Views Bangladesh Logo

জীবিকার নৈতিক ভূগোল

Md. Kafi  Khan

মো. কাফি খান

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিদিনের দৃশ্যপটে অসংখ্য মানুষ তাদের শ্রম, সততা এবং নৈতিকতার মাধ্যমে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখছেন। কেউ শহরের ভোরবেলায় দোকানের শাটার তোলে, কেউ মফস্বলের রাস্তায় ঠেলাগাড়ি চালায়, কেউ আবার বিদেশের প্রবাসে ঘাম ঝরায় সবাই একই সুতায় বাঁধা, জীবিকার জন্য সংগ্রামী মানুষ।

কিন্তু এই জীবিকার সংগ্রামে নৈতিকতার স্থান কোথায়? আমরা কি শ্রমের মর্যাদা, সততার মূল্য এবং মানবিক পরিশ্রমের অন্তর্নিহিত মানকে উন্নয়নের মাপকাঠিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি? এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় “জীবিকার নৈতিক ভূগোল” একটি দার্শনিক ও সামাজিক অনুসন্ধান, যেখানে অর্থনীতি ও নৈতিকতা একে অপরের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে।

একজন তরুণ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মেধাবী, স্বপ্নবাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার আশায়। সেখানে গিয়ে দেখলেন, উচ্চশিক্ষার পথ জটিল, ব্যয়বহুল এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ। একসময় তিনি জীবিকার প্রয়োজনে একটি মুদি দোকান খুললেন। আজ তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী দোকানদার পরিশ্রমী, সৎ এবং সম্মানিত।

অন্যদিকে, একই প্রজন্মের আরেক তরুণ, যিনি দেশে থেকেই নিজের এলাকার বাজারে একটি দোকান খুলেছেন। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করেন। তিনি মানুষের প্রয়োজন মেটান, সমাজের চাকচিক্যহীন; কিন্তু অপরিহার্য অংশ। তার দোকানই আশপাশের অনেক মানুষের যোগাযোগ, আস্থা ও সৌজন্যের কেন্দ্র।

দুই তরুণের পথ ভিন্ন, গন্তব্য আলাদা; কিন্তু আত্মা এক জীবিকার নৈতিকতা। তবুও আমাদের সমাজে বিদেশে দোকান চালানো ব্যক্তিকে আমরা “সফল প্রবাসী” বলে অভিহিত করি, আর দেশে থাকা দোকানদারকে বলি “ছোট ব্যবসায়ী” বা “মফস্বলের মানুষ”।

এই পার্থক্যই আমাদের চিন্তার অসুখ। আমরা পেশার মর্যাদা নয়, অবস্থানের পরিমাপ করি। অথচ উভয়েই মানুষকে সেবা দিচ্ছেন, পরিশ্রম করছেন, জীবনের ঘামকে আয়ের রূপ দিচ্ছেন। এই দুইজনের মধ্যে যে নৈতিক সাদৃশ্য আছে সেটিই অর্থনীতির প্রকৃত মানচিত্র “জীবিকার নৈতিক ভূগোল।”

জীবিকার মানচিত্রে নৈতিকতার স্থান
আমাদের দেশের উন্নয়নচিন্তা এখনো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা, বিনিয়োগ ইত্যাদি; কিন্তু এই সংখ্যাগুলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোটি মানুষের নৈতিক শ্রম। তারা কেউ কারখানার মেঝেতে কাজ করে, কেউ অফিসের হিসাব রাখে, কেউ রিকশা চালায় সবাই অর্থনীতির অচেনা নায়ক।

তবুও তাদের পরিশ্রমকে আমরা অর্থনীতির “উপাদান” হিসেবে দেখি, “মূল্য” হিসেবে নয়। অথচ নৈতিক অর্থনীতি আমাদের শেখায় উৎপাদনের সঙ্গে নৈতিকতা জড়িত না থাকলে উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না।

একজন সৎ দোকানদার, যিনি ওজনের প্রতারণা করেন না তার ব্যবসা হয়তো ছোট; কিন্তু তার নৈতিক অবদান বিশাল। একজন কৃষক, যিনি মাটির প্রতি সততা বজায় রাখেন, মুনাফার লোভে বিষ ঢালেন না তিনি কেবল উৎপাদক নন, সমাজের রক্ষক। একজন প্রবাসী শ্রমিক, যিনি কষ্টের টাকা পাঠান বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে তিনি কেবল অর্থ প্রেরণ করেন না, প্রেরণ করেন ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার প্রতীক। এই প্রতিটি মানুষই নৈতিক অর্থনীতির স্তম্ভ, যাদের মূল্যবোধে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জাতির অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র।

সমাজ ও নৈতিক আস্থা
একটি সমাজ তখনই স্থিতিশীল হয়, যখন অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ায়। দোকানদার ক্রেতাকে ঠকায় না, ক্রেতা দোকানদারকে ফাঁকি দেয় না এই আস্থাই অর্থনীতির অক্সিজেন।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাটবাজার, এমনকি গ্রামীণ অর্থনীতিও এই বিশ্বাসভিত্তিক নৈতিকতায় টিকে আছে। ব্যাংকিং সেক্টরে যেমন “বিশ্বাস” হলো ক্রেডিটের প্রাণ, তেমনি সমাজের ক্ষুদ্র অর্থনীতিতেও “বিশ্বাস”ই হলো বিনিময়ের প্রাণশক্তি। কিন্তু আধুনিক ভোক্তাবাদী সমাজে এই বিশ্বাসের জায়গায় প্রবেশ করছে সন্দেহ, প্রতারণা ও লোভ। আমরা দ্রুত মুনাফার আশায় নৈতিকতার শিকড় কেটে ফেলছি। অথচ এই নৈতিক শক্তিই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ “হালাল রুজি”, “সৎ পরিশ্রম”, “ন্যায়ের ব্যবসা” এগুলো কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক দায়িত্বও।

প্রবাসী জীবিকা ও দেশীয় জীবিকার সংযোগ
বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে প্রবাসী আয়ের ওপর। বিদেশে থাকা শ্রমজীবী মানুষ দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছেন তা অমূল্য; কিন্তু সেই আয়ের পেছনে যে কষ্ট, ত্যাগ ও বিচ্ছেদের বেদনা রয়েছে তা আমাদের অর্থনীতির পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয় না।

দেশে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও সমানভাবে অবদান রাখছেন। তাদের উদ্যোগ স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি করছে, সমাজে আস্থা ও আত্মনির্ভরতা গড়ে তুলছে। তাই উন্নয়নের পরিমাপে প্রবাসী আয় ও স্থানীয় শ্রম দুটিকেই সমান মর্যাদায় দেখা প্রয়োজন।

নৈতিক উন্নয়নের নতুন ধারণা
অর্থনীতি কেবল সংখ্যার খেলা নয় এটি মানুষের সম্পর্ক, বিশ্বাস, সততা ও আত্মসম্মানের এক জীবন্ত জাল। যেখানে লেনদেন শুধু অর্থের নয়, নৈতিক দায়বদ্ধতারও প্রতীক। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন দর্শনে প্রয়োজন “নৈতিক অর্থনীতি” ও “জীবিকার নৈতিক ভূগোল”-এর ধারণা প্রতিষ্ঠা করা। এটি হবে এমন এক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে,
* শ্রমের মর্যাদা থাকবে কেন্দ্রে,
* নৈতিকতার মূল্য থাকবে মুনাফার উপরে,
* সমাজের আস্থা থাকবে অর্থনীতির ভিত্তিতে,
* এবং প্রতিটি জীবিকা হবে সম্মানের প্রতীক।


নীতিগত অন্তর্দৃষ্টি

বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি তখনই স্থায়ী হবে, যখন আমরা উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে নৈতিকতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব। অর্থনীতি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি এক মানবিক সংগীত যেখানে শ্রম, সততা, আস্থা ও দায়বদ্ধতা মিলেমিশে গঠন করে জাতির আত্মা। আমেরিকার মুদি দোকান কিংবা বাংলাদেশের হাটের দোকান দুটোই জীবিকার প্রতীক।
তবে বাংলাদেশের দোকানদারের ঘাম, তার পরিশ্রম, তার ন্যায়পরায়ণতা এই গুণগুলোই আমাদের প্রকৃত সম্পদ।

এই নৈতিক শক্তিকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে এমন এক নতুন উন্নয়ন-দর্শন, যেখানে অর্থনীতি শুধু বড় নয়, মহৎ হবে আর জীবিকা হবে শুধু বেঁচে থাকার উপায় নয়, একটি সৎ ও সম্মানজনক জীবনের অনন্ত পথচলা। “জাতি মূলধনে নয়, ন্যায়ে বড় হয় যখন সততা প্রতিষ্ঠান হয়, শ্রম ইবাদত হয়, আর প্রতিটি জীবিকা নৈতিক আশার ভূগোলে পরিণত হয়।”

মো. কাফি খান: কলামিস্ট ও কোম্পানি সচিব, সিটি ব্যাংক পিএলসি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