সেলিম আল দীন: বিস্ময়কর কথাকারুকার
গত কয়েকশ বছর ধরে পৃথিবীর কবি, কথাকার ও নাট্যকাররা মানবজীবন ও মানবেতর প্রাণীজীবনের যেসব বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক লিখেছেন সেসব বিষয় নিয়ে বহু শতাব্দী আগেই লিখে গেছেন বেদব্যাস, হোমার, বাল্মিকী কিংবা ফেরদৌসী। তারা নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাদের সাহিত্যকর্মে। মানবজীবনের সব বোধ, উপলব্ধি, অনুভূতি, আনন্দ, বেদনা, চেতনা, শোক, তাপ, বিলাপ তারা গুঁজে দিয়েছেন শ্লোক ও আখ্যানের ভেতরে। পরবর্তীকালের সাহিত্যিকরাও বৈচিত্রপূর্ণ বিষয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন নানা আঙ্গিক ও নানা ভাষায়। সেলিম আল দীন জানতেন, এই বিপুল সাহিত্যকর্মের মধ্যে সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন করে তুলতে হলে লিখতে হবে এমন বিষয় নিয়ে, যে বিষয়ে লেখেননি তার পূর্বজ সাহিত্যিকরা। লিখতে হবে এমন কৌশলে, যে কৌশল আগে প্রয়োগ করেননি তার পূর্বজরা। নইলে সাহিত্যসৃষ্টির নামে কেবলই পুনরাবৃত্তি হবে, কেবলই বৃক্ষনাশ হবে।
সে কারণেই ১৯৮৬ সালে রচিত কেরামতমঙ্গল থেকে শুরু করে চাকা, হরগজ, যৈবতী কন্যার মন, হাতহদাই, প্রাচ্য, নিমজ্জন, বনপাংশুল, স্বর্ণবোয়াল, ধাবমান এবং পুত্র পর্যন্ত সেলিম আল দীন সত্যিকারার্থে মহাকবিদের মতো মাস্টারপিসই লিখেছেন। পাঠক বা দর্শকবৃন্দ এই মাস্টারপিসসমূহকে নাটক বলতে পারেন, কথাসাহিত্য বলতে পারেন, কথানাট্য কিংবা কথাকাব্যও বলতে পারেন। এই বলায় যে কোনো বাধা নেই, তা সেলিম আল দীনের পাঠক, দর্শক এবং দেশের প্রত্যেক শিল্পবোদ্ধাই স্বীকার করবেন। কেননা তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক শিল্পই একই উৎসবিন্দু থেকে উৎসারিত। একই বিন্দু থেকে উৎসারিত হয়ে তা বহু ধারায় বিভক্ত হলেও সেই বহু ধারাকে এক করে একের মধ্যে বহুকে এক নিপুণ শিল্প ঐক্যে সংহত করা সম্ভব এবং তিনি তা করেও দেখিয়েছেন তার এসব সাহিত্যকর্মে। তিনি এই শিল্পরীতির নাম দিয়েছেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব। পাক্ষিক আনন্দ আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘প্রথমদিকে নাটক লিখতে গিয়ে আমি আঙ্গিক এবং বিন্যাস নিয়ে খুব একটা চিন্তা করিনি। যা মনে এসেছে তাই লিখে গেছি। কীর্ত্তনখোলা নাটকটি লেখার সময় আমার মনে হলো, নাটক কেন কবিতার গভীরতা অর্জন করতে পারবে না। কেনই বা তাতে উপন্যাসের বিস্তৃতি থাকবে না। ইউরোপীয় একরৈখিক নাটককে আমার কাছে পানসে মনে হতে লাগল। সংলাপের পর সংলাপ দিয়ে ইউরোপীয় গাঁথুনি আমার একঘেয়ে মনে হতে থাকল। অনুবর্তনের ভারে ক্লিষ্ট ইউরোপীয় নাট্যধারা আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হলো। ঠিক সেই সময় আমার মাতৃভূমির কালজয়ী লেখকরা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কখনো মুকুন্দরাম, কখনো আবার শাহ মুহম্মদ সগীর, কখনোবা আলাওল কিংবা কখনো আসামের শংকর দেব। নাটককে আমি কবিতা-উপন্যাসের যুগল বন্ধনে একটা পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম হিসেবে দেখার চেষ্টা করি। এটাকেই পরে আমি দ্বৈতাদ্বৈতবাদ নামে শিল্পতত্ত্বের আকারে প্রকাশ করি। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ আসলে এমন একটি শিল্পকর্ম যাতে থাকে পদ্যের সুষমা, উপন্যাসের গতিময়তা আর সুরের সুমিষ্টতা।’
লক্ষণীয় যে, মাতৃভূমির কালজয়ী লেখক হিসেবে সেলিম আল দীন যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাতেই বোঝা যায় তার মাতৃভূমির ভূগোল। বর্ধমান তথা পশ্চিমবঙ্গের মুকুন্দরাম থেকে আরাকান রাজসভার আলাওল হয়ে তিনি চলে গেলেন আসামের শংকর দেবের কাছে। অর্থাৎ বৃহৎবঙ্গ বা অখণ্ড বাংলাকে তিনি নিজের মাতৃভূমি জ্ঞান করতেন এবং মাতৃভূমির জনগোষ্ঠী-চর্চিত প্রাচীন শিল্পরীতির অনুসন্ধানে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন। তার সেই ব্রত বিফল হয়নি। তার হাতে উঠে এসেছিল শিল্পের স্বর্ণফসল। সেই কারণে তার উপাধি ‘শেকড়সন্ধানী নাট্যকার।’ তার শেকড়সন্ধান নিয়ে বিগত দিনে বিস্তর কথা হয়েছে, বলেছেন নানাজন; নতুন করে আর কিছু বলার নেই। বরং বলা যেতে পারে কীভাবে তার রচনাসমূহ মাস্টারপিস হয়ে উঠেছে সেই বিষয়ে।
সাহিত্যকর্ম মাস্টারপিস হয়ে ওঠার প্রধান শর্তগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বিষয়। সেলিম আল দীন অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বিষয় নির্বাচনে। যে বিষয়ে ইতোপূর্বে শিল্পসৃষ্টি হয়ে গেছে, সেই বিষয় তাকে আকৃষ্ট করত না। তার উল্লিখিত সাহিত্যকর্মসমূহ পাঠ করলে বোঝা যায় এসব বিষয়ে তার পূর্বজ কিংবা সমকালীন সাহিত্যিকরা লেখেননি। লেখেননি বলেই এসব বিষয় তাকে আকৃষ্ট করেছিল।
তার প্রতিটি সাহিত্যকর্মের বিষয় ব্যতিক্রম, অভিনব, স্বতন্ত্র, এমনকি অচেনা। পাঠশেষে বিহ্বল পাঠকের মনে হয়, এই বিষয়কে নিয়ে এমন অসাধারণ সাহিত্যসৃষ্টি হতে পারে! যেমন চাকা কথানাট্যে একটি বেওয়ারিশ লাশের সঙ্গে দুই গাড়োয়ানের আত্মিক সম্পর্ক এবং সবশেষে সেই লাশের শেষকৃত্য সম্পাদনের মাধ্যমে প্রান্তজনের মানবিকতার যে হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য ভেসে ওঠে, তার গভীরে আছে এক গণঅভ্যুত্থান এবং সেই অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতন ও গণতন্ত্রের বিজয়ের প্রেক্ষাপট। সেই অভ্যুত্থানে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন বিস্তর যুবক। তাদের অনেকের নাম-সাকিনের খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে ঠিকমতো তাদের দাফন-কাফন পর্যন্ত হয়নি। সরকারি নির্দেশে তেমনি এক বেওয়ারিশ লাশ বহন করে নিয়ে চলে দুই গাড়োয়ান। বাস্তব প্রেক্ষাপটে কল্পনার এমন শৈল্পিক বিস্তার সেলিম আল দীন চাকায় যেভাবে ঘটিয়েছেন, তা তার সমকালীন কোনো সাহিত্যিক ঘটাননি অর্থাৎ এই বিষয়ে তারা কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। করেননি বলেই বিষয়টি আকৃষ্ট করেছিল তাকে।
কিংবা ১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের হরগজ গ্রামে এক বিধ্বংসী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপটে রচিত হরগজ কথানাট্য আমাদের এমন এক প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় যা পাঠে আমরা বিপন্ন বোধ করি। প্রকৃতির আদিম ধ্বংসাত্মক রূপের সামনে বিশ শতকের অন্তিম চরণে দাঁড়িয়েও বিত্তবৈষম্যের কারণে প্রান্তিকজনের নিরাপত্তাহীন অসহায়ত্ব, সুরক্ষাবিহীন আশ্রয়ক্ষতি আর চরম দুর্ভোগের অভিজ্ঞতা হরগজের মতো বাংলাদেশের বিস্তর গ্রামীণ জনপদের দৈন্যদশার প্রতীকী উপস্থাপনা শহুরে সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের নিরাপদ সুরক্ষিত জীবনযাত্রার মর্মে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। হরগজ জনপদের সেই বিধ্বংসী ঝড়কে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বলেই সেলিম আল দীন এই প্রেক্ষাপট বেছে নিয়েছিলেন।
ওদিকে স্বর্ণবোয়াল পাঠান্তে পাঠকের মনে হয়, একটি মাছকে বিষয় করে এমন শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি কেবল প্রতিভাবান সাহিত্যিকের পক্ষেই সম্ভব। এই আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র চিরলি গাঙের এক বিশাল অজেয় মাছ, চকচকে বর্ণের এক স্বর্ণবোয়াল। নিকারি পাড়ার প্রবাদপুরুষ লিক্কত মাঝি বলেছিল এই স্বর্ণবোয়ালের গল্প। এই মাছ শিকারের নেশায় জীবন বলি দিয়েছে তিরমনের দাদা জনম মাঝি এবং বাবা খলিশা মাঝি। জনম মাঝি ষাট বছর বয়সে কোশায় বসে বেউলা বিলের মোহনায় ভোররাতে ছিপ ফেলে বড়শিতে গেঁথেছিল অধরা মাছটিকে; কিন্তু ছোট্ট কোশাসহ সেই মাছ তাকে টেনে নেয় চিরলির গহিন গহ্বরে। জনম মাঝির স্বর্ণবোয়াল শিকারের নেশা রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে পুত্র খলিশার শরীরে; কিন্তু সেও ব্যর্থ হয়েছে মাছটি শিকারে। সে ব্যর্থ হলেও মৃত্যুসিথানে গিয়ে স্বপ্ন দেখে তার পুত্র তিরমন জয় করতে পারবে সেই অজেয় মাছকে। পিতার কাছে স্বর্ণবোয়ালের গল্প শুনতে শুনতে পুত্রের ভেতরও জেগে ওঠে এই