Views Bangladesh Logo

প্রথম পর্ব

জাসদের সৃষ্টিতে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে

লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। একাধারে তিনি ইতিহাসবেত্তা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন ও গবেষণা করেছেন তাদের অন্যতম তিনি। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক লেখক যিনি ১৯৭৩-এর নির্বাচন নিয়ে লিখেছেন ‘তিয়াত্তরের নির্বাচন’ নামে একটি বই। লিখেছেন ‘লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’, ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি কোন পথে’, ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ ইত্যাদি গ্রন্থ। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে এখনো লিখে চলছেন।

সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশ-এর ‘এডিটরিয়াল ডায়ালগ উইথ রাশেদ মেহেদী’ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে স্বাধীনতাযুদ্ধ-পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আলোকপাত করেছেন দেশের রাজনীতির উত্থান-পতন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশ-এর সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। চার পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব:

রাশেদ মেহেদী: স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতির প্রেক্ষাপট কীভাবে আবর্তিত হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতিতে কতটা প্রভাব রেখেছে কিংবা সত্যিকারার্থে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে কি?

মহিউদ্দিন আহমদ: অনেকগুলো প্রশ্ন, শেষ প্রশ্নের উত্তর খুবই ডিফিকাল্ট। একাত্তরের আগে এবং একাত্তরের পরে একই তো জনগোষ্ঠী। একাত্তরের আগে যে রাজনৈতিক দলগুলো ছিল সেই দলগুলোর মধ্যে অনেকগুলোকে একাত্তরের পরেও আমরা পেয়েছি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি। আর কিছু দল আড়ালে চলে গেছে, যাদের আমরা দেখেছি একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ছিল। সেখানে ৫টা দল (মুসলিম লীগ ছিল দুটি, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, পিডিবি)। এরা তখন ব্রাত্য। মাঠে থাকলো পুরোনো দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, মুজাফফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ আর সিপিবি কমিউনিস্ট পার্টি। তো দেশ নতুন কিন্তু এ দলগুলো পুরোনো। ফলে রাজনীতিতে আমরা যেটা দেখলাম, দলের নাম পরিবর্তন হলো পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ হলো। আওয়ামী লীগ দলের নাম পরিবর্তন করেছে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে শিলিগুড়ি কনফারেন্সে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রেখেছে। বাকিগুলো একইরকম; কিন্তু লোকগুলো আগেরই। এতে আমরা যেটা দেখলাম, দলের নামের অংশ বা সাইনবোর্ড পাল্টালেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেটা আমরা বলি, সেটা একাত্তর-পরবর্তীতে খুব একটা পাল্টায়নি।

সুতরাং রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা এবং তার কার্যক্রম চালু রাখা, কর্মসূচি পালন করা- এটার যে একটা প্যাটার্ন আমরা আগে দেখেছি যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্মলগ্ন থেকে কিছু লোক সংক্ষুব্ধ হয়ে বা বিশেষ একটা লক্ষ্য সামনে নিয়ে সমবেত হয়ে একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে। মুসলিম লীগের জন্ম এভাবেই। এক লোক করেনি, অনেকে মিলে করেছে। আওয়ামী লীগও তাই। এভাবে হয় আর কি; কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখলাম, আসলে প্রত্যেকটা দলের একটা নেতৃত্ব থাকে, নেতৃত্বটা এক সময় একটা সিন্ডিকেটে রূপ নেয়। এটা পাকিস্তান আমলে যতটা না ভয়াবহ ছিল, বাংলাদেশ হওয়ার পর এটা খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একাত্তরের আগে আমরা এই সিন্ডিকেটটা যেখানে-সেখানে একেবারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি, ব্যক্তিকে কার্ড হিসেবে তুলে ধরা এটা আইয়ুব খানের আমলে শুরু হয়। সবকিছু আইয়ুব খান, আইয়ুব খানের দল, মানে একটা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। আইয়ুব খানের পতন হলো তার দলও শেষ।

