলেন তারাও ওপেনহাইমারকে শাস্তি দিতেই ব্যাকুল ছিলেন। তার এক সময়ের সহকর্মী বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলরের মিথ্যা সাক্ষী তাকে বেশি করে ফাঁসিয়ে দেয়। টেলরের সঙ্গে ওপেনহাইমারের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল, সুযোগ বুঝে তিনি ওপেনহাইমারকে বেকায়দায় ফেলেন। আর নিজে বনে যান হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পের প্রধান।


অন্যদিকে হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্প বিশ্বশান্তিকে আরও তলানির দিকে নিয়ে যায়, চরমে ওঠে রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধ। তবে নিউক্লিয়ার ভারসাম্য সেই চরমে ওঠা দ্বন্দ্বকে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে দেয়নি, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই নোয়াহা হারারি ওপেনহাইমার ও তার সহকর্মীদের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত ছিল বলে যে মন্তব্য করেছিলেন তাকে অত্যুক্তি বলা চলে না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