মাছ শিকারের নেশা। তাই বাবাকে মৃত্যুসিথানে রেখে মায়ের শত বারণ উপেক্ষা করে ভাদ্র শুরুর এক ঝড়ের রাতে তিতকামারের বড়শি নিয়ে সে যাত্রা করে স্বর্ণবোয়াল শিকারে। এই উপাখ্যানের বিষয়ও বাংলার যুগচলতি সাহিত্যধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, ব্যতিক্রম। মাছকে প্রধান চরিত্র করে এত বড় পরিসরে বাংলা ভাষায় আর কোনো উপন্যাস বা নাটক রচিত হয়নি।
এভাবে সেলিম আল দীনের প্রতিটি সাহিত্যকর্ম পাঠ করলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বিষয় নির্বাচনে তিনি যে অত্যন্ত সচেতন এবং পারঙ্গম ছিলেন।
সাহিত্যকর্ম মাস্টারপিস হয়ে ওঠার শর্তগুলোর দ্বিতীয়টি হচ্ছে গঠনশৈলী। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরাও প্রেমের উপন্যাস, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাসও প্রেমের উপন্যাস। কিংবা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস, আবার মাহমুদুল হকের কালোবরফও বলা যেতে পারে একই প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস। বিষয় একই; কিন্তু গঠনশৈলীর কারণে দুটিকে আমরা আলাদা করতে পারি। চিনে নিতে পারি এটি মার্কেজের উপন্যাস, এটি শরতের, কিংবা এটি অতীনের উপন্যাস, এটি মাহমুদুলের।
সেলিম আল দীনের কথাসাহিত্য বা কথানাট্য বা কথাকাব্যের গঠনশৈলী প্রসঙ্গে আগেই বলা হয়েছে যে, তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পরীতিতে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু এই শৈলীর ভেতরেও রয়েছে আরেক শৈলী, যেটি একান্তই দেশজ, বিশাল বাংলার প্রচীন ও মধ্যযুগের শিল্পরীতিসম্ভূত। ধাবমানের শুরুতে ‘কবির মৃত স্বজন-পরিজন স্মরণ’ কিংবা ‘কবির পিতৃভূমির প্রশংসা ও অন্যান্য বিষয় স্মরণ প্রয়াস’ কিংবা স্বর্ণবোয়ালের শুরুতে ‘পূর্বজগণের স্তুতি’ অধ্যায়গুলো পাঠের সময় পাঠকের মনে উঁকি দিয়ে যায় দ্বিজ কানাই, দ্বিজবংশী দাস, চন্দ্রাবতীসহ সেলিম আল দীন কথিত তার মাতৃভূমির কালজয়ী লেখকদের মুখ। ইউরোপীয় সাহিত্যতত্ত্ব যেখানে বলছে সাহিত্যকর্মে সাহিত্যিকের অনুপস্থিতির কথা, সেখানে সাহিত্যিক সেলিম আল দীন তার সাহিত্যকর্মে উপস্থিত হচ্ছেন স্বয়ং। কেবল নিজের পরিচয় দিয়েই ক্ষ্যান্ত হচ্ছেন না, পাঠকদের তিনি তার মৃত স্বজন-পরিজন এবং পিতৃভূমির পরিচয়ও জানিয়ে দিচ্ছেন, যেমন জানিয়ে দিতেন তার মাতৃভূমির কালজয়ী লেখকেরা। তার এই আঙ্গিক অখণ্ড বাংলার চিরয়াত উপাখ্যানসমূহের আঙ্গিক। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের আঙ্গিককে ধারণ করে তিনি এমন এক আঙ্গিক বিনির্মাণ করেছেন, যা একান্তই তার, যাকে অন্য কোনো আঙ্গিকের সঙ্গে মেলানো যায় না। অর্থাৎ তিনি যুগচলতি সাহিত্যরীতির বিরুদ্ধে দ্রোহ করেছেন। সেই দ্রোহ তাকে করেছে স্বতন্ত্র পরিচয়ে উজ্জ্বল।
সাহিত্যকর্ম মাস্টারপিস হয়ে ওঠার তৃতীয় শর্তটি হচ্ছে ভাষা। সেলিম আল দীনের ভাষা যে তার পূর্বজ, সমকালীন কিংবা পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের ভাষার সঙ্গে মেলে না, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। প্রতিভাধর শিল্পী কখনো যুগচলতি ভাষারীতির আনুগত্যে বিশ্বাসী হন না, যেমন হননি সেলিম আল দীন। তার সাহিত্যকর্মসমূহে তিনি প্রচলিত ভাষারীতির কোনো চিহ্ন না রেখে সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব ভাষারীতি। পূর্বোল্লোখিত তার কথাসাহিত্য বা কথানাট্যসমূহ পাঠ করলে বোঝা যায় ভাষাগঠনে তিনি যে অতুলনীয়। তার ভাষাশৈলী প্রসঙ্গে ওঠায় মনে পড়ে গেল মিশেল কনট্যাট কর্তৃক গৃহীত দি আমেরিকান বুক অব রিভিউতে প্রকাশিত জাঁ পল সার্ত্রের এক সাক্ষাৎকারের কথা। সেই সাক্ষাৎকারে সার্ত্র বলেছিলেন, ‘বর্তমানে অনেক তরুণ শৈলী নিয়ে অত মাথা ঘামান না। মনে করেন একজন যা বলতে চান তা সোজাসাপ্টাই বলা উচিত। আমার কাছে শৈলী যা সারল্যকে বর্জন করে না বরং তার উল্টোটাই হলো একটির মাঝে তিন বা চারটি বিষয় একত্রে বলা। একটি সরল বাক্যের যেমন প্রত্যক্ষ অর্থ থাকে তেমনি একইসঙ্গে এই প্রত্যক্ষ অর্থের নিচে অন্য অর্থও সুপ্ত থাকে। যদি কেউ ভাষায় অর্থের এই বহুমাত্রিকতা তুলে ধরতে ব্যর্থ হন তবে তার লেখালেখির কষ্ট স্বীকার না করাই ভালো।’
সেলিম আল দীনের সাহিত্যকর্মসমূহে আমরা দেখতে পাই বহু অর্থগামী বাক্যের সমাহার, যে বাক্যে সার্ত্র-কথিত প্রত্যক্ষ অর্থের পাশাপাশি সুপ্ত থাকে একাধিক অর্থ। হরগজের একটি বাক্য এমন: ‘ঝড় যদি অন্ধ তবে রন্ধনের পাত্র ভুল করে নাই কেন?’ বাক্যটি সরল হলেও এর ব্যাখ্যা তরল নয়। এই বাক্যের ভেতরে নিহিত রয়েছে আরও একটি অর্থ। হরগজ গ্রামের সেই প্রলয়ংকরী ঝড় থেকে পাখিরাও নিস্তার পায়নি, মারা পড়েছে বিস্তর পাখি। শহর থেকে উদ্ধারকারী দল ত্রাণকার্যে বিধ্বস্ত হরগজ গ্রামে গিয়ে দেখতে পায় দুটি মৃত চড়ুই চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটি কড়াইতে। চড়ুই দুটি মাটিতেও তো পড়ে থাকতে পারত, কোনো পুকুরেও তো পড়ে থাকতে পারত, কিংবা কোনা ভাঙা ঘরের চালের নিচেও তো পড়ে থাকতে পারত। অথচ পড়ে আছে কিনা রান্নার পাত্র কড়াইতে। ঝড় কী করে চিনল এটা যে কড়াই? সে তো অন্ধ। আশপাশ না দেখে, কোনো কিছু বাছবিচার না করে অন্ধের মতো ছুটে চলাই তার স্বভাব। অথচ সেই অন্ধ ঝড় দুটি চড়ুইকে এনে ফেলল কিনা রন্ধনের পাত্রে! পাঠকমনে প্রশ্ন জাগে, ঝড় কি তবে প্রকৃতই অন্ধ? নাকি সর্বপ্রাণবাদী সেলিম আল দীন ঝড়কেও সপ্রাণ বলতে চেয়েছেন? অর্থাৎ একটি বাক্য একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ দ্বৈত অর্থকে ধারণ করছে। সেই সুপ্ত অর্থটির ব্যাখ্যা তিনি করেননি, পাঠকের কাছে প্রশ্ন আকারে রেখে দিয়েছেন।
