Views Bangladesh Logo

সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

ত ৩০ জুন সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের সাধারণ সঞ্চয়কারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পেছনে রয়েছে এক নির্মম বাস্তবতা- দেশের বিপুলসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সঞ্চয়পত্র শুধু একটি বিনিয়োগ মাধ্যম নয়, এটি তাদের মাসভিত্তিক আয়ের একটা ব্যবস্থা, জীবনের প্রধান অবলম্বন। চিকিৎসা, বাসা ভাড়া, সন্তানদের শিক্ষা খরচ বা খাদ্যসামগ্রী কেনা- এসব খরচ মেটাতে দীর্ঘদিন ধরে তারা নির্ভর করেছেন সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর।

এই বাস্তবতায় হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে দেওয়া যেন তাদের জীবনের নিরাপত্তাবোধে সরাসরি আঘাত হেনেছে। এটি যেন এমন সময় এসেছে, যখন মানুষ এমনিতেই চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত তাই নিঃসন্দেহে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্যসামগ্রীর দাম, বাসাভাড়া, জ্বালানি ব্যয়- সবই বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। অথচ একই সময়ে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির হার একেবারেই নগণ্য, এবং সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া দেশের বৃহৎ কর্মজীবী জনগোষ্ঠী পেনশনের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন। ফলে এই সংকট আরও প্রকট।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা বোঝা যায় জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে কম, বরং আগের বিনিয়োগ ভেঙে নিচ্ছে বেশি। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, মানুষের বিনিয়োগ ক্ষমতা ও সঞ্চয় ক্ষমতা দুটোই হ্রাস পেয়েছে।
উন্নত দেশে ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনা (পারসোনাল ফাইন্যান্স) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেনশন, জীবনবীমা, স্বাস্থ্যবীমা, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ- সবকিছুর একটি পরিকল্পিত কাঠামো থাকে। বাংলাদেশে এটি এখনো একেবারেই দুর্বল।

২০২৩ সালে দেশে সর্বজনীন পেনশন চালু করা হলেও সেটি এখনো খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। বীমা কোম্পানিগুলোর পেনশন প্রকল্প সম্পর্কেও মানুষ জানে না বা আস্থা রাখতে চায় না। ফলে অধিকাংশ মানুষ বিকল্পহীন অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের ওপরই ভরসা করে। এই নির্ভরশীলতার সুযোগে যখন সরকার সুদহার কমিয়ে দেয়, তখন এটি আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে আসে। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। নিয়েছে ভিন্ন রকম সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। শ্রীলঙ্কায় ‘অম্মসুমা’ নামের নগদ সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে, যা দারিদ্র্য মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পাকিস্তানে ‘এহসাস’ কর্মসূচির আওতায় প্রায় দেড় কোটি পরিবারকে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। ভারতে, আধার কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নগদ সহায়তা দেওয়া সম্ভব, সঙ্গে রয়েছে জ্বালানি ভর্তুকি ও রেশন সুবিধা।

বাংলাদেশেও সরকার কিছু সীমিত সহায়তা কর্মসূচি চালু রেখেছে, যার মধ্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অন্যতম। টিসিবি মাসিক নির্দিষ্ট কোটায় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কিছু ভর্তুকি দেওয়া পণ্য যেমন- চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি ট্রাকসেল ও ‘পরিবার কার্ড’-এর মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। তবে এই সহায়তা একদিকে যেমন সংখ্যাগত দিক থেকে অপ্রতুল, অন্যদিকে রয়েছে পদ্ধতিগত ও সামাজিক অসুবিধা। প্রথমত, দেশে কোটি কোটি মানুষ সীমিত আয়ে জীবনযাপন করলেও টিসিবির সহায়তা পৌঁছে মাত্র কয়েক লাখ পরিবারে, যা মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় অতি নগণ্য। দ্বিতীয়ত, সহায়তা বিতরণের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট স্বচ্ছ ও মর্যাদাপূর্ণ নয়- লোকসমক্ষে লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাক থেকে চাল বা ডাল কিনতে গিয়ে অনেকেই অপমানবোধ করেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যাঁরা সমাজে ‘সহায়তা গ্রহণকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না, তারা এই সুবিধা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। ফলে সহায়তার বাস্তব সুফল অনেক সময় যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারাই পান না।

এই সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি আরও গভীর সমস্যা হলো, অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র ও মানুষের জীবনের মানের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা, তা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের ঘরে ছিল, যা নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক দিক। এই প্রবৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্য কমেছে বলে পরিসংখ্যান বলছে। তবে বাস্তব জীবনে এই প্রবৃদ্ধির সুফল সমানভাবে বণ্টিত হয়নি। অবকাঠামো উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি কিংবা শহরাঞ্চলে ভোক্তা চাহিদা বেড়ে যাওয়া- এসব সূচক দিয়ে প্রবৃদ্ধির পরিমাপ করা গেলেও জীবনের গুণগত মান, বিশেষ করে খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের স্থায়িত্ব- এই খাতে উন্নতি ছিল বেশ সীমিত।

