একুশ শতকের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকার ১০০তম চলচ্চিত্র
সম্প্রতি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ২১ শতকের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকা প্রকাশ করেছে। এই নির্বাচনে যুক্ত ছিলেন অস্কারজয়ী পরিচালক পেদ্রো আলমোডোভার, সোফিয়া কপোলা, ব্যারি জেনকিন্স, গিলারমো দেল তোরো এবং অভিনেতা জুলিয়ান মুর, জন টার্টুরোসহ আরও অনেকে। স্ট্রিমিং সার্ভিস এবং সুপারহিরো ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর কারণে গত ২৫ বছরে সিনেমা দেখার এবং সিনেমা নিয়ে চিন্তার ধরন আমূল বদলে গেছে। আশা করা হচ্ছে এই তালিকার সিনেমাগুলো সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকবে। এই সিরিজে আমরা সেই তালিকার সিনেমাগুলো নিয়ে জানব- কোন সিনেমা দেখবেন, কেন দেখবেন, সিনেমায় কী দেখবেন, সিনেমাটি কীভাবে আলাদা, এর দার্শনিক সংঘাত বা কাল্ট ক্ল্যাসিক হওয়ার কারণ। লেখাটি সাধারণত স্পয়লারমুক্ত থাকবে, তবে প্রয়োজনে স্পয়লার থাকলে উল্লেখ করা হবে।
আজকের সিনেমা: তালিকার ১০০তম চলচ্চিত্র- সুপারব্যাড (Superbad)
সুপারব্যাড বিষয় দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে- ‘প্রতিটি প্রজন্মই তাদের নিজস্ব একটি টিন কমেডি’ পায়, যা সেই সময়ের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করে। ২১০০ শতকের জন্য, সেই সিনেমাটি হলো ‘সুপারব্যাড’। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি যেমন অশ্লীল রসিকতায় ভরপুর, অন্যদিকে খুব দুষ্ট মিষ্টি বাতাস বয়ে যায় সিনেমাজুড়ে। তবে উপমহাদেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমাটি দেখলে এর অশ্লীলতা আপনার কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। পরিচালক গ্রেগ মোটোলা এই হাস্যকর কাণ্ডকারখানাকে আরও একধাপ উপরে তুলেছেন রেট্রো স্টাইলের ওপেনিং টাইটেল আর একটি দারুণ মজার সব দৃশ্যের মাধ্যমে।
সুপারব্যাড এক রাতের হুলস্থূল আর এক ‘ম্যাকলাভিন’ আইডির মহাকাণ্ডকারখানা! ভাবুন তো, আপনি হাই স্কুলের শেষ বর্ষে। আর কিছুদিন পরেই কলেজ লাইফ শুরু হবে, প্রিয় বন্ধুটা হয়তো চলে যাবে অন্য শহরে। এই সময় মাথায় একটাই চিন্তা- কলেজে যাওয়ার আগে একটু ‘কুল’ হয়ে যেতে হবে! গল্পের কেন্দ্রে আছে দুই বেস্ট ফ্রেন্ড- সেথ আর ইভান। তারা হরিহর আত্মা; কিন্তু মারাত্মক রকমের অকওয়ার্ড। হাইস্কুল জীবনের ইতি টানার আগে তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য- ভার্জিনিটি হারানো! সুযোগও এসে যায়। স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়ে জুলসের পার্টিতে তাদের দাওয়াত জোটে। শর্ত একটাই- পার্টির জন্য মদ নিয়ে আসতে হবে; কিন্তু বয়স ১৮-র কম, মদ কিনবে কীভাবে? এখানেই এন্ট্রি হয় গল্পের আসল হিরো (নাকি জিরো?)