অপরদিকে প্রাচ্য উপাখ্যানের একটি বাক্য এমন : ‘কোনটা তবে কী থেকে পৃথক হবে।’ সয়ফরচানের প্রশ্ন। বাক্যটি একই সঙ্গে বহু অর্থকে ধারণ করছে। এই বাক্যে মানুষ ও প্রকৃতি এক ঐক্যে এসে মিলিত হয়। অর্থাৎ মানুষ থেকে মানবেতর প্রাণীদের পৃথক করা যাবে না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করা মানে মানুষের জয় নয়। মানবেতর প্রাণীদের বিনাশ করে মানুষ নিজেরই বিনাশ ডেকে আনছে। মানুষ কোনো একক প্রাণী নয়, মানুষ একা বাঁচতে পারে না, তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সাগর, নদী, পাহাড়, বৃক্ষ, চন্দ্র, সূর্য এবং মানবেতর সব প্রাণী। মানুষ যদি এসবকে বাদ দিয়ে একা বাঁচতে চায়, তবে বিপন্ন হবে তার অস্তিত্ব; কিন্তু এই সত্য মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না। সয়ফরচান পেরেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, মানুষের জন্য বৃক্ষ প্রয়োজন। প্রয়োজন সাপেরও। কেননা সাপও বৃক্ষের মতোই ভূমিভেদী, প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন করে মানব-অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। মানুষ ও প্রকৃতি কোনোটাই কোনোটা থেকে পৃথক নয়, একে অন্যের পরিপূরক। তাই সয়ফরের বিহ্বল উক্তি : ‘কোনটা তবে কী থেকে পৃথক হবে।’
স্বর্ণবোয়ালের ‘শিকার পর্ব-২’ অধ্যায়ে নিশিরাতে বেউলা বিলে শিকারে ধ্যানমগ্ন তিরমন দেখতে পায় নিকারি পাড়ার পূর্বপুরুষদের, যারা এখনো স্বর্ণবোয়াল শিকারের আশায় কোশা ভাসিয়ে রেখেছে চিরলির বুকে। গাঙের ওই পাড়ে মৃত জনম মাঝিও স্বর্ণবোয়াল শিকারে এসেছে এই রাতে। তিরমন ঠিক বুঝতে পারে না এরা কারা। সে জানতো তার জনম দাদা, অবইন দাদা এবং তার পিতা খলিশা তাকে প্রলুব্ধ করেছে স্বর্ণবোয়াল শিকারে; কিন্তু এরা কারা এই গহিন রাতে সারিবাঁধা বোয়াল শিকারি? সে হাঁক দেয়, ‘হেই গো সেলাম। কখন আসছেন আপনরা।’ তাদের কেউ একজন বলে, ‘কত কাল ধইরা ছিপ ফালায়া বইসা আছি। দিনে মিলাই রাইতে আসি। তা বইসা আছি তো বাজান বইসা আছি...।’
প্রত্যক্ষ অর্থে পাঠকের মনে হতে পারে, এরা, অর্থাৎ যারা বহুকাল ধরে চিরলি গাঙের বুকে কোশা ভাসিয়ে ছিপ ফেলে বসে আছে স্বর্ণবোয়াল শিকারের আশায়, তারা নিশ্চয়ই নিকারিপাড়ার পূর্বপুরুষ। একই সঙ্গে কোনো কোনো পাঠকের মনে হতে পারে অন্তর্নিহিত আরেকটি অর্থ যে, না, এরা নিকারিপাড়ার কেউ নয়, এরা শিল্পের প্রাচীন শিল্পীগণ। যেমন ব্যাস, হোমার, বাল্মিকী, ভাস, কালিদাস কিংবা ফেরদৌসী। স্বর্ণবোয়ালকে মনে হবে এমন এক অজেয় শিল্প, যাকে ধরতে চেয়ছিলেন তারা। কেননা আখ্যানের শুরুতে ‘পূর্বজগণের স্তুতি’ অধ্যায়ে সেই পূর্বাভাসও দিয়ে রেখেছেন আখ্যানকার। লিখেছেন, ‘হায় ফেরদৌসী, সহস্র বৎসর কালে দূরের ভ্রমণে হঠাৎ পায়ের কাছে পার্সিক যুদ্ধক্ষেত্রের প্রাচীন ও জীর্ণ নীল পতাকা দেখে বিস্মিত হয়েছিলে। তার থেকে রক্তপিপাসু মানুষের চিৎকার ধূলিকণার গাথা শুনে শুনে সম্রাটগণের বিজয়গাথাকে ধুলার সমান করে তুলেছিলে তুমি। তোমার মদের পেয়ালার চারপাশে বন্ধুজনা। যৌবনের সমস্ত সুখ বড়শিতে গেঁথে নিক্ষেপ করলে অমর শিল্পসমুদ্রে। স্বর্ণ মেলেনি তবু হে স্বর্ণবোয়াল শিকারি এই সত্য বুঝেছিলে তোমার গ্রন্থে গ্রহ নক্ষত্রের পতিপথ গাঁথা হলো। বহুকাল গত হলে আরও দু-একজন মাত্র কেউ মরামানুষের অমরণ চিহ্ন খুঁজে এনে জড়ো করেছিল। অপঘাত ইতিহাস রুখে দিতে দাঁড়িয়েছিল সেই সকল স্বর্ণবোয়াল শিকারিরা। তাদের কেউবা কৃত্তিবাস, কেউবা গ্যাটে টলস্টয় আলাওল কারু নাম মধুসূদন।’
সেলিম আল দীনের সাহিত্যভাষা বহু অর্থগামী এবং সপ্রাণ। সপ্রাণ ভাষা পাঠকের সঙ্গে কথা বলে, পাশাপাশি হাঁটে, ছোটে। এই ভাষা জোরপূর্বক বানিয়ে তোলা নয়, স্বতঃস্ফূর্ত; যাতে কোনো সংশয় নেই, কোনো দ্বিধা নেই, কোনো জড়তা নেই। এই ভাষা গতিময়, প্রাণোচ্ছ্বল, উজানী স্রোতের মতো দামাল। এই ভাষা প্রচলিত ব্যাকরণ ভাঙার অভিলাষী। এই ভাষায় আছে আশ্চর্য মাদকতা যা পাঠককে করে তোলে নেশাতুর। এই সপ্রাণ ভাষায় আছে সুর, যে সুরের সুমিষ্টতার কথা বলেছেন সেলিম আল দীন। সেই সুরের লহরী পাঠকচিত্ত করে তোলে আকুল। একইসঙ্গে এই ভাষা স্বভাবে গম্ভীর, প্রবল ব্যক্তিত্ববান। তার ভাঁজ খুলতে হয়। ভাঁজ খুলে খুলে তাকে আবিষ্কার করতে হয়। এই ভাষা অতলান্ত সমুদ্রের ঝিনুকের মতো, যে ভেতরে লুকিয়ে রাখে মুক্তোদানা। কিংবা সে মাটির গভীর গহিনের হীরক। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তাকে তুলে আনতে হয়। খুঁড়তে পাঠকের কষ্ট হয় না, পাঠক ক্লান্ত হয় না, বরং থাকে আবিষ্কারের উত্তেজনা, প্রাপ্তির আনন্দ।
যে সাহিত্যিক স্বীয় সাহিত্যভাষাকে একইসঙ্গে সুরেলা, প্রাণবান ও ব্যক্তিত্ববান করে তুলতে পারেন তিনিই বড় সাহিত্যিক। তাকেই আমরা বলি ভাষাশিল্পী, কথাশিল্পী। সেলিম আল দীন প্রচলিত রীতিদ্রোহী সেই সুনিপুণ কথাকারুকার, কথা দিয়ে সাহিত্য সৃজন করে সেই সাহিত্যে যিনি আমাদের স্নাত করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করে যাবেন। জন্মদিনে এই বিস্ময়কর কথাকারুকারকে জানাই সহস্র প্রণতি।
স্বকৃত নোমান: কথাসাহিত্যিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে