ভবিষ্যৎ কখনো আসে না, সবসময় আসার অপেক্ষায় থাকে
প্রতি বছরের মতো এবারও নোবেল সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা ছিল। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে নাম ছিল হাঙ্গেরীয় গল্পকার ও উপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের। চিত্রনাট্যকার হিসেবেও তিনি বিখ্যাত। ১৯৫৪ সালে জন্ম নেয়া এ সাহিত্যিক ২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেন। এবার ৭১ বছর বয়সে অর্জন করলেন নোবেল পুরস্কার-২০২৫। তার উপন্যাসকে বলা যায় ডিস্টোপীয় ঘরনার। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মেলানকোলি অফ রেজিস্ট্যান্স’। উপন্যাসটি নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক বেলা তার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সুইডেনের স্টকহোমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে নোবেল কমিটি ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রশংসা করে বলেন, ‘যখন অন্তিম প্রলয়ের ভয়ে পৃথিবী আচ্ছন্ন, তখন শিল্পের শক্তি নিয়ে তিনি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তার এই গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সৃষ্টিকর্মের জন্যই তাকে এবার নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।’
ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার। দি ইয়েল রিভিউর জন্য সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক, হ্যারি কুঞ্জরু। সাক্ষাৎকারটি বাংলায় তরজমা করেছেন কামরুল আহসান।
হ্যারি কুঞ্জরু: আপনার গল্প, ‘আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল এক দেবদূত’ ইউক্রেনের পটভূমিতে লেখা। আপনি একজন ইউরোপীয় নাগরিক, একজন হাঙ্গেরীয় এবং দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন। এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন যুদ্ধ আপনি কীভাবে দেখছেন এবং এই সংঘাত সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে আগ্রহী আমরা।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: কী ভাবি! মনে হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে! ভয় আর আতঙ্কে আমি দিশেহারা। হাঙ্গেরি ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ। আর ওরবান শাসনামল এক অভূতপূর্ব অবস্থান নিয়েছে। হাঙ্গেরির ইতিহাসে এটা প্রায় তুলনাহীন এক অবস্থান নিয়েছে। এর আংশিক কারণ, এখন পর্যন্ত, আমরাই সবসময় আক্রমণের শিকার হয়েছি এবং হেরে গেছি। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে হাঙ্গেরির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই বিষয়ে তথাকথিত নিরপেক্ষতার কথা বলবে!
যখন রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করছে তার পার্শ্ববর্তী দেশ কীভাবে নিরপেক্ষ থাকবে? তিন বছর ধরে তারা ইউক্রেনীয়দের হত্যা করছে। হাঙ্গেরীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এটা একটা অভ্যন্তরীণ বিষয়’- এ দ্বারা তিনি কী বোঝাতে চাইছেন? এর মানে কী? যখন সমানে মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন সেটাকে কীভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা যায়? অথচ এটা বলছেন এমন এক দেশের নেতা- যে দেশ নিজেই ইতিহাসজুড়ে বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। অন্যদের মধ্যে রাশিয়ার দ্বারাও। আর এই রাশিয়ানরাই সেই একই রাশিয়ান।
হাঙ্গেরীয় শাসনব্যবস্থা যেন এক মানসিক রোগীর মতো। এর পেছনের হিসাবটা এতটাই অমানবিক যে শুনলে চমকে উঠবেন, ‘তারা আমার মেয়েকে হত্যা করেছে; কিন্তু আমি সেটা মেনে নেব যদি এতে তারা আমার মাকে ক্ষতি না করে।’ কী ভয়াবহ! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এরকম: তারা দুজনকেই মেরে ফেলবে। এটা বোঝা কি এতই কঠিন?
হ্যারি কুঞ্জরু: ‘এন অ্যাঞ্জেল পাসড এভব আস’ গল্পে আমরা দেখি দুজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ এক গর্তে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আরেকজনকে এক ধরনের রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে, গ্লোবালাইজেশনের বিস্ময় নিয়ে। এই রূপকথার গল্প আর ওই দুই মৃত্যুপথযাত্রীর বাস্তবতার মধ্যে যে তীব্র বৈপরীত্য তা চোখে পড়ার মতো। মনে হয়, এটি যেন সেই প্রযুক্তিনির্ভর আশাবাদের সুরটিকে ভেঙে দেয় যা ক্রমবর্ধমান আধুনিক পৃথিবীকে ঘিরে আছে। আপনি কি একটু বিস্তারিতভাবে বলতে পারেন- এই দুটি বিপরীত উপাদানকে পাশাপাশি রাখার পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমার চোখের সামনে ঘটছে এক নোংরা, পচা যুদ্ধ। আর পৃথিবী ধীরে ধীরে এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে; কিন্তু আমি অভ্যস্ত হতে পারছি না। মানুষ মানুষকে হত্যা করছে- আমি এই সত্যটা মেনে নিতে পারছি না। হয়তো আমিও এক ধরনের মানসিক রোগী।
সবকিছু ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন ডিজিটাল জগতে ভবিষ্যতের এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারিত হচ্ছে, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি খুব শিগগিরই আমাদের জন্য এক সুন্দর নতুন পৃথিবী বয়ে আনবে। এটা সম্পূর্ণ পাগলামি। যখন একেবারে বিংশ শতাব্দীর ধাঁচের যুদ্ধ চলছে তখন কেউ কেউ বলছে, আমরা শিগগিরই মঙ্গল গ্রহে চলে যাব। আমি আশা করি, পুতিন ও তার সমর্থকরাই হবে সেই প্রথম যাত্রীরা।
হ্যারি কুঞ্জরু: আপনার গল্পকার জোর দিয়ে বলেন যে ‘তিনি ভবিষ্যতের বিশ্লেষক ছিলেন না বরং ট্রেন্ড, তথ্য, তথ্যের বিশ্লেষক ছিলেন। তিনি একদিকে যেমন ‘মহাজাগতিক’ বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন পাশাপাশি ‘মনস্তাত্ত্বিক স্তর’ নিয়েও। মানুষ কীভাবে অপর ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজ, সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা তা নিয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন। ভবিষ্যৎ সত্যিই জানা যায় কি না এবং তা যদি জানা যায়ও, সেটা কি কেবল তথ্য-বিশ্লেষণে সম্ভব, নাকি তার বাইরে কোনো আধ্যাত্মিক স্তরে সম্ভব?’