বর্তমানে পরিস্থিতি আরও নাজুক। কভিড-১৯ মহামারি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দেশীয় মুদ্রানীতির চাপে প্রবৃদ্ধির গতি কমে এসেছে। একদিকে কর্মসংস্থান কম, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বেড়েই চলেছে। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সংকেত নয়, বরং একটি মানবিক সংকেত- যেখানে মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণেও ব্যর্থ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, টিসিবির মতো সীমিত এবং মর্যাদাহানিকর সহায়তা কাঠামো দিয়ে প্রকৃত অর্থে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়া সম্ভব নয়। বরং প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা নীতি, যা সকল শ্রেণির মানুষকে সংকটে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার সুযোগ করে দেবে।

এই অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল, দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপে তাদের পাশে দাঁড়ানো; কিন্তু সরকার সেই দায় কাঁধে না নিয়ে উল্টো সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে সাধারণ মানুষকে আরও কোণঠাসা করে তুলছে। দীর্ঘমেয়াদে মানুষের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও পেনশন খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। বীমা কোম্পানিগুলোর ওপর আস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পেনশন প্রকল্পগুলো জনপ্রিয় করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সঞ্চয়পত্রের সুদ সময়োপযোগীভাবে পুনর্নির্ধারণের পাশাপাশি সরকারকে একটি বিকল্প নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা; সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি করা এবং নির্দিষ্ট করে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশেষায়িত কর্মসূচি চালু করা।

সঞ্চয়পত্র কেবল একটি আর্থিক বিনিয়োগের মাধ্যম নয়- এটি অনেক মানুষের জীবনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা-ব্যবস্থা। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক, বিধবা নারী, একক আয়ের পরিবার, এবং সীমিত সামর্থ্যের মধ্যবয়সী মানুষদের জন্য এটি জীবনধারণের একটি প্রধান ভরসা। কর্মজীবনের দীর্ঘ সময়ে সঞ্চিত অর্থ তারা সঞ্চয়পত্রে জমা রাখেন এই আশায় যে, ভবিষ্যতে একটি স্থিতিশীল ও সম্মানজনক জীবনযাপন সম্ভব হবে। এটি শুধু একটি ব্যাংকে টাকার বিনিয়োগ নয়, বরং এটি একজন মানুষের জীবনের শেষ প্রান্তে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যখন মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া, প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং মানুষের আয় প্রায় অপরিবর্তিত- তখন সঞ্চয়পত্র থেকে আসা সামান্য মুনাফাটুকুই হয়ে ওঠে পরিবার চালানোর একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস।

এই অবস্থায় হঠাৎ করে সেই মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়া শুধু একটি অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ নয়, এটি সরাসরি আঘাত হানে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাবোধে, ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা ও স্বপ্নের পরিকল্পনায়। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা টেকসই অর্থনীতি ও মানবিক উন্নয়নের মধ্যে এক চরম বৈপরীত্যের সৃষ্টি করে। অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারকে কখনো কখনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়- তা সত্য। বাজেট ঘাটতি সামলানো, মুদ্রানীতি সামঞ্জস্য রাখা কিংবা ঋণনির্ভরতা হ্রাস করা- এসবই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অংশ। তবে এই সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা উচিত: অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবনমানের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সফলতা কেবল বাজেটের ভারসাম্যে নয়, বরং তা নির্ভর করে সাধারণ মানুষের স্বস্তি, আস্থা ও ভবিষ্যতের আশাবাদের উপর। মানুষ যখন নিজেদের সঞ্চয়ের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে, যখন রাষ্ট্র তাদের পাশে নেই বলে অনুভব করে, তখন বৃহৎ অর্থনৈতিক সূচকের উন্নয়ন সাধারণ নাগরিকের জীবনে কোনো অর্থ বহন করে না। সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর মতো সিদ্ধান্ত তাই কাগজে-কলমে টেকনিক্যালি সঠিক হলেও বাস্তবতায় এটি অনেক মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা ও দুর্ভাবনার জন্ম দেয়। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে মানবিক বিবেচনা না থাকলে তা শেষ পর্যন্ত গণবিরোধী হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, সামষ্টিক অর্থনীতিতে হয়তো কিছু ভারসাম্য তৈরি হয়, কিন্তু মানুষের জীবনে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায় না। এইজন্যই বলা হয়, এমন সিদ্ধান্ত কার্যত হয়ে ওঠে- মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