-এর। তাদের আরেক বন্ধু ফোগেল (ক্রিস্টোফার মিন্টজ-প্লাস), যে কি না, একটি জঘন্য রকমের নকল আইডি বানিয়েছে। আইডিতে নাম কী? ম্যাকলাভিন। শুধু ম্যাকলাভিন! কোনো ফার্স্ট নেম বা লাস্ট নেম নেই। ঠিকানা-হাওয়াই। বয়স-২৫। এই একটা আইডিকে কেন্দ্র করে সেই রাতে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়। এরপর রাতজুড়ে চলতে থাকে পাগলামি, ভুল বোঝাবুঝি আর বন্ধুত্বের এক চরম পরীক্ষা।
সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন সেথ রোগেন এবং ইভান গোল্ডবার্গ। মজার ব্যাপার হলো, তারা যখন মাত্র ১৩-১৪ বছরের কিশোর, তখন থেকেই এই গল্প লেখা শুরু করেন। সিনেমার প্রধান দুই চরিত্রের নামও তাদের নিজেদের নাম থেকেই নেওয়া- সেথ ও ইভান। তাই এর ভেতরের বন্ধুত্ব আর কথোপকথনগুলো এত বাস্তব মনে হয়। ম্যাকলাভিনকে সবাই অপছন্দ করেছিল। ফোগেল ওরফে ম্যাকলাভিনের চরিত্রে অভিনয় করা ক্রিস্টোফার মিন্টজ-প্লাস বাস্তবেও একজন সাধারণ হাই স্কুল ছাত্র ছিলেন, যার কোনো অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না। অডিশনের সময় জোনাহ হিল তাকে একদমই পছন্দ করেননি। তার এই বিরক্তি দেখেই পরিচালক বুঝে গিয়েছিলেন যে, পর্দায় তাদের কেমিস্ট্রি দারুণ জমবে! আজকের সুপারস্টার এমা স্টোনের এটাই ছিল প্রথম বড় পর্দায় কাজ। এই সিনেমা দিয়েই তার হলিউডে যাত্রা শুরু। সিনেমার অনেক দৃশ্যই স্ক্রিপ্টে যেমন লেখা ছিল, তেমনভাবে শুট করা হয়নি। অভিনেতারা নিজেদের মতো করে অনেক সংলাপ বলেছেন, যা সিনেমাটিকে আরও মজাদার ও স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলেছে।
মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে বানানো এই সিনেমা বক্স অফিসে প্রায় ১৭১ মিলিয়ন ডলার আয় করে ব্লকবাস্টার হিট হয়। ‘সুপারব্যাড’ কেবল একটি হাসির সিনেমা নয়, এটি একটি দারুণ ‘কামিং-অব-এজ’ গল্প। কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখার মুহূর্ত, বন্ধুত্বের টানাপোড়েন এবং বিদায়ের কষ্টকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘ম্যাকলাভিন’ নামটি এখন একটি পপ কালচার আইকন। নকল আইডি বানানোর কথা ভাবলেই সবার আগে এই নামটিই মাথায় আসে। সিনেমার ভাষা বা সংলাপগুলো অনেকটাই টিনেজারদের বাস্তবজীবনের মতো, যা তরুণ দর্শকদের সঙ্গে সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
কেন এই সিনেমাটি কাল্ট ক্ল্যাসিক?