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: এটা বেশ অস্বস্তিকর এক প্রশ্ন। কারণ, এই লেখাটিতে ঘটনাগুলো কোনো সাধারণ প্রেক্ষাপটে ঘটছে না; বরং এক আহত মানুষ আরেকজন মারাত্মকভাবে আহত মানুষকে জীবিত রাখার চেষ্টা করছে। তার মধ্যে আশা জাগিয়ে রেখে, এমন এক সুন্দর নতুন পৃথিবীর গল্প শুনিয়ে যেখানে সবকিছু বদলে যাবে, সবকিছু চমৎকার হবে।
একটি মৌলিক মানবিক প্রবৃত্তি তাকে প্ররোচিত করছে অন্যজনকে সান্ত্বনা দিতে। তাদের আর কোনো আশার অবলম্বন নেই। আর যে মানুষটি ভবিষ্যতের সেই ডিজিটাল জগতের গল্প বলছে, সেও জানে যে সে আসলে সময় নষ্ট করছে। এই আশায় যে তাদের সঙ্গীরা হয়তো ফিরে আসবে। যদিও সে জানে, আরেকজনও জানে, তাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা অসম্ভব। এই বক্তৃতার কোনো আধ্যাত্মিক বা অধিবিদ্যাগত মাত্রা নেই; বরং এটি গভীরভাবে বাস্তবধর্মী। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখার এক ব্যর্থ আশার গল্প মাত্র।
হ্যারি কুঞ্জরু: গল্পের যে প্রেক্ষাপট, একটি নৃশংস ট্রেঞ্চ যুদ্ধের সামনের সারি, আপনার লেখায় কোনোভাবে যেন পরিচিত। আমি জানি, সুসান সনটাগ আপনাকে ‘প্রলয়ের গুরু’ বলে যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা এখনো আপনার সঙ্গে যুক্ত; কিন্তু যদি আপনার লেখাকে “প্রলয়ের অভিজ্ঞতা” নিয়ে লেখা বলা যায়, তবে তা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ধীরে, ক্ষয়ে, পেষণে ঘটতে থাকা এক প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। এই অবস্থায় ভবিষ্যতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? এটা কি আমাদের অন্তিম সময়? নাকি আমরা ইতোমধ্যেই কোনো এক প্রলয়-পরবর্তী যুগে বাস করছি?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: প্রলয় কোনো একক ঘটনা নয়। যেমনটা নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত শেষ বিচারের ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে। প্রলয় আসলে এক চলমান প্রক্রিয়া, যা অনেক দিন ধরে চলছে এবং আরও অনেক দিন চলবে। প্রলয় এখনই ঘটছে। প্রলয় হলো এক অবিরাম বিচারপ্রক্রিয়া। ভবিষ্যতের ভ্রান্তিতে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিই। কারণ আশা সবসময় ভবিষ্যতের সঙ্গেই যুক্ত; কিন্তু ভবিষ্যৎ কখনো আসে না। সেটা সবসময় আসার অপেক্ষায় থাকে। কেবল বর্তমানই বাস্তব।
আমরা অতীত সম্পর্কে কিছুই জানি না। যে-অতীত নিয়ে আমরা ভাবি তা এক গল্পমাত্র। বাস্তবে বর্তমানও এক গল্প। যার ভেতরে রয়েছে অতীতের গল্প এবং এমন এক ভবিষ্যতের গল্প যা কখনোই আসবে না। তবু অন্তত বর্তমানকে আমরা অনুভব করি, বাঁচি- এবং কেবল সেটাই বাস্তব।
স্বর্গ আর নরক দুটোই পৃথিবীতেই আছে এবং সেগুলো এখনই এখানে বিদ্যমান। আমাদের তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। অথচ আমরা অপেক্ষা করি, নিজেদের সান্ত্বনা দিই ভঙ্গুর এক আশার ছলনায়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে