বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলে জয়-পুতুলকে নেতৃত্বে আনছেন শেখ হাসিনা’
১৯৮১ সাল থেকে টানা ৪৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনা এখন প্রথমবারের মতো দলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব নিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছেন। ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে দীর্ঘ এক বছর ধরে দিল্লির আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে অনেকটা সীমিত হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতি এবং বয়সজনিত বাস্তবতা মিলিয়ে তিনি এখন নিজের ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে কেন্দ্র করে একটি পারিবারিক নেতৃত্ব কাঠামো গড়ার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করেছেন। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সূত্রগুলোর বরাতে বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে।
বিবিসি বাংলা বলছে, এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে বেশ কিছু কারণ। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ধসে পড়ে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে, শেখ হাসিনা না থাকলে কার নির্দেশে দল চলবে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের নিষেধাজ্ঞায় দলটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সেই শূন্যতা শেখ হাসিনাকে উত্তরাধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও আওয়ামী লীগের হয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দলীয় অবস্থান তুলে ধরছেন নিয়মিত। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি প্রকাশ্যে দলের পক্ষে কথা বলছেন। তিনি এখন ‘দলের মুখপাত্র’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। অন্যদিকে, সায়মা ওয়াজেদ, যিনি আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন, এখন তার পদ থেকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে রয়েছেন এবং সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন। ভারতেই অবস্থানরত শেখ হাসিনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বর্তমানে কাজ করছেন তার এই মেয়ে।
দলের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দায়িত্ব, ভাষণ প্রস্তুত, কর্মসূচি পরিকল্পনা, এমনকি কূটনৈতিক বৈঠকে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার মতো গুরুতর দায়িত্বও এখন পালন করছেন সায়মা ওয়াজেদ। গত দুই মাসে তিনি একাধিক বৈঠক করেছেন যেগুলো শেখ হাসিনার পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্বে জয়-পুতুলকেই সামনের সারিতে আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এই নেতৃত্ব বিন্যাস অনেকটা ভারতের কংগ্রেস দলের বর্তমান কাঠামোর মতো, যেখানে সোনিয়া গান্ধীর পেছনে থেকে ছেলে রাহুল গান্ধী মূল নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং মেয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তাকে সহযোগিতা করছেন। শেখ হাসিনাও তার ছেলেমেয়েকে এভাবে দুটি মূল ভূমিকায় সাজিয়ে নেতৃত্ব হস্তান্তরের রূপরেখা তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও এসেছে। ওবায়দুল কাদের এখনো কাগজে-কলমে দলের সাধারণ সম্পাদক হলেও গত ১০ মাসে ভারতে অবস্থান করেও শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তার জায়গায় দল চালনায় বেশি ভরসা করা হচ্ছে কলকাতায় অবস্থানরত তিন নেতা—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বাহাউদ্দিন নাসিম এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকের ওপর। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন সায়মা ওয়াজেদ। এই তিনজনকে ঘিরেই কলকাতায় গড়ে উঠেছে একটি ‘অস্থায়ী সাংগঠনিক কেন্দ্র’, যা মূলত দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও সায়মা এবং ভার্জিনিয়ায় সজীব ওয়াজেদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দল চালাচ্ছে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের গান্ধী পরিবারের সম্পর্ক বহু পুরনো। তিনি সোনিয়া গান্ধী, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছেন বছরের পর বছর। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তার এক সফরে তিনি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান এবং অবশেষে দিল্লির একটি হোটেলে রাতের বেলায় সেই সাক্ষাৎ হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে রাহুল গান্ধীর 'ভারত জোড়ো যাত্রা' নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তা নিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেন। এই পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাও আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব কাঠামো গঠনে একটি মানসিক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিনোদ শর্মা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ মূলত পরিবারকেন্দ্রিক দল। সেজন্য তাদের নেতৃত্বও ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’ থেকেই আসবে—এটাই স্বাভাবিক। তার মতে, বিজেপির মডেল আওয়ামী লীগের জন্য উপযুক্ত নয়; বরং কংগ্রেসের পারিবারিক কাঠামোই শেখ হাসিনার দলের জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে