Views Bangladesh Logo

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অসংখ্য শিরোনামে লেখা যায় যার নাম

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

মরা যারা নব্বই দশকে বেড়ে উঠেছি তাদের চোখের সামনে ছিলেন অসংখ্য দিকপাল, মহীরুহ। সাহিত্য-রাজনীতি-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল সব নক্ষত্রের বিচরণ। যারা তাদের বিভিন্ন লেখালেখি, কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-পূর্ব যেমন, তেমনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না বলে নাম উল্লেখ করছি না। একসঙ্গে এত নাম স্মরণ করা কঠিন; কিন্তু আজ যদি সামনের দিকে তাকাই দেখব চারদিক শূন্য। বেঁচে আছেন হাতেগোনা কয়েকজন। আমাদের সেই যুগপুরুষদের মধ্যে এখনো জীবিত আছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এই কিছুদিন আগেই চলে গেলেন বদরুদ্দীন উমর, যতীন সরকার এবং আহমদ রফিক। গতকাল চিরবিদায় নিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ষাট-সত্তর দশকে আমাদের যে জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের এক স্বর্ণোজ্জ্বল, গৌরবময় অধ্যায় শুরু হয়েছিল সৈয়দ মনজরুল ইসলাম ছিলেন তারই শেষ প্রতিনিধি। কথাটা এই অর্থে বলছি যে, ষাট-সত্তর দশকের সঙ্গে তিনি আশি-নব্বই বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছিলেন।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অধ্যাপক ছিলেন, দীর্ঘ চার দশক পড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে; কিন্তু, অধ্যাপকসুলভ আচরণ তার মধ্যে ছিল না, ছিলেন বন্ধুর মতো, বড় ভাইয়ের মতো, প্রয়াণের পর তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা এ-কথা বলছেন তার সম্পর্কে। কবি টোকন ঠাকুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিখেছেন, ‘সৈয়দ মনজুরের অন্যতম গুণ, আমাদের মতো ছাত্র বা পুত্রসমদের কাছেও তার অ্যাপ্রোচ ছিল একদমই ফ্রেন্ডলি। ‘জ্ঞানী অধ্যাপক’ মার্কা নয়। শ্রদ্ধাভাজন একজন সিনিয়র বন্ধুকেও হারালাম।’


কথাটা কতখানি সত্যি তা বোঝা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও আরও অসংখ্য ভক্ত-বন্ধু- শুভানুধ্যায়ীদের শ্রদ্ধা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ফেসবুক ভরে গেছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক-পাঠকের শোক-শ্রদ্ধায়। লেখক হিসেবে হয়তো সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সর্বমহলে এতটা জনপ্রিয় ছিলেন না; কিন্তু মানুষ হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। মানুষ হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন কারণ তার কাছে যাওয়া যেত নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায়। গুরুগম্ভীর তো ছিলেনই না, বরং যার সঙ্গে মিশতেন তার মতোই হয়ে যেতেন, নিজের ব্যক্তিত্ব অক্ষুণ্ন রেখেই। তাকে ঠিক রাশভারী বলা যায় না; কিন্তু একটা অটটু বিষয় ছিল তার মধ্যে, কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই যেন নৈকট্য প্রতিষ্ঠা করতেন।


তরুণদের মধ্যে তার অসম্ভব জনপ্রিয়তার মূল কারণ তিনি অসংখ্য তরুণের সঙ্গে মিশতেন। যারাই তার কাছে যেত আরাম করে বসতে পারত। ডাকলেও তাকে পাওয়া যেত অনেক অনুষ্ঠানে; কিন্তু এটাই সম্ভবত বিশেষ কারণ না। অনেকেই বিনয়ী, কাছে গেলে গল্পও করেন, ডাকলেও বিশেষ অনুষ্ঠানে আসেন; কিন্তু তারপরও অনেককেই দেখেছি, বয়সের কারণেই হোক, আর যে কারণেই হোক, তরুণদের সঙ্গে মিশতে চাইলেও পারতেন না। এতে দুপক্ষ থেকেই একটা দূরত্ব, বাধা বা সংকোচ কাজ করত। একটা উদাহরণ যদি দেই, যেমন- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। নব্বই দশকের পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ ঘটেনি। বিশেষ কেউ হয়তো পরিচিত, ঘনিষ্ঠ; কিন্তু বন্ধুত্ব হয়নি। এদিক থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। তার সাক্ষাৎ ছাত্ররাও অনেকে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। শুধু নব্বই দশক না, পরবর্তী দুদশকের লেখক-কবি-সাহিত্যিকরাও তার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হননি। এই যে সময় ও ব্যক্তিত্ব অতিক্রম করে যাওয়ার যে বৈশিষ্ট্য, আমাদের দেশে এটাকে একটা বিরল গুণ হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে। কারণ, আমরা তো দেখেছি, একটু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেলেই অনেকে দূরে সরে যান, নিজেকে সাধারণের কাছ থেকে আড়াল করে নেন। সৈয়দ মনজরুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে অসাধারণ হয়েও ছিলেন সাধারণ। এই সাধারণ হওয়াটাই তার অসামান্য অসাধারণ গুণ!

