Views Bangladesh Logo

জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ ও প্রতিশ্রুতির পুনর্জাগরণে ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’

বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’ প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী। সোমবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রযোজনায় এবং পরিচালক আরিফুর রহমানের নির্মাণে ৩০ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রটি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাবলি ও শহীদদের আত্মত্যাগ তুলে ধরে।

প্রদর্শনীর শুরুতে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিহত বা আহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গ, যাদের সাক্ষাৎকার প্রদর্শনীকে আবেগঘন করে তোলে।

শহীদ আবু সায়ীদের পিতা মোকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেটা আমার সংসারের মধ্যে একটা প্রদীপ ছিল। আমার বাড়িঘর যারা দেখেছেন তারা বলেন, কৃষকের ছেলে ভার্সিটিতে পড়তে পারে?। আমার ছেলেটা মেধাবী ছিল। ক্লাশ এইট-নাইনে থাকতেই মানুষের ছেলে-মেয়েদের টিউশানি করিয়ে ওর খরচ ওই চালাতো। নিজের খরচে পড়েই সে অর্নাস পাশ করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার আশা ছিল ছেলেটা একটা চাকরি করবে, সেই আশাটা আর থাকল না। ছেলেটা দুনিয়া থাইকা বিদায় নিল।’

আবু সাঈদের বাবা ছাড়াও শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা শামসি আরা কান্না জর্জরিত কণ্ঠে বলেন, ‘জুলাইয়ে আগে যারা শহীদ হয়েছে তাদের মৃত্যুতে আমি কেঁদেছি। কিন্তু আমার সন্তানের মৃত্যু আমাকে আসলে তখন কাঁদাতে পারেনি। তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার সব সন্তানের মৃত্যুর বিচার আমাকে চাইতেই হবে। অন্যদের মৃত্যুর কথা চিন্তা করে আমি আমার সন্তানের মৃত্যুর কষ্টটা চাপা দিয়ে রাখি।‘

প্রিয়র মা আরও বলেন, আমার ছেলে বই পড়তে ভালোবাসতো, ন্যায়বিচারের কথা বলতো, আজকে সে বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক কিছু করতে পারত। সরকারের প্রতি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার করার আহ্বান জানান তিনি।

সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান, সাংবাদিকদের জীবনমান যেন আরেকটু ভালো হয় সেই ব্যবস্থা সরকার করে। তাদের সেই সম্মান ছিল না বলেই হয়তো তারা ফ্যাসিস্টের সাথে মিলে যেত। সংসার ব্যয় বহন করার জন্য অনেকেই হয়তো বাধ্য হতো।

প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টাদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুল (আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক ), আদিলুর রহমান খান (গৃহায়ন ও গণপূর্ত), মোস্তফা সরয়ার ফারুকী (সংস্কৃতি), মাহফুজ আলম (তথ্য সম্প্রচার) এবং তথ্যসচিব বেগম মাহবুবা ফারজানা।

তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে পেরেছি। এখন এ ধরনের চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা জুলাইকে বারবার স্মরণ করতে চাই। জুলাই আন্দোলনে শহীদের পরিবারকে, জুলাই আন্দোলনে আহত, অংশগ্রহণকারী সবাইকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমাদের দায়িত্বের কথা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যদি আবারও এ ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনের মুখোমুখি হই, আমরা যেন আবারও লড়াই করতে পারি। আমরা শুধু জুলাই মাসেই যে জুলাইকে স্মরণ করব তা না, আমরা সব সময়ই জুলাইয়ের কথা মনে রাখব। বিশেষ করে বাংলাদেশ এখন যে সংকটময় পরিস্থিতিতে আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়াও চলছে, যে আসলে কী ধরনের রাষ্ট্র আমাদের দরকার, অনেক অগ্রগতি আছে, কিন্তু এর সাথে আমাদের অনেক হতাশাও আছে। নাগরিকদের অনেক হতাশা আছে। সরকার পরিচালনায় অনেক আকাঙ্খার কাছাকাছি না যাওয়ার হতাশা আছে। কিন্তু এখনো আমরা চাই বাংলাদেশের মানুষের আশা যেন আমরা পূরণ করতে পারি। আমি মনে করি আমরা যদি লেগে থাকতে পারি তাহলে বাংলাদেশকে একটা গণতান্ত্রিক এবং সকলের রাষ্ট্র বানাতে পারব। ’

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘এত বড় যে জুলাই সেটা কোনোদিনও বিস্মৃত হবে না সেটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলাদেশে জুলাই কখনো বেহাতও হবে না এটাও আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি যখন আপনাদের জায়গায় ছিলাম তখন সব কথা বলতে পারতাম। কিন্তু এখন সব কথা বলতে পারি না। কিন্তু একটা কথা আপনাদেরকে বলি, আমাদের খুব বেশি হতাশ হবার কারণ নেই।‘

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমি জানি বিচার নিয়ে আপনাদের অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু আপনাদেরকে আমি নিশ্চিত করি, বিচার পূর্ণ গতিতে চলছে, বিচার পূর্ণ মাত্রায় দৃশ্যমান আছে। আমরা সর্বোচ্চ মানের একটা বিচার করতে চাচ্ছি। আপনারা নিশ্চিত থাকেন, আপনাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আজকে আমাদের শহীদ পরিবার যেটা বলেছেন, আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি নির্বাচনের আগে অবশ্যই বিচার হবে।’

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “১৬ বছরের শোষণ ও লুণ্ঠনের পর সত্য, ঐক্য ও সাহসের গল্প গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্যই নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।”

প্রামাণ্যচিত্রে একটি স্মরণীয় মুহূর্ত উঠে এসেছে। সেটা হচ্ছে শহীদ রিয়া গোপের বাড়ির দোলনার দৃশ্য।

রিয়া গোপ ছিলেন ২০২৪ সালে সংঘটিত কোটা সংস্কার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এক কনিষ্ঠ শহীদ। মাত্র ৬ বছর বয়সে পুলিশের গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ২৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

প্রদর্শনী শেষে পরিচালক আরিফুর রহমান দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শহীদ রিয়া গোপের বাড়িতে শুটিং করতে নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রিয়া গোপের পরিবার থেকে বলা হয়, যদি আমার মেয়েকে ফেরত আনতে পারেন তাহলে শুটিং করতে পারবেন। তারপরও সারাদিন বাড়ির সামনে টিম নিয়ে বসেছিলাম। গেটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম বাড়ির ভেতরে একটা দোলনা দুলছে।

প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ জানান, ছবিটি ইংরেজি, আরবি, ফরাসি, স্প্যানিশ, চীনা, রুশ এবং তুর্কিসহ আটটি ভাষায় সাবটাইটেল করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করা হবে।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