ঠিক বাংলাদেশ হওয়ার পরও দেখলাম, ব্যক্তির কার্ড বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এটার চর্চা। শেখ মুজিবুর রহমান ঈশ্বরতুল্য হয়ে গেলেন। এখানে পাকিস্তান আমলে জিন্নাহর কার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সবাই বলতে কায়েদে আজম। কায়েদে আজম নামের পার্ট হয়ে গিয়েছিল। এটা ১৯৭০ সালেও চলেছে। ১৯৭২ সালে এসে আমরা কায়েদে আজমকে রিপ্লেস করলাম বঙ্গবন্ধু দিয়ে; কিন্তু কার্ড ওরশিপটা বন্ধ হলো না, চলতেই থাকল। এতে যেটা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভিয়াসলি (সুস্পষ্টরূপে) শুরু থেকে আমরা দুটি প্রবণতা দেখলাম। একটা হচ্ছে, ব্যক্তিপূজা আরেকটা রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদ। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে আমরা এটা দেখি যে আস্তে আস্তে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে যাওয়া। প্রথম রেজিমটা যদি আমরা চিন্তা করি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আওয়ামী লীগের। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আছে তিন-চারজন, বাকিরা স্বতন্ত্র। (জাসদের তিনজন, ভাসানী ন্যাপের একজন সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন, স্বতন্ত্র ছিলেন ওয়ালী আশরাফ, পার্তব্য চট্টগ্রামের দুজন- মানবেন্দ্র লালমা আর চাই থোয়াই রোয়াজা)।

তো ন্যূনতম প্রতিবাদ, ভিন্নমত, সমালোচনা গ্রহণ করার মতো মানসিকতা ছিল না। এদের সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা মানসিকতা কোনোটাই কিন্তু আওয়ামী লীগের ছিল না। এতে ২৯৩ কেন ৩০০ হতে হবে এই যে মানসিকতা, এখান থেকে একদল হলো বাকশাল। আপনি দেখবেন, বাকশালের পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন যে এটাতো দল ছিল না, জাতীয়ভিত্তিক একটা প্ল্যাটফর্ম ছিল যেখানে সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছে আসার জন্য- এ কথাটা ঠিক না।

কারণ একই সঙ্গে বলা হয়েছে, যারা বাকশালে যোগ দিবে না তাদের সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। মানে একটা বাধ্যবাধকতা ছিল, জোর জবরদস্তি ছিল। এতে যেটা হয়েছে- জাসদের আবদুল্লাহ সরকার এবং মাইনুদ্দিন মানিক বাকশালে যোগ দেননি এতে তাদের সদস্যপদ বাতিল হয়ে গেল। এর আগে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে এম এ জি ওসমানী এবং মইনুল হোসেন তাদের আর ওটার দরকার হয়নি। কারণ তারা সংসদীয় দলের বৈঠকেই এটার প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেছিল- এই হচ্ছে অবস্থা।

রাশেদ মেহেদী: এখানে একটা বিষয়- যেহেতু আপনি জাসদের উত্থান-পতন নিয়ে লিখেছেন। ১৯৭২ সালের একুশে জুলাই যখন ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ সম্মেলন ডাকল, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটা অংশে চলে গেলেন। একটাতে তার ভাগ্নে, পরিবারের লোকজন ছিল আরেকটাতে আসম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনুরা ছিলেন যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন; কিন্তু দেখা গেল, সেখানে তিনি গেলেন না, গেলেন যেখানে আত্মীয়রা আছে। এতে জাসদের সৃষ্টি। তো স্বাধীনতা-পরবর্তীতে বিভক্তির রাজনীতি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের শক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের বিভক্তির সৃষ্টি সেখান থেকে শুরু হলো?

মহিউদ্দিন আহমদ: আমি একাধিক জায়গায় বলেছি। আবারও বলছি, একাত্তর-পরবর্তী পলিটিক্যাল ট্র্যাজেডি যদি আমরা বলি ১৯৭১-৭৫ এ সময়ের মধ্যে প্রধান ট্র্যাজেডি হচ্ছে দুটি। একটা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি যেটা মুক্তিযোদ্ধাদের দল হিসেবে জাসদের আলাদা দল তৈরি করা। এদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং শেখ মুজিব সবারই নেতা ছিলেন। আরেকটা ট্র্যাজেডি হলো অত্যন্ত অবমাননাকর অবস্থায় রাজনীতির মানচিত্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদের বিদায়। এই দুটি ট্র্যাজেডির ভার আলটিমেটলি সামাল দিতে পারেননি। এটার চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

তো ১৯৭২-এর ২১ জুলাই ছাত্রলীগের মধ্যে এক ধরনের পোলারাইজেশন হয়েছিল, সেখানে নেতৃত্বের দ্বন্ধ ছিল, আদর্শের ব্যাপারও ছিল। সব মিলিয়ে এটা হয়েছে। এখন ধরুন, শেখ মুজিবুর রহমান সবার নেতা। তাকে বলা হয় বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। যিনি এ ধারার রাজনীতির প্রধান। একটা ঘরে যদি কর্তা থাকেন আর তার দুই ছেলে যদি ঝগড়া করে তাহলে ওই পিতা দুজনের মধ্যে মিটমাট করে দেবেন অথবা বলবেন, আমি তোমাদের কারও সঙ্গে নেই; কিন্তু তিনি যখন এক সন্তানের বিরুদ্ধে আরেক সন্তানের পক্ষে যান, এই পক্ষপাত কোনো সন্তান পিতার কাছে প্রত্যাশা করে না। শেখ মুজিব ওই কাজটা করলেন। তিনি ডেকে সমাধান করে দিতে পারতেন। ধমক দিয়ে বলতে পারতেন। অথবা দু-গ্রুপ থেকে লোক নিয়ে একটা কমিটি করে দিতে পারতেন। কারণ ছাত্রলীগের আগের কমিটি কিন্তু শেখ মুজিবের এন্ড্রসমেন্ট ছাড়া হয়নি। (প্রায় ১৯৫৮ সাল থেকে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট/সেক্রেটারি কে হবে এটা কিন্তু নির্ধারণ করে দিতেন শেখ মুজিবুর রহমান)। তিনি এটা করতে পারতেন; কিন্তু করেননি। করেননি কেন? আমার ধারণা তিনি চেয়েছেন এই বিভক্তিটা হয়ে যাক। কেন চাইলেন? তিনি হয়তো চাইলেন যে আপদ বিদায় হোক। মানে এদের আমি রাখব না- এমন কিছু।

আরেকটা তথ্য আছে, এটা ইদানিং আমার কাছে খুব লজিক্যাল মনে হয়। সেটা হলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগকে ইডিওলজিক্যাললি চ্যালেঞ্জ করতে পারত কারা? একটা হচ্ছে ইসলামিস্ট ফোর্স আরেকটা হচ্ছে পিকিংপন্থি কমিউনিস্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা বিতর্কিত- এটা আমরা জানি। তারা অনেকে স্বাধীনতা চায়নি। ইসলামিস্টরা তো চায়ইনি। পিকিংপন্থি কমিউনিস্টদের বড় একটি অংশের ভূমিকা তারা চীনের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নাচানাচি করেছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গেছে। এদের মধ্যে অনেকে আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছে। আবার অনেকে এটাকে দুই কুকুরের লড়াইও বলেছে। তো শেখ মুজিব হয়তো ভেবেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা দল যদি হয় এবং সিরাজুল আলম খান যখন শেখ মুজিবকে জানালেন যে আমি তো নতুন দল করছি তখন তিনি বললেন, এটা তো খুব ভালো। আমাকে সরিয়ে কেউ যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তবুও আমি শান্তি পাব যে মুক্তিযোদ্ধারাই গেছে। রাজাকাররা তো আর যায়নি। এটা একটা ব্যাপার। এখানে অনেক কিছু তো আমরা জানি না। আমরা বলতে পারব না, কারণ তারা তো কেউ কিছু লিখে যাননি। সুতরাং তাদের নিয়ে আমরা অনেক কথা বলতে পারি।

এই জাসদ সৃষ্টির পেছনে শেখ মুজিবেরও কিছুটা অবদান আছে, কারণ তিনি চাইলে একটা রিকনসিলিয়েশন (পুনর্মিলনী) করতে পারতেন। যে কোনো কারণেই হোক সেটা তিনি করেননি বা তিনি চাননি। সেটার মূল্য কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানও দিয়েছেন, জাসদও দিয়েছে। পঁচাত্তরের পর আমরা দেখলাম যে, আওয়ামী লীগ একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গেল। যেহেতু এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল হয়ে গিয়েছিল। সর্বময় ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে। যেহেতু শেখ মুজিব বিরোধিতাই ছিল জাসদের মূল মন্ত্র, তো দৃশ্যপটে যেহেতু শেখ মুজিব নেই তখন জাসদ কিন্তু অনেক অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। আমি বলি, ১৯৭৫-এ জাসদ একেবারেই কোমায় চলে গেছে। আর ৭ নভেম্বরের পর মারা গেছে। এরপর যেটা হচ্ছে, জাসদের কঙ্কালটা তারা টেনে বেড়াচ্ছে।
(চলবে)

শ্রুতিলিখন: শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