২.সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শুধু লেখালেখিতে, আড্ডায় মশগুল থাকেননি, প্রয়োজনে তার কণ্ঠস্বরও উঁচু করেছেন। যেমন, একবার তার একটা কথা খুব ভাইরাল হয়ে গেল, ‘কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধু প্রশাসক!’ জীবনের শেষ পাবলিক স্পিচেও, গত ২৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক সাহিত্য অনুষ্ঠানেও তিনি বলে গেলেন, ‘শিক্ষকদের ভালো হতে হবে। শিক্ষকদের মেধাবী হতে হবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা কত বেতন পান? সংস্কার তো ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে।’


এই কণ্ঠস্বরগুলো থেমে যাচ্ছে। আমাদের কাল হচ্ছে মহীরুহদের চলে যাবার দেখার কাল। একে একে সব বাতি নিভে আসছে। সামনে অন্ধকার আর আলোরও দেখা নেই সহসা। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলো নিয়ে যারা জোর গলায় কথা বলতেন, যাদের কথার একটা আলাদা মূল্য ছিল সমাজে, সেসব মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছেন। অভিভাবক-শূন্য হয়ে পড়ছি আমরা। আমাদের প্রজন্মের কাছে এ এক বিরাট শূন্যতা। সময়ের কারণে এক প্রজন্ম বিদায় নেয়, আরেক প্রজন্মের জন্ম হয়- এটাই জীবন-জগতের রীতি। তারপরও এই চিরন্তন সত্য আমাদের জন্য মেনে নেয়া কষ্টকর এই জন্য যে, আমাদের শুধু যাচ্ছে, বিগত হচ্ছে; কিন্তু, জন্ম হচ্ছে না আর সেরকম আলোকিত প্রজন্মের। বিশাল এক বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতা যে আমাদের দেশে সৃষ্টি হচ্ছে সেটা বলাইবাহুল্য।


আরও এক দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, নব্বই দশকের যারা আগের প্রজন্মগুলোর পথ অনুসরণ করেছেন, তারাও পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি। এতেও প্রজন্মের মধ্যে একটা বিরাট শূন্যস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। এখনো দুচারজন কথা বলেন; কিন্তু বেশিরভাগ কথাই হয়ে যায় বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষের বয়ান। আলাপ-আলোচনার যে একটা ক্ল্যাসিক ধারা আছে, মানে শিল্প-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এক প্রকার জনপরিসর তৈরি করা, সেটা কালের ধুলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই ক্ল্যাসিক ধারাটা বহমান রেখেছিলেন। তার লেখালেখির মধ্য দিয়ে, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে, আগের প্রজন্ম ও পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে, এমন কি পোশাক-আশাকের মধ্য দিয়েও। ‘নন্দনতত্ত্ব’ নামে যে ছোট একটি বই লিখেছিলেন, তার সমস্ত অভিব্যক্তির মধ্যেই ছিল সেই নান্দনিকতার প্রকাশ। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি সেই ক্ল্যাসিক ধারার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সংযোগ ঘটাতে চেয়েছেন বারবার। ‘অলস দিনের হাওয়া’ ও ‘লেখাজোখার কারখানাতে’ তিনি লিখেছেন জন কিটস, ইয়েটস, উমবার্তো একো, পুশকিনের মতো ধ্র্রুপদী কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে। ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, উত্তর আধুনিক সাহিত্যকে আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন মুঠো খুলে জাদুকরের হাতের মুক্তো দেখানোর মতো করে। সমসাময়িক লেখক চিন্ময় গুহের বই নিয়ে লিখতেও তিনি কার্পণ্য করেননি। চিত্রকলা নিয়ে লিখেছেন বিস্তর। উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে আমাদের অনেক লেখকদের মধ্যেই একটা ধোঁয়াশা আছে, তিনি যে পরিস্কার ছিলেন এবং আমাদের মতো অবুঝদেরও পরিস্কার বোঝাতে পেরেছিলেন তা তার ছোট কিছু প্রবন্ধের মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করা যায়।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রতি আমাদের অভিযোগ একটাই, তিনি আরও বেশি করে কেন লিখলেন না? তার যে পরিমাণ জানাশোনা, পাণ্ডিত্য ছিল তার তুলনায় তিনি লিখেছেন খুব অল্পই। শেষ দিকে খুব নানা অনুষ্ঠানে যেতেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সভাপতির আসন অলঙ্করণ করতেন, এ নিয়ে নিন্দুকেরা ও শুভাকাঙ্ক্ষীরাও বলতেন, তিনি আনিসুজ্জমানের পদটি দখল করেছেন!


মৃত্যুকালে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বয়স হয়েছিল ৭৪। তাও চলে যাওয়ার সময় বলা চলে না। তাকে সবসময় শক্তসামর্থ্যই লাগতো। তার বয়সটা তেমন বোঝা যেত না। এক হার্ট অ্যাটাকে এভাবে চলে যাবেন এটা কেউ কল্পনাও করেনি। লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরেও এসেছিলেন, সবাই আশা করেছিলেন ফিরেই আসবেন; কিন্তু অনন্তের পথেই পাড়ি জমালেন। অনন্তের পথযাত্রী হয়েও তিনি আমাদের ধুলোমাটির পৃথিবীতে থেকে যাবেন তার লেখালেখির মধ্য দিয়ে। গল্প-উপন্যাসে তিনি সবসময় এমন সব ভঙ্গুর মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন, ভেঙে পড়তে পড়তেও যারা শিরদাঁড়া সোজা রাখে, দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতেও যারা স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে আর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতেও আলোর অন্বেষণ করে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