‘সুপারব্যাড’ অন্যান্য টিন-কমেডি থেকে অনেক আলাদা। এর বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে এর সততায়। এই সিনেমার সংলাপগুলো কাঁচা, অশ্লীল এবং অনেক সময় অস্বস্তিকর; কিন্তু ঠিক এই কারণেই এটি এত বাস্তব। বন্ধুদের মধ্যকার সেই অর্থহীন ঝগড়া, বিশ্রী জোকস এবং অদ্ভুত সব পরিকল্পনা, সবই যেন আমাদের হাইস্কুল জীবনের প্রতিচ্ছবি। বোকামির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বন্ধুত্ব সুপারব্যাড চলচ্চিত্রটিকে কাল্ট ক্ল্যাসিকে পরিণত করেছে। সিনেমার উপরিভাগে যতই নোংরা জোকস আর পাগলামি থাকুক না কেন, এর গভীরে লুকিয়ে আছে সেথ আর ইভানের বন্ধুত্বের এক মিষ্টি গল্প। তারা জানে, কলেজের পর তাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে, আর এই বিচ্ছেদের ভয় তাদের সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে। সিনেমার শেষে তাদের আবেগঘন মুহূর্তগুলো আপনাকে অবাক করে দেবে। কমেডির আড়ালে এমন নিখুঁত ইমোশনাল টাচ খুব কম সিনেমাতেই দেখা যায় এবং অবশ্যই, ম্যাকলাভিন! ‘ম্যাকলাভিন’ শুধু একটি নাম নয়, এটি একটি আইকন। ফোগেল নামের ছেলেটির তার ‘ম্যাকলাভিন’ পরিচয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা এবং দুই দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশের (বিল হেডার ও সেথ রোগেন) সঙ্গে তার অভিযান- এই সাব-প্লটটি সিনেমার অন্যতম সেরা আকর্ষণ। ‘আই অ্যাম ম্যাকলাভিন’ সংলাপটি সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত একটি লাইন হয়ে গেছে।
সুপারব্যাড দেখার সময় কী কী বিষয় মিস করবেন না
প্রথমত চরিত্রদের রসায়ন। জোনা হিল (সেথ) এবং মাইকেল সেরা (ইভান)-এর রসায়ন অসাধারণ। একজন প্রচণ্ড অস্থির আর মুখ খারাপ করা, অন্যজন শান্ত ও লাজুক। তাদের দুজনের কথোপকথন এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা সিনেমার প্রাণ। এরপর আসে দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশ জুটি। বিল হেডার এবং সেথ রোগেনের পুলিশ চরিত্র দুটি আইন রক্ষার চেয়ে নিজেরা মজা করতেই বেশি ব্যস্ত। তাদের কার্যকলাপ এতটাই হাস্যকর যে আপনি মূল গল্পের পাশাপাশি এই জুটির ফ্যান হয়ে যাবেন। এরপর সিনেমা অস্বস্তিকর মুহূর্তগুলো। সুপারব্যাডে আছে এমন অনেক মুহূর্ত আছে যা আপনাকে হাসানোর চেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ফেলবে। এই ‘ক্রিনটিজ কমেডি’-ই হলো ‘সুপারব্যাড’ এর অন্যতম শক্তি। চরিত্রদের বোকামি আর সামাজিক জড়তা দেখেই আপনি সবচেয়ে বেশি মজা পাবেন। সিনেমার মিউজিকটিও দারুণ। ৭০-এর দশকের ফাঙ্ক মিউজিক সিনেমাটিকে এক অন্যরকম স্টাইলিশ ভাইব দিয়েছে, যা এর কমেডির সঙ্গে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি করে।
অ্যাবসার্ডিটি ও অস্তিত্ববাদ: ম্যাকলাভিনের অভিযান
ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কামুর অ্যাবসার্ডিটি বা অর্থহীনতার দর্শনের সঙ্গে সুপারব্যাডের কাহিনির অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেথ ও ইভানের কাছে, ওই এক রাতের জন্য পার্টিতে মদ সরবরাহ করাটা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই তুচ্ছ লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তারা যে ভয়ংকর এবং হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়, তা আসলে জীবনের বৃহত্তর অর্থহীনতারই একটি ছোট প্রতিচ্ছবি। সিনেমার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেথ এবং ইভানের গভীর অথচ জটিল বন্ধুত্ব। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তিন ধরনের বন্ধুত্বের কথা বলেছিলেন:
১. উপযোগিতার বন্ধুত্ব: যেখানে একে অপরের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়াই মূল উদ্দেশ্য।
২. আনন্দের বন্ধুত্ব: যেখানে একে অপরের সঙ্গ আনন্দদায়ক বলে বন্ধুত্ব টিকে থাকে।
৩. সদ্গুণের বন্ধুত্ব: যেখানে বন্ধুরা একে অপরের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রকে সম্মান করে এবং একে অপরের ভালো চায়।
সেথ ও ইভানের বন্ধুত্ব প্রথম দুটি স্তর পার করে তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, একে অপরকে সঙ্গ দেয়; কিন্তু সিনেমায় যখন তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়, তখন তাদের ভেতরের নিরাপত্তাহীনতা, ভালোবাসা এবং ভয় প্রকাশ পায়। তারা একে অপরকে আঘাত করে, কারণ তারা জানে যে কলেজ তাদের আলাদা করে দেবে। এই বিচ্ছেদের ভয় তাদের সম্পর্ককে এক নতুন গভীরতা দেয়। সার্ত্রের দর্শনে ‘অপর’-এর ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিচয় অনেকাংশেই অন্যরা আমাদের কীভাবে দেখে, তার ওপর নির্ভর করে। সেথ এবং ইভান একে অপরের জন্য সেই ‘অপর’। সেথের অতি আত্মবিশ্বাসী ও অশ্লীল আচরণের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিরাপত্তাহীনতাকে ইভান জানে, আবার ইভানের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বভাবকে সেথ বোঝে। তারা একে অপরের পরিপূরক। তাই আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয় আসলে নিজের পরিচয়ের একটি অংশ হারানোর ভয়।
পরিচয়, মুখোশ ও উত্তরণের উপাখ্যান
ফোগেলের "ম্যাকলাভিন" চরিত্রটি পরিচয় নির্মাণের ধারণাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরে। এই জাল আইডি কার্ডটি কেবল একটি বস্তু নয়, এটি একটি মুখোশ। ফোগেল এই মুখোশের আড়ালে এমন এক আত্মবিশ্বাসী মানুষ হয়ে ওঠে, যা সে আসল জীবনে নয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই সামাজিক পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুখোশ পরি আর সেটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করি। এই সিনেমাটি আসলে একটি উত্তরণের উপাখ্যান। সেথ ও ইভান শিশুতোষ জগৎ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক জগতের কঠিন বাস্তবতায় পা রাখতে চলেছে। পার্টিতে যাওয়ার এই অভিযানটি তাদের জন্য সেই উত্তরণের একটি প্রতীকী রিচুয়াল। সিনেমার শেষে তারা শেখে যে, মদ্যপান বা শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া যায় না। বরং, কঠিন সত্যকে গ্রহণ করা এবং সম্পর্কের জটিলতাকে বোঝার মাধ্যমেই আসল মানসিক উত্তরণ ঘটে। সুপারব্যাড বয়ঃসন্ধিকালের যন্ত্রণা, বন্ধুত্বের গভীরতা এবং আত্ম-আবিষ্কারের এক দার্শনিক আখ্যান। এর স্থূলতার নিচে রয়েছে এক অদ্ভুত সততা, যা শেখায় যে জীবনের সবচেয়ে অর্থহীন ও হাস্যকর মুহূর্তগুলোই মাঝে মাঝে আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়ে যায়।
রটেন টমাটোতে এ সিনেমাটির রেটিং ৮৮ শতাংশ, মেটাক্রিটিক এ সিনেমাটি পেয়েছে ৭৬/১০০ স্কোর, সিনেমাস্কোর-এ দর্শকদের জরিপে সিনেমাটি পেয়েছে এ গ্রেড। ‘সুপারব্যাড’ এমন একটি সিনেমা যা আপনাকে হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়ে দেবে, আবার একই সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য মন খারাপও করিয়ে দেবে। যদি আপনি এখনো এই মাস্টারপিস কমেডিটি না দেখে থাকেন, তবে আর দেরি কেন? আর যদি দেখেও থাকেন, তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে আরেকবার দেখার জন্য এর চেয়ে ভালো সিনেমা আর হয় না! কারণ দিনের শেষে, বন্ধুত্বটাই আসল ‘সুপারব্যাড’ বা ‘সুপারকুল’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে